দেশের সময় ওয়েবডেস্কঃ শুটিং না করলে ভাত-ডাল জুটবে কী করে?’ আর তিনি বেরিয়ে পড়লেন। ৮৬ বছর বয়সি যুবকটি। তারপর? করোনা। তারপর? তার আর পর নেই। বাংলাকে স্তব্ধ করে দিয়ে বিদায় নিলেন কিংবদন্তী। কোথায় গেল সেই শিশুসুলভ হাসিটি?
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। শেষতম কিংবদন্তী। যাঁকে নিয়ে মানুষের আবেগের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে অধিকারবোধ ও গর্ব। যেভাবে আজও রায়, ঘটক ও কুমারের নাম বাঙালিয়ানার অহংকারের তালিকায় জ্বলজ্বল করছে, তেমনই সৌমিত্রের নামও কোনওদিন মুছবে না এই তালিকা থেকে। দীর্ঘ অভিনয় জীবনে তাঁর অবদান নিয়েই বেঁচে থাকবে বাংলার মানুষ। তা সে প্রথম ছবি ‘অপুর সংসার’ হোক বা শেষ ছবি তাঁর নিজের বায়োপিক ‘অভিযান’ হোক। তাঁর মৃত্যুর পর এই ‘অভিযান’ ছবিটিই বাঙালির চোখে জল এনে দেবে।
১৯৩৫ সালের ১৯ জানুয়ারি। সূর্যসেন স্ট্রিটে জন্ম নিলেন সৌমিত্র। তারপর কৃষ্ণনগরে গিয়ে ঠাকুর্দা ও বাবার কাছ থেকে মঞ্চে ওঠা নামার প্র্যাক্টিস করলেন তিনি। ভালবাসতে শুরু করলেন মঞ্চকে। কলেজে পড়াশোনা করতে করতেই বিখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব অহিন্দ্র চৌধুরীর কাছ থেকে মঞ্চের তালিম নিতে শুরু করেন। কলেজের শেষ সাল। শিশির ভাদুরীর নাটক দেখতে যান তিনি।
সেই তিনি বুঝে গেলেন, মঞ্চ, অভিনয়, আলো, দর্শক, এই তো চাই তাঁর! ভাদুরীর মৃত্যুর আগের মুহূর্ত পর্যন্ত তাঁকে গুরুর পদে বসালেন সৌমিত্র।
অল ইন্ডিয়া রেডিওয়ে চাকরির সুযোগ পান। কিন্তু অভিনয় নিয়ে স্বপ্ন দেখা বন্ধ করেননি তিনি। এমনই এক সময় জীবনের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি ঘটে গেল তাঁর সঙ্গে।
কফি হাউজে যাচ্ছিলেন সৌমিত্র। সেখানেই তাঁকে পাকড়াও করে সত্যজিতের বাড়িতে নিয়ে যান সত্যজিতের সহকারী পরিচালক। সৌমিত্রকে দেখে প্রথম কথাটি ছিল, ‘এবাবা, তুমি তো কলেজের অপুর তুলনায় বয়সে অনেকটাই বড়।’
তারপর থেকে যতবারই তাঁদের দেখা হত, কথা বলতেন সৌমিত্র। চুপ করে শুনতেন সত্যজিৎ। এভাবেই তিনি পরখ করেছিলেন সৌমিত্রকে। সৌমিত্রের ভাষাকে, চালচলনকে। বয়সের কারণে ‘অপরাজিত’ (১৯৫৬)–তে কাজ করতে পারলেন না বটে। কিন্তু ‘অপুর সংসার’ (১৯৫৯) থেকে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের যাত্রা শুরু। সালটা ১৯৫৮। সৌমিত্র গিয়েছেন সত্যজিতের ‘জলসাঘর’ ছবির শুটিং দেখতে।
সেট ছেড়ে বেরোবেন, রায় হাঁক পাড়েন। এর পর যা হয় তার জন্য বোধ হয় প্রস্তুত ছিলেন না সৌমিত্র নিজেও। অভিনেতা ছবি বিশ্বাসের কাছে সৌমিত্রকে পরিচয় করান সত্যজিৎ। ‘এই হল সৌমিত্র। আমার পরবর্তী ছবি অপুর সংসারে ও অপু করছে।’ তৈরি হল নতুন জুটি। সৌমিত্র–মানিকদা। তৈরি হল কিছু মাস্টারপিস। দেবী (১৯৬০), তিন কন্যা (১৯৬১), ‘চারুলতা’ (১৯৬৪), ‘কাপুরুষ’ (১৯৬৫), ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ (১৯৭৮), ‘হীরক রাজার দেশে’ (১৯৮০), ‘সোনার কেল্লা’ (১৯৭৪), ‘ঘরে বাইরে’ (১৯৮৪), ‘অভিযান’ (১৯৬২), ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ (১৯৭০), ‘অশনি সংকেত’ (১৯৭৩), রায়ের সঙ্গে মোট ১৪টি ছবিতে অভিনয় করেন।
তবে কেবলমাত্র এই জুটির মধ্যেই আটকে ছিলেন না সৌমিত্র। সেটা সম্ভবও নয়। বাকি পরিচালকেরা লোভ সংবরণ করবেন কীভাবে? ‘অপুর সংসার’ দেখার পর পরিচালকেরা বুঝে গিয়েছিলেন তিনি একজন ‘অভিনেতা’।
আর তাই মৃণাল সেনের ‘পুনশ্চ’ (১৯৬১), ‘প্রতিনিধি’ (১৯৬৪), ‘আকাশ কুসুম’ (১৯৬৫)। তপন সিন্হার ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ (১৯৬০), ‘ঝিন্দের বন্দী’ (১৯৬১), ‘হাটে বাজারে’ (১৯৬৭)। অসিত সেনের ‘স্বয়ম্বর’ (১৯৬১), ‘স্বরলিপি’ (১৯৬১), ‘আগুন’ (১৯৬২)। অজয় করের ‘অতল জলের আহ্বান’ (১৯৬২), ‘সাত পাঁকে বাঁধা’ ও ‘বর্ণালী’ (১৯৬৩)। অরূপ গুহঠাকুরতার বেনারসি (১৯৬২)। নিত্যানন্দ দত্তের ‘বাক্স বদল’ (১৯৬৫)। তরুণ মজুমদারের ‘একটুকু বাসা’ (১৯৬৫), ‘গণদেবতা’ (১৯৭৯)। আশুতোষ বন্দোপাধ্যায়ের ‘তিন ভুবনের পারে’ (১৯৬৯)। দিনেন গুপ্তের ‘বসন্ত বিলাপ’ (১৯৭৩)। সরজ দের ‘কোণি’ (১৯৮৪)। অপর্ণা সেনের ‘পারমিতার একদিন’ (২০০০)। অভিজিত চৌধুরির ‘পাতালঘর’ (২০০৩)। প্রভাত রায়ের ‘লাঠি’ (১৯৯৬)। অতনু ঘোষের ‘অংশুমানের ছবি’ (২০০৯), ‘ময়ুরাক্ষী’ (২০১৭)। গৌতম ঘোষের ‘শূন্য অংক’ (২০১৩)। শিবপ্রসাদ মুখার্জি ও নন্দিতা রায়ের ‘বেলাশেষে’ (২০১৫)। লীনা গঙ্গোপাধ্যায় ও শৈবাল চ্যাটার্জির ‘সাঁঝবাতি’ (২০১৯)... এ তালিকা শেষ হওয়ার নয়।
বলতে গেলেই যদি হাঁফিয়ে যেতে হয়, তাহলে সেই অভিনেতার কী অবস্থা হয়েছিল? কারণ শুধু ক্যামেরার জগতেই তো তিনি থেমে থাকেননি। তাঁর প্রথম প্রেমকে তিনি কোনওদিন ছেড়ে পালিয়ে আসেননি। আর সেটা হল মঞ্চ। শুরুতেই বলেছিলাম, মঞ্চ, অভিনয়, আলো, দর্শক, এসব তাঁর খুব নিজের। যতই পার্কে মর্নিং ওয়াকে বেরোন না কেন, নিজের বাগানে নিজের হাতে লাগানো গাছগুলোর আশপাশ দিয়ে ঘুরতে বেশি ভাল লাগে না? তেমনটাই হয়েছিল সৌমিত্রের।
হাতে খড়ি শুরু হয়েছিল শিশির ভাদুরী ও অহিন্দ্র চ্যাটার্জির সঙ্গে। অভিনয় করেছেন অসংখ্য নাটকে। ‘তাপসী’ (১৯৬৩), ‘নামজীবন’ (১৯৭৮), ‘রাজকুমার’ (১৯৮৩), ‘ফেরা’ (১৯৮৭), ‘নীলকন্ঠ’ (১৯৮৮), ‘ঘটক বিদায়’ (১৯৯০), ‘দর্পণে শরৎশশী’ (১৯৯২), ‘চন্দনপুরের চোর’ (১৯৯৪), ‘টিকটিকি’ (১৯৯৫), ‘প্রাণতপস্যা’ (১৯৯৮), ইত্যাদি।
এরকম একটা মানুষের হাত যে পুরস্কারে ভরা থাকবে তা তো জানাই কথা। ২০০৪ সালে পদ্মভূষণ, ২০১২ সালে দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার, ২০১৭ সালে ফ্রান্স সরকারের কাছ থেকে লিজিওন অফ অনার পেয়েছিলেন তিনি। এছাড়া পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁকে ২০১৭ সালে বঙ্গবিভূষণ পুরস্কার দেয়। ২০১৩ সালে তিনি একবার এই পুরস্কারটি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।
তিনি সবার প্রিয় ‘অপু’। শমনের কাছে পরাজিত হলেও তিনি মানুষের মনে সদা ‘অপরাজিত’। সেই সৌমিত্র চ্যাটার্জিকে গান স্যালুটে শেষ শ্রদ্ধা জানাবে রাজ্য সরকার। তারপর হবে অভিনেতার শেষকৃত্য। রবিবার বেলভিউ নার্সিংহোম চত্বরে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে এই ঘোষণা করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মমতা বলেন, ‘মহানায়কই শুধু নয়, চলচ্চিত্র জগতের এক মহা প্রতিভাবান বরণীয়, স্মরণীয় মানু্ষ। গণ আন্দোলনেরও নায়ক সৌমিত্রদা। কোভিড কিন্তু তাঁর কাছে হেরে গিয়েছিল। কিন্তু আমরা তাঁকে ধরে রাখতে পারিনি। সৌমিত্রদার মৃত্যু বেদনাদায়ক। বিশ্ববাংলার আজ এক দুঃখের দিন।’
এদিন দুপুর একটা নাগাদ বেলভিউ নার্সিংহোমে পৌঁছন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার আগেই সেখানে চলে গিয়েছিলেন মুখ্যসচিব আলাপন ব্যানার্জি এবং পুলিশ কমিশনার। পৌঁছন রাজ্যের নেতা, মন্ত্রীরা। নার্সিংহোমে পৌঁছে সৌমিত্রের মেয়ে পৌলমীকে সমবেদনা জানান মুখ্যমন্ত্রী।
তারপর তাঁদের মধ্যে সৌমিত্রের চিকিৎসা এবং শেষকৃত্যের অনুষ্ঠান নিয়ে আলোচনা হয়। তারপর বাইরে বেরিয়ে পৌলমী সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে প্রথমে রাজ্য সরকার এবং মুখ্যমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন তাঁদের বাবার চিকিৎসায় সবরকম সাহায্যের জন্য৷
তারপর পৌলমী বলেন, সৌমিত্রের মরদেহ নিয়ে প্রথমে তাঁদের গল্ফ গ্রিনের সৌমিত্রের স্ত্রী এবং দীর্ঘদিনের জীবনসঙ্গী দীপা চ্যাটার্জির কাছে নিয়ে যাওয়া হবে। তারপর টেকনিশিয়ান্স স্টুডিওয় টলিউডের শিল্পী, কলাকুশলীদের শ্রদ্ধা জানানোর জন্য কিছুক্ষণ রাখা হবে। তারপর রবীন্দ্র সদনে আনা হবে মরদেহ। সেখান থেকেই বিকেল ৫.৩০টা নাগাদ সৌমিত্রের মরদেহ কেওড়াতলা মহাশ্মশানে নিয়ে যাওয়া হবে এদিনই শেষকৃত্যের জন্য।তাঁর বাবার অসংখ্য গুণগ্রাহীদের কাছে পৌলমী অনুরোধ করেন, তাঁরা যেন তাঁর বাবার ‘জীবনকে সেলিব্রেট করেন’।