দেশের সময় ওয়েবডেস্কঃ প্রয়াত ৬২-র এশিয়াডে সোনাজয়ী ভারতীয় ফুটবল দলের অন্যতম নক্ষত্র চুনী গোস্বামী। বৃহস্পতিবার বিকেল ৫টা নাগাদ কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ৮২ বছর।
জানা গিয়েছে, বৃহস্পতিবার যোধপুর পার্কের ফ্ল্যাটেই ছিলেন অসুস্থ চুনীবাবু। পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, দুপুরে পরপর দু’বার কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয় তাঁর। এরপর স্থানীয় একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁকে। সেখানে বিকেল পাঁচটা নাগাদ আরও একবার হার্ট অ্যাটাক হয়ে বলে জানা গিয়েছে। চিকিৎসকদের সব চেষ্টা বিফল করে পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে গেলেন জাকার্তা এশিয়াডে ভারতীয় ফুটবল দলের সোনাজয়ী অধিনায়ক।
আসল নাম সুবিমল গোস্বামী। জন্ম বাংলাদেশে। ১৯৪৮ সালে মাত্র ৮ বছর বয়সে মোহনবাগানের জুনিয়র দলে সুযোগ পান চুনী গোস্বামী। ১৯৫৬ সালে ভারতীয় দলে অভিষেক হয় চুনীর। ১৯৫৮ সালে ভারতের অধিনায়ক হন। আজীবন ছিলেন মোহনবাগানের ফুটবলার। ১৯৬০ সাল থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত ছিলেন বাগানের অধিনায়ক।
ভারতের হয়ে ৫০টিরও বেশি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছেন চুনী গোস্বামী। করেছেন ১৩টি গোল। তাঁর অধীনেই ৬২’র জাকার্তা এশিয়াডে দক্ষিণ কোরিয়াকে ২-১ গোলে হারিয়ে সোনা জিতেছিল পিকে-চুনীর ভারত। মোহনবাগানের হয়ে ২০০-র বেশি গোল রয়েছে চুনীর। সন্তোষ ট্রফিতে বাংলার প্রতিনিধিত্ব করেছেন তিনি। ১৯৬৮ সালে ফুটবল থেকে অবসর নেন এই কিংবদন্তি।
ফুটবল থেকে অবসর নেওয়ার পরে ক্রিকেট খেলা শুরু করেন চুনী গোস্বামী। বাংলার হয়ে ৪৬টি রঞ্জি ম্যাচ খেলেছেন তিনি। রয়েছে একটি শতরান। তাঁর অধিনায়কত্বে দু’বার বাংলা রঞ্জি ট্রফির ফাইনালে উঠেছিল। ব্যাট করার সঙ্গে বলও করতে পারতেন এই অলরাউন্ডার।
ক্রিকেট থেকে অবসর নেওয়ার পর টেনিস খেলা শুরু করেন চুনী। একটি সিনেমায় অভিনয়ও করেছিলেন চুনী। ক্রিকেট, টেনিস খেলা থেকে অভিনয় করলেও আজীবন তিনি বাঙালির মনে থেকে যাবেন তাঁর ফুটবল প্রতিভার জন্য।
১৯৬৩ সালে অর্জুন পুরস্কার পান চুনী গোস্বামী। ১৯৮৩ সালে পেয়েছিলেন পদ্মশ্রী পুরস্কার। ২০০৫ সালে মোহনবাগান রত্নে তাঁকে ভূষিত করে ক্লাব। এত সম্মান, এত কৃতিত্ব ছেড়ে বন্ধু পিকে-র পরে অমৃতলোকে যাত্রা করলেন চুনী। বড্ড একা হয়ে গেলেন তুলসীদাস বলরাম।
তবে শুধু ফুটবলার নন। চুনী গোস্বামী চুটিয়ে ক্রিকেটও খেলেছেন। একটা সময় বাংলার হয়ে প্রথম শ্রেণীর ম্যাচও খেলেছেন। রনজি দলে জায়গা পেয়েছিলেন। ১৯৭১–৭২ মরসুমে চুনীর নেতৃত্বে বাংলা দল রনজি ফাইনালে উঠেছিল। কিন্তু মুম্বইয়ের ব্রাবোর্ন স্টেডিয়ামে তৎকালীন বোম্বের কাছে হেরে গিয়েছিল বাংলা। অবশ্য ফুটবলকেই বেশি আপন করে নেন তিনি। তবে ৪৬টি একদিনের ম্যাচে ১৫৯২ রান করেছেন তিনি। তার মধ্যে রয়েছে ১টি শতরান ও ৭টি অর্ধ শতরান। এছাড়া নিয়েছেন ৪৭টি উইকেট। এখানেই শেষ নয় হকি এবং লন টেনিসেও সমান পারদর্শী ছিলেন কিংবদন্তি এই ফুটবলার। এমনকি একটি বাংলা সিনেমাতেও অভিনয় করেছেন তিনি।
আর এহেন ব্যক্তির মৃত্যুতে কার্যত শোকের ছায়া নেমে এসেছে ময়দানে। গত ২০ মার্চ মৃত্যু হয় ময়দানের আরেক প্রবাদ প্রতীম ব্যক্তিত্ব পিকে ব্যানার্জির। তাঁর মৃত্যুশোক ভিতর থেকে নাড়িয়ে দিয়েছিল চুনী গোস্বামীকে। করোনা আতঙ্কে প্রিয় বন্ধুর শেষযাত্রায় থাকতে পারেননি। কী আশ্চর্য সমাপতন! পিকের মৃত্যুর এক মাস পরই চলে গেলেন চুনী গোস্বামী। গত কয়েক মাস ধরেই প্রস্টেট ও স্নায়ুর সমস্যায় ভুগছিলেন তিনি। তাঁর মৃত্যু ভারতীয় ফুটবলের অপুরণীয় ক্ষতি, বলছে ময়দান। এবার অমৃতলোকে এক টানটান ডার্বি ম্যাচের প্রতিপক্ষ হবেন দুই তারকা, বলছেন প্রাক্তন সতীর্থরা।
মান্না–পিকে–চুনী। ভারতীয় ফুটবলের তিন মহারথী ছিলেন। মান্না দা অনেক আগেই চলে গেছেন। প্রদীপদাও একমাস আগে মারা যান। আর আজ চলে গেলেন চুনী দা। ভারতীয় ফুটবল সত্যিই অভিভাবকহীন হয়ে পড়ল।
চুনীদার মৃত্যুর খবর শুনে প্রাক্তন ফুটবলার প্রশান্ত ব্যানার্জি বলে উঠলেন, ‘একটা সময় প্রতিদিন রবীন্দ্র সরোবরে চুনীদার সঙ্গে দেখা হত। উনি মর্নিং ওয়াকে যেতেন। আমিও যেতাম। তখন টুকটাক কথা হতো। কিন্তু অসুস্থ হওয়ার পর চুনীদা বড় একটা আসতেন না।’ আরেক প্রাক্তন ফুটবলার সুরজিৎ সেনগুপ্তও চুনীদার মৃত্যুতে শোকজ্ঞাপন করেন।
বড্ড ভালবাসতেন মোহনবাগানকে। কিন্তু লকডাউনের জন্য প্রিয় ক্লাবেও শেষবারের জন্য যাওয়া হল না চুনী গোস্বামীর। আক্ষেপ নিয়েই পরলোকে চলে গেলেন।