দেশের সময় ওয়েবডেস্কঃ করোনার টিকার দৌড়ে বড়সড় সাফল্য আনতে চলছে ব্রিটেনের ভ্যাকসিন নির্মাতা সংস্থা স্পাইবায়োটেক। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির অধীনস্থ এই সংস্থা এমন ভ্যাকসিন ক্যানডিডেট তৈরি করেছে যা অক্সফোর্ডের মতো ভেক্টর ভ্যাকসিন নয়, আবার আমেরিকার মোডার্নার মতো মেসেঞ্জার আরএনএ (এমআরএনএ) ভ্যাকসিনও নয়। নতুন রকমের টিকা যা শুধু করোনাভাইরাস নয়, যে কোনও সংক্রমণ, ক্রনিক রোগ, ক্যানসারের মতো মারণ রোগকেও ঘায়েল করতে পারবে বলে দাবি। সবচেয়ে বড় কথা হল এই টিকার আবিষ্কারক কলকাতার মেয়ে ডক্টর সুমি বিশ্বাস যিনি স্পাইবায়োটেকের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও চিফ একজিকিউটিভ অফিসার।
চমকের শেষ এখানেই নয়। স্পইবায়োটেকের তৈরি এই নতুন রকম টিকার ট্রায়ালের দায়িত্ব পেয়েছে ভারতের প্রথম সারির ভ্যাকসিন নির্মাতা সংস্থা সেরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া। অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রজেনেকার কোভিড ভ্যাকসিন ভারতে তৈরির লাইসেন্স পেয়েছে সেরাম। অক্সফোর্ডের ভাইরোলজিস্ট সারা গিলবার্ট ও অ্যাড্রিয়ান হিলের টিমের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে সেরামের।
এবার স্পাইবায়োটেকের সঙ্গেও চুক্তি হয়েছে সেরাম ইনস্টিটিউটের। সেরাম সিইও আদর পুনাওয়ালা জানিয়েছেন, স্পাইবায়োটেকের এই ভ্যাকসিন গবেষণার তত্ত্বাবধানে ছিল অক্সফোর্ডের সারা গিলবার্টের টিম ও জেন্নার ইনস্টিটিউটের ভাইরোলজিস্টরা। ল্যাবরেটরিতে সেফটি ট্রায়ালে উতরে যাওয়ার পরেই সেরামের সঙ্গে টিকার উৎপাদন ও ট্রায়াল সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচনা হয় স্পাইবায়োটেকের। সেরাম ইনস্টিটিউটে যেহেতু কয়েক কোটি টিকার ডোজ তৈরির মতো পরিকাঠামো রয়েছে তাই এই সংস্থাকেই টিকা তৈরির বরাত দেয় স্পাইবায়োটেক। প্রথম দুই পর্বের ট্রায়ালের দায়িত্বও দেওয়া হয়েছে সেরামকেই।
আদর জানিয়েছেন, অক্সফোর্ডের সহযোগিতায় এই টিকার বৃহত্তর ট্রায়াল শুরু হয়েছে অস্ট্রেলিয়ায়। প্রথম দুই পর্বে শতাধিক স্বেচ্ছাসেবককে টিকার ইঞ্জেকশন দেওয়া হবে। কী কী ডোজে এই টিকার ট্রায়াল হবে সেটা এখনও সবিস্তারে জানানো হয়নি।
SpyBiotech and Serum Institute of India announce that the first subjects have been dosed in a Phase I/II trial of a novel virus-like particle vaccine targeting COVID-19.
— SpyBiotech (@SpyBiotech) September 8, 2020
You can read more about the vaccine development programme on our website: https://t.co/fF1XciwQvU pic.twitter.com/cH95NuRbOA
কলকাতায় জন্ম সুমি বিশ্বাসের। বেঙ্গালুরু ইউনিভার্সিটি থেকে মাইক্রোবায়োলজি নিয়ে পড়াশোনার পরে ২০০৫ সালে ব্রিটেনে পাড়ি দেন। অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন গবেষণা সংক্রান্ত বিভাগ জেন্নার ইনস্টিটিউটে ভ্যাকসিনোলজির অধ্যাপক হিসেবে কাজ শুরু করেন। অধ্যাপনার পাশাপাশি গবেষণাও চলতে থাকে। পরবর্তীকালে অক্সফোর্ডের অধীনেই নতুন গবেষণা সংস্থা স্পাইবায়োটেক তৈরি করেন সুমি ও অন্যান্য গবেষকরা। বর্তমানে ডক্টর সুমি বিশ্বাস স্পাইবায়োটেকের সিইও এবং অক্সফোর্ডের নাফফিল্ড মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক।
সুমি জানিয়েছেন, সারা গিলবার্টের টিমের নেতৃত্বেই নতুন রকম ভ্যাকসিন নিয়ে গবেষণা শুরু করেন তিনি। এই কাজে সাফল্য এসেছে। টিকার প্রি-ক্লিনিকাল ট্রায়ালে পশুদের শরীরে ইতিবাচক প্রভাব দেখা গেছে। এই টিকা মানুষের শরীরেও সম্পূর্ণ সুরক্ষিত বলেই দাবি করেছেন তিনি।
অক্সফোর্ড যেমন সর্দি-কাশির ভাইরাস অ্যাডেনোভাইরাসের স্ট্রেনকে দুর্বল করে তার সঙ্গে করোনার স্পাইক গ্লাইকোপ্রোটিন (S) মিশিয়ে টিকা তৈরি করেছে, স্পাইবায়োটেকের পদ্ধতি তার থেকে আলাদা। ডক্টর সুমি বলেছেন, অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন হল ডিএনএ (ডিঅক্সিরাইবো নিউক্লিক অ্যাসিড)ভেক্টর ভ্যাকসিন, কিন্তু স্পাইবায়োটেক তাদের নতুন প্রযুক্তিতে টিকা বানিয়েছে। কী সেই প্রযুক্তি? স্পাইক্যাচার বা স্পাইট্যাগ ( SpyCatcher/SpyTag) প্রোটিন সুপারগ্লু টেকনোলজিতে টিকা তৈরি হয়েছে।
এই পদ্ধতিতে করোনাভাইরাসের কাঁটার মতো স্পাইক প্রোটিনগুলোকে অন্য একটি ভ্যাকসিনের উপর আঠার মতো সেঁটে দেওয়া হয়। বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়াটা জটিল। তবে সহজ করে বলতে গেলে, স্পাইক প্রোটিনগুলোকে আগে ল্যাবরেটরিতে ‘পিউরিফাই’ করে নেওয়া হয়। যে কোনও প্যাথোজেন বা ভাইরাসের প্রোটিন সংক্রামক। তাদের সরাসরি মানুষের শরীরে ঢোকালে প্রতিলিপি তৈরি করে সংখ্যায় বাড়তে থাকবে। তাই সংক্রামক প্রোটিন থেকে টিকা তৈরির সময় আগে তাদের বিষদাঁত ভেঙে দেওয়া হয়। অর্থাৎ কোনও ক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয় করা হয়, আবার কোনও ক্ষেত্রে দুর্বল করে তার আগাগোড়া সাফসুতরো করে নেওয়া হয় যাতে মানুষের শরীরে ঢুকে কোনও ক্ষতি করতে না পারে। এই প্রক্রিয়াকেই বলে পিউরিফাই করা।
ডক্টর সুমি বলছেন, ল্যাবে পিউরিফাই করার পরে স্পাইক প্রোটিনগুলোকে হেপাটাইটিস-বি অ্যান্টিজেনের (HBsAg) সারফেসে বিশেষ উপায় আটকে দেওয়া হয়েছে। হেপাটাইটিস-বি ভ্যাকসিন লাইসেন্সপ্রাপ্ত, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্ট্যাম্প বসানো ভ্যাকসিন। কাজেই মানুষের শরীরে এই ভ্যাকসিনের সুরক্ষা ও কার্যকারীতা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তাই লাইসেন্সপ্রাপ্ত এই ভ্যাকসিনের উপরেই করোনার স্পাইক প্রোটিন সেঁটে দিয়ে নতুন রকমের ভ্যাকসিন ক্যানডিডেট ডিজাইন করেছেন ডক্টর সুমি। এই ভ্যাকসিন শরীরে ঢুকলে কাজ হবে দু’ভাবে।
প্রথমত হেপাটাইটিস-বি অ্যান্টিজেন শরীরের বি-কোষকে সক্রিয় করে তুলবে। দ্বিতীয়ত, হেপাটাইটিস-বি অ্যান্টিজেনের সঙ্গেই থাকা করোনার স্পাইক প্রোটিনও তার খেল দেখাতে শুরু করবে। এর প্রভাবেও বি-কোষ সক্রিয় করে অ্যান্টিবডি তৈরির প্রক্রিয়া চালু করে দেবে। যেহেতু দু’রকমের অ্যান্টিজেন এই টিকায় ব্যবহার করা হয়েছে তাই শুধু করোনা নয় যে কোনও সংক্রামক রোগের বিরুদ্ধেই ‘অ্যাডাপটিভ ইমিউন রেসপন্স’ তৈরি হবে শরীরে। শক্তপোক্ত রোগ প্রতিরোধ শক্তি গড়ে উঠবে ধীরে ধীরে।
স্পাইবায়োটেক জানিয়েছে সেরামের সঙ্গে টিকার ট্রায়াল শুরু করার পরে তার ফলাফল দেখেই ডোজ তৈরি শুরু হয়ে যাবে। কয়েক লক্ষ ভ্যাকসিনের ডোজ তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।