‘সেই কালজয়ী কন্ঠস্বর আজও বাঙালির মনে আগমনীর বার্তা বয়ে আনে’ : দেখুন ভিডিও

0
2
অর্পিতা দে, দেশের সময়

কলকাতা : এন আর আই হোক কিংবা কর্মসূত্রে বাংলার বাইরে, জেনারেশন জেড নামে পরিচিত হলেও, আপামর বাঙালির রন্ধ্রে রন্ধ্রে আজও সমানভাবে জড়িয়ে আছে তাঁর কন্ঠস্বর; সে হালের এফ এম কিংবা ইউটিউবেই হোক, অনেকে আবার সরাসরি বেতারে শুনবে বলে ধুলো পড়া রেডিওটাও সারাই করিয়ে নেয় মহালয়ার আগের দিন, যাঁর কন্ঠে ‘আশ্বিনের শারদ প্রাতে বেজে উঠেছে যে আলোকমঞ্জি…’ না শুনলে আজও বাঙালির মনে আগমনীর আনন্দবার্তা যেন সম্পূর্ণতা পায় না; প্রকৃতিতে শিউলির কমলা বোঁটায়, পাপড়িতে শিশির বিন্দু আর দিগন্ত বিস্তৃত মাঠে কাশের ঢেউ যে শারদীয় বার্তা বয়ে আনে তা সম্পন্ন হয় মহালয়ার ভোরে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের গলায় আকাশবাণীর সম্প্রচারিত প্রভাতী অনুষ্ঠান ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’র প্রচারের মধ্যে দিয়েই।

উত্তর কলকাতার শ্যামপুকুর স্ট্রীটের বীরেন্দ্র মঞ্চকে ঘিরে, ৭ নম্বর রামধন মিত্র লেনের প্রকাণ্ড হলুদ বাড়িটার আদলেই তৈরি হচ্ছে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের বাড়ি, তাঁর তেতলার রাস্তার দিকের ঘর আজ সম্পূর্ণ বদলে গেছে। এই ঘরেই থাকতেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। এক সময় বহু বিশিষ্ট ব্যক্তির আনাগোনা ছিল তাঁর বাড়িতেই।
উত্তর কলিকাতা সার্বজনীন দুর্গোৎসব তাদের এবারের পুজোর থিম হিসেবে বেছে নিয়েছে সেই বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রকেই। দেখুন ভিডিও

পুজোর অন্যতম উদ্যোক্তা শুভাশিস চক্রবর্তী দেশের সময়কে জানালেন, “মহালয়ার ভোরে সবার প্রিয় যে মানুষটার গলা না শুনলে আজও যে বাঙালির দুর্গাপুজো সম্পন্ন হয় না, সেই বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রকে তাদের পুজোর থিম হিসেবে বেছে নেওয়ার কারণ আগামী প্রজন্মও যেন এই মানুষটিকে, তাঁর মাহাত্ম্যকে মনে রাখে। মাত্র ১২ বছর বয়সেই যিনি মুখস্থ করেছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্তের বীরাঙ্গনা কাব্য।

তিনি রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে অনুষ্ঠান করতে গিয়ে গড়গড় করে চণ্ডীর মন্ত্রোচ্চারণ করতে পারতেন। তাঁকে সকলে শ্রুতিধর বলে চিনতেন। যে কোনও লেখা একবার পড়লেই তাঁর অনেকটা মুখস্থ হয়ে যেত। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র মূর্তিপুজোর ঘোর বিরোধী ছিলেন। তাই তাঁদের বাড়িতে পুজোর চলও তেমন ছিল না। তিনি বিশ্বাস করতেন কোনও এক সর্বশক্তিমান ঈশ্বরকে। তিনি নিজের কাজকেই ঈশ্বর বলে মনে করতেন”।

সেই বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের নিজের নাতি সায়ম ভদ্র ভাগ করে নিলেন তার কিছু স্মৃতি কথা।
‘আমার দাদুর স্পষ্ট সংস্কৃত উচ্চারণ ছিল একেবারেই সহজাত এবং বংশগত। দাদুর বড় মেয়ে বিবাহিত ছিলেন না। আমি আর বড়পিসি রাত্রে দিদার ঘরেই ঘুমাতাম। বড়পিসি মেঝেতে শুতেন। ঐ ঘরেই একটা বড় ট্রানজিস্টার রেডিও ছিল; দাদু থাকতেন পাশের ঘরে কারণ রাত জেগে তিনি অনেক পড়াশুনা লেখালিখি করতেন। মহালয়ার আগেরদিনও তার কোনও অন্যথা ঘটত না। মহালয়ার দিন অনেক ভোরে ঘুম থেকে উঠে পড়তাম। দাদু পাশের ঘরেই থাকতেন; দিদার ঘরের ট্রানজিস্টারেই মহিষাসুরমর্দ্দিনী চলত। দাদু নিজের ঘর থেকেই শুনতেন। মহিষাসুরমর্দ্দিনী সম্প্রচারের সময় আমি চলে যেতাম দাদুর ঘরে। দাদু দু’চোখ বুজে থাকতেন। মনে পড়ে, দাদুর পাশে বসে যখন মহিষাসুরমর্দ্দিনী শুনতাম, দাদুর মুখের দিকে আমি চেয়ে বসে থাকতাম। স্তোত্র পাঠের কিছু কিছু সময় যেখানে যেখানে দাদুর গলা ভারী হয়ে আসত কিংবা স্তোত্রে যখন দাদু মা দুর্গার রূপের বর্ণনা করছেন, আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতাম দাদুর মুখের দিকে। চেয়ে দেখতাম দাদু দু’চোখ বন্ধ করে আছেন, কেমন চোখ বন্ধ অবস্থাতেই অঝোরে কাঁদছেন। দাদুকে একবার জিজ্ঞাসা করেছিলাম এই বিষয়ে; তিনি বলেছিলেন মহিষাসুরমর্দ্দিনীর স্তোত্র পাঠের সময় তিনি স্বয়ং মা দুর্গাকে নিজের চোখের সামনে দেখতে পান। মহিষাসুরমর্দ্দিনীর সেই রূপের ছটা নিজের চোখের সামনে দেখেই তাঁর দু’চোখ বয়ে ঐভাবে জল গড়িয়ে আসে।’

‘দাদু মারা গিয়েছেন ১৯৯১ সালে। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর এত বছর পরে, আজও মহালয়ার ভোরে ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’র এই অনষ্ঠান ঘিরে যে উন্মাদনা তাতে এতোটুকুও ভাটা পড়ে নি। বরং ভালো লাগে বাঙালির মনে দাদুর মতন মানুষ এবং তাঁর এই কালজয়ী সৃষ্টি আজও আগমনীর বার্তা বয়ে আনে; এক কালের শ্রুতিধর শেষ বয়সে এসে অ্যালঝাইমার্স রোগে ভুলেছিলেন সবকিছু। আকাশবাণীও মনে রাখেনি তাঁকে; অভিমানে ফিরিয়েছিলেন পদ্মশ্রীর ফর্মও।’ জানালেন সায়ম ভদ্র।

উত্তর কলিকাতা সার্বজনীন দুর্গোৎসব কমিটির শিল্পী শম্ভূ সাহা দেশের সময়কে জানালেন, “আজও মহালয়ার পুণ্যলগ্নে বাঙালির কানে যে আলেখ্যটি পৌঁছায়, সেটি বিগত বেশ কয়েকবছরের সংকলন। প্রায় চারবার রেকর্ডের পর অনেক গান, সুর, স্তোত্র পরিমার্জিত হয়ে আজকের এই রূপে এসেছে ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’। মহালয়ার ভোরে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের মহিষাসুরমর্দ্দিনী স্তোত্র পাঠের মধ্যে দিয়ে যে আবহ তৈরি হয় তা মানুষের মনে এবং যেন প্রকৃতির মধ্যেও ধরা পড়ে। সেই আবহকেই মানুষের কাছে তুলে ধরাই এই থিমের মূল উদ্দেশ্য’।

‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’কে এই উচ্চতায় পৌঁছানোর পিছনে যাঁদের অবদান কম নয় তাঁরা হলেন বাণীকুমার এবং পঙ্কজকুমার মল্লিক। বাণীকুমার কালজয়ী একটি আলেখ্য লিখে মূল কাঠামো দিয়েছিলেন এই আলেখ্যকে। সুরমাধুর্য তৈরি করে তাকে অবয়ব দিয়েছিলেন পঙ্কজকুমার মল্লিক। স্তোত্রপাঠ ও গানের মাধ্যমে তাকে প্রাণ দিয়েছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র এবং অন্যান্য শিল্পীরা। বাণীকুমার, পঙ্কজকুমার মল্লিক এবং বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র এই তিন শিল্পীর ভাবনা একত্রিত না হলে ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’ কিছুতেই কালজয়ী হয়ে উঠতে পারত না।

আট দশকের বেশি সময় ধরে ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’ মানুষের হৃদয় গহীনে থেকে যাওয়া একটি ‘কালোত্তীর্ণ’ সৃষ্টি। যত খারাপ সময়ই আসুক না কেন, এই দেড় ঘন্টার গীতি আলেখ্যটি দশকের পর দশক ধরে বাঙালি মননে বছরের পর বছর ধরে আগমনীর সুর বাজিয়ে জানান দেয় ‘মা আসছে’।

Previous articleWeather Update পুজোর শপিং-প্ল্যান পন্ড হতে পারে বৃষ্টিতে! ফের দুর্যোগের পূর্বাভাস

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here