দেশের সময় ওয়েবডেস্কঃ কথায় বলে রাজনীতিতে শব্দই ব্রহ্ম।
একুশ সালে ভোট আসছে। তার আগে গত কয়েকদিন ধরেই দেখা যাচ্ছে দলের কয়েকজন মন্ত্রী, বিধায়ককে নিয়ে বেজায় অস্বস্তিতে পড়েছে শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস। তাঁদের কেউ অরাজনৈতিক ব্যানারে বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন, কেউবা প্রকাশ্যে বিদ্রোহ ঘোষণা করছেন, ফলে একুশের ভোটের আগে বিড়ম্বনা বাড়ছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলে। অনেকে আবার দল, দলের পদ ছাড়ার হুঁশিয়ারিও দিচ্ছেন।
সেচ ও পরিবহণমন্ত্রী তথা দলের দাপুটে নেতা শুভেন্দু অধিকারীকে নিয়ে নাকানিচোবানি অবস্থা তৃণমূলের। কখনও তাঁর সভার মোকাবিলা করতে গিয়ে নন্দীগ্রামে পাল্টা সভা করতে হচ্ছে তো কখনও তাঁকে ফোন করে বোঝানোর চেষ্টা করছেন রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সী। বৃহস্পতিবার আবার দু’শ কিলোমিটার দূরে তাঁর বাড়ি চলে গিয়েছেন পেশাদার প্রশান্ত কিশোর।
এর মধ্যে বোধহয় দলকে সবথেকে বেশি বেগ দিচ্ছেন রাজ্যের মন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারী। চলতি বছরের মার্চ মাসে ‘বাংলার গর্ব মমতা’ নামে কর্মসূচি শুরু করেছিল তৃণমূল। এই উপলক্ষে কলকাতার নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে সভার আয়োজন করা হয়েছিল। লক্ষ্য, রাজ্যের আড়াই কোটি মানুষের কাছে পৌঁছনো। দলের সব বিধায়ককে এর প্রচারের কাজে নেমে পড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। তখন থেকে দলের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয় শুভেন্দুর। ওইদিন তিনি ওই সভাতে যোগ দেননি বলে খবর।
মাঝে লকডাউনের কারণে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রায় বন্ধই ছিল সব রাজনৈতিক দলের। তবে লকডাউন ওঠার পর ধীরে ধীরে রাজনৈতিক কর্মসূচি নিতে শুরু করে দল। দেখা যায়, তৃণমূলের ‘বাংলার গর্ব মমতা’ বা ‘দিদিকে বলো’র ব্যানারের বাইরে রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় শুভেন্দুর ছবি দিয়ে পোস্টার, ব্যানার লাগানো শুরু হয়। কখনও সেখানে লেখা ‘আমরা দাদার অনুগামী’, ‘বাংলার বাঘ’ বা ‘বাংলার উদীয়মান সূর্য’। এর মাঝে অরাজনৈতিক ব্য়ানারে তিনি একাধিক কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন।
কিন্তু সে সবের মধ্যেই তৃণমূলের হুগলির নেতা তথা শ্রীরামপুরের সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় নাম না করে শুভেন্দুর উদ্দেশে যে সব কথা বলেছেন, তা নিয়েই এখন ক্ষোভ দলা পাকাচ্ছে দলের মধ্যে। তথাকথিত ‘দাদার অনুগামীরা’ রেগে আগুন। কিন্তু সে ছাড়াও দলের মধ্যেই অনেক নেতা, কর্মী, সমর্থকের মতে, কল্যাণের ‘কুকথাই’ পণ্ড করে দিতে পারে সমস্ত দৌত্য। এক জন সাংসদের মুখে এ হেন কথাবার্তা কতটা শালীন সেই প্রশ্নও উঠছে।
তিনি অবশ্য শুভেন্দুর নাম করেননি। তবে বলেছিলেন, “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নামে গাছের তলায় বড় হয়েছিস। ৪টে মন্ত্রিত্ব পেয়েছিস, ৪ খানা চেয়ারে আছিস। কত পেট্রোল পাম্প করেছিস! মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় না থাকলে মিউনিসিপ্যালিটিতে আলু বিক্রি করতিস রে, আলু বিক্রি করতিস।” তথাকথিত দাদার অনুগামীদের উদ্দেশে তুই-তোকারি করে আরও কিছু কথা বলেন কল্যাণ।
হুগলি তথা রাজ্য রাজনীতিতে এক সময়ে কুকথার জন্য প্রসিদ্ধ ছিলেন সিপিএমের প্রয়াত নেতা অনিল বসু। তার খেসারতও দিতে হয়েছিল সিপিএমকে। অনেকের মতে, কল্যাণও যেন সে পথেই হাঁটছেন। তাঁর বিরুদ্ধে এই সমালোচনা নতুন নয়। রাজনৈতিক বিরোধীদের আক্রমণ করতে গিয়ে তিনি বারবার শালীনতার সীমা ছাড়িয়েছেন বলে অভিযোগ। কখনও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে ‘ইঁদুরের বাচ্চা’ বলেছেন তো কখনও কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনকে ‘কালনাগিনী’ বলে কটাক্ষ করেছেন। তা ছাড়া দলের কর্মীদের সঙ্গে তাঁর ব্যবহার নিয়েও বহু বার প্রশ্ন উঠেছে। যদিও কল্যাণের সম্পর্কে এই সব অভিযোগ প্রসঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একবার বলেছিলেন, “ওর মুখের জোর নিয়ে অনেকে কথা বলেন। আসলে উকিলদের মুখের জোর থাকতে হয়। নইলে কোর্টে শোনা যায় না।”
তবে সে সব পুরনো কথা। কল্যাণের গতকালের মন্তব্য নিয়েই এখন আলোড়ন চলছে তৃণমূলের মধ্যে। শুভেন্দুকে বোঝানোর জন্য রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সী বা প্রশান্ত কিশোর যে রকম সক্রিয় তাতে কিছুটা আশা বাড়ছিল দলের অনেকেরই। কিন্তু তাঁরা আশঙ্কা করছেন, কল্যাণ যে ধরনের কথা বলেছেন, তাতে তিক্ততা উল্টে বেড়ে যাওয়ার কথা।
দলের এক রাজ্য নেতার কথায়, শুভেন্দুকে বুঝিয়ে দলে রাখতে কী ধরনের চেষ্টা চলছে সে ব্যাপারে নানা রকম জল্পনা এখন শোনা যাচ্ছে। এও শোনা যাচ্ছে, ওঁকে রাজ্য সভাপতি করে দেওয়া হতে পারে। সত্যিই যদি তা হয়, তখন হুগলিতে কাকে আলু বেচতে হবে?
স্বাভাবিক ভাবেই তৃণমূলে শুভেন্দু অনুগামীরা কল্যাণের কথায় চটেছেন। তাঁদের মতে, নন্দীগ্রামে শুভেন্দুর সভার দিনও কল্যাণ ‘দাদা’-র উদ্দেশে বাজে কথা বলেছেন। ফের কাল ওসব বলেছেন। দলের উপরতলার প্রশ্রয় না থাকলে কি কেউ এসব বলতে পারে? এর পরে কি আর আলোচনা সম্ভব?