জানলার ফাঁসা দিয়ে একফালি ভোরের আলো ঢুকেছে । যেন ওই আলো আমাকে হালকা ভাবে নাড়া দিয়ে বলল, ওঠ । সকাল হয়েছে । আমি আড়ামোড়া ছেড়ে বললাম, এত সকালে ডেকে দিলে ? কত রাত করে যে শুয়েছি তা তোমাকে কী বলব ! উঠে পড়লাম । মনে হচ্ছে খুব শান্ত । নানা রকমের পাখির ডাক শুনতে পাচ্ছি । দরজা খুলে দিতেই অবাক হয়ে গেলাম । দেখছি, বারান্দায় কয়েকটি কাশফুল মেঝেতে শুয়ে আছে ! আশ্চর্য! কে রেখে গেল ! আর এখন তো বৈশাখ মাস ! এখন কি কাশফুল ফোটে ? সে তো আশ্বিনে ! চারদিকে তাকিয়ে কাউকেই দেখতে পাচ্ছি না । কিন্তু আমি বেশ বুঝতে পারলাম যে , কেউ রেখেছে অবশ্যই । হঠাৎ আমাদের ছায়ামাখা আমগাছ তলায় তাকিয়ে চমকে উঠলাম ! অরুণিমা দাঁড়িয়ে আছে । মুখে মুচকি হাসি । দুটো ভুরু নাচিয়ে বলল, কী ব্যাপার ? সে তো আমার জিগ্যেস করার কথা । তুমি _এত_ সকালে ! আর ওই কাশফুল তুমিই রেখেছ ওখানে ? হ্যাঁ তো । কেন ? সে বলব’খন । চোখ মুখে জল দিয়ে , পাঞ্জাবি পায়জামা চাপিয়ে চলো , বের হবো । আরে ! পাগল মেয়ে তো তুমি ! আর কাশফুল পেলে কোত্থেকে ? এখন কি কাশফুল ফোটে ? শোনো , অত কথা বলার সময় নেই । তাড়াতাড়ি করো । হারি আপ । অরুণিমা এরকমই । উঠল বাই তো কটক যাই । এতক্ষণ যেন কথা বলছিলাম একটা ঘোরের মধ্যে দিয়ে । কাশফুল… অরুণিমা… ভোর … এই সব যেন এক অন্য পৃথিবীতে নিয়ে ফেলেছিল আমাকে । এবার দেখি আরো বিস্ময় আমাকে চমকে দিল । ও কী ! অরুণিমা কী পরেছে ! ছোটবেলার মতন গাউন ফ্রক , চুলে দু’বিনুনি । হেসেই চলেছে । ওর হাতেও দেখি কয়েকটি কাশফুল । এ কী অরুণিমা ! তুমি এমন ড্রেসে ! চুল বেঁধেছ ওইভাবে ! আর কাশফুল পেলে কোত্থেকে ? অত কথা বলার সময় নেই । খুঁজতে জানলে সবকিছু পাওয়া যায় । এখন এরকম সাজতে মন হয়েছে । চলো আজ বিশেষ দিন আমাদের । তার মানে ? চলো তো । এরপর ও রেগে যাবেই । ওকে আমি হাড়ে হাড়ে চিনি ।অতএব তৈরি হয়ে ,. কাশফুল ঘরে খাটের ওপর রেখে . মাকে বলে অরুনিমাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম । কোথায় যাব আমরা ? যাব কাশফুলের দেশে । সে কি এখন আছে ? সবই আছে । আমরাই তো ধ্বংস করে দিচ্ছি । চলো অনেক দূরে কোথাও । আমি যেন আমার অরুণিমাকে আজ চিনতে পারছিনা । ও গেয়ে উঠল —- দূরে কোথায় দূরে দূরে … আমার মন বেড়ায় ঘুরে ঘুরে …. গানের মধ্যে ডুবে গিয়েছিলাম আমি । বুঝতেই পারিনি কোথায় , কতদূর চলে এলাম । দেখি —- বিশাল একটা মাঠ …. ধানক্ষেত … দূরে নিজে নিজে জন্মনেওয়া পুকুর , বেশ কিছু কাশফুল তাদের শাদা মাথা নাড়াচ্ছে । যেন ওরা আমাদের অভিবাদন জানিয়ে বলছে , এসেছ ? খুউব ভালো হয়েছে , এসো এসো । পেছন ফিরে তাকাতে দেখি অরুণিমা হাততালি দিতে দিতে দৌড়ে আসছে আমার কাছে । ওর ফ্রক দুলছে । দুলছে বেণী । এসে আমার একটা হাত ধরে বলল , দৌড়াও দৌড়াও … উইই দ্যাখো রেল লাইন । আমাকে ট্রেন দ্যাখাও । আমি কেমন হয়ে পড়লাম ! অরুণিমা কি অন্য কোথাও চলে গিয়েছে ? ও কি একটা উপন্যাসের চরিত্র হয়ে যাচ্ছে ! আমি ওকে কাছে টেনে নিয়ে বললাম , শোনো শোনো , কী দেখতে চাও তুমি ? ও বলল , আমি রেলগাড়ি দেখতে চাই । আমি সবুজ চাই । আমি চাই সরল পৃথিবী । সেখানে তুমি আমাকে নিয়ে যাবে মলয় ? আমি একটা হাত ধরে নিয়ে চুপ করে ওকে দেখতে থাকি । হঠাৎ ট্রেনের হুইসেল … । ও হাততালি দিয়ে উঠলো । শোনো শোনো রেলগাড়ি আসছে । চলো । দৌড়ে চলো । সে সময় আমাদের অনেক দূরে রেখে ইলেকট্রিক ট্রেন ভীমবেগে চলে গেল চারদিক কাঁপিয়ে । কাশফুল মাথা নাড়ালো । ফ্রকপরা অরুণিমা আমার হাত ধরে ট্রেনলাইনের ওইপারের ঘন গাছপালার ওপরের আকাশের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ওখানে কী দেখতে পাচ্ছ ? কেন ? নানা রকম মেঘ !, মেঘের মধ্যে কাউকে দেখতে পাচ্ছ ? হ্যাঁ পাচ্ছি , অনেক বড় একজন মানুষের ছবি । ঠিক বলেছ । উনি সত্যজিৎ রায় । নমস্কার করো ।আমরা দুজনেই মেঘের দিকে তাকিয়ে হাতজোড় করে প্রণাম করলাম । ######### এই ওঠ্ ওঠ্ … আর কত ঘুমিয়ে থাকবি ? বেলা অনেক হয়ে গেছে । মা আমাকে ধাক্কা দিয়ে তুলে দিল, ওই দ্যাখ অরুণিমা এসেছে । কতক্ষণ হয়ে গেল ! আমি তখন একভাবে মা-র মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম ।