রেন – ট্রিতে মা’কে খুঁজছে পাখির দল

0
1241

পার্থ সারথি নন্দী,বনগাঁ: গত ২০,০৫, ২০২০ রাত সওয়া ন’টা নাগাদ আমপানের তাণ্ডব চলার মধ্যেই নবান্নের কন্ট্রোল রুমে বসে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গভীর উদ্বেগের সঙ্গে জানালেন, এই ঘূর্ণিঝড়ে “সব সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে। দু’ই চব্বিশ পরগনা পুরো ধ্বংস হয়ে গিয়েছে।

সেদিনের দুর্যোগের রাত কাটিয়ে সকালের আলো ফুটতেই প্রকৃতির নির্মম রুপ প্রমাণ দিতে শুরু করল মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই রাতের গভীর উদ্বেগের কথা কতটা সত্যি ছিল। চোখের সামনে ভেসে উঠল বিপুল ক্ষয়ক্ষতির দৃশ্য৷

যতো দূর চোখ যায় যশোর রোড় জুড়ে (৩৫ নম্বর জাতীয় সড়ক ) পড়ে আছে সবুজের নিথর দেহ৷ দেখে মনে হলো রাতের অন্ধকারে কালো পীচের রাস্তাটা কেউ এসে সবুজ চাদরে ঢেকে দিয়ে গেছে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গাছের ডালে এখনও পাখীদের বাসার চিহ্ন রয়েগেছে৷ খোঁজ নেই অজস্র পাখীদেরও। কোন ক্রমে দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলোর মাথার দিকে তাকালে মনে হচ্ছে আকাশটা বড় হয়ে গেছে৷ আসলে বেঁচে থাকা গাছগুলোর ডালপালা ছেঁটে দিয়ে গেছে আমপান৷তাই হঠাৎ করে চিনতে অসুবিধা হচ্ছে সকলের প্রিয় পরিচিত যশোর রোডের প্রাচীন শিরীষ গাছগুলিকে ( ‘রেন-ট্রি’ নামে পরিচিত)। 

অতীতে যশোর রোডের এই প্রাচীন গাছগুলিকে ‘হেরিটেজ’ ঘোষণার দাবি তুলেছিলেন পরিবেশ প্রেমীরা। তাঁদের মধ্যে বেশির ভাগ মানুষ ছিলেন বনগাঁ শহরের বাসিন্দা।যেমন বিভাস রায়চৌধুরী,দেবাশিস রায় চৌধুরী,মলয় গোস্বামী, স্বপন চক্রবর্তী, মলয় ঘটক, শ্যাম রায় দের মতো বিশিষ্ট কবি সাহিত্যিকেরা৷তাঁরা পথে নেমে আন্দলোন করেন দিনের পর দিন। তাঁদের দাবি ছিল একটাই, যশোর রোড সম্প্রসারণ করতে হবে কিন্তু এই প্রাচীন গাছগুলিকে বাঁচিয়ে৷ মামলা গড়ায় সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত৷

আমপান পরবর্তী যশোর রোডে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা গাছের চেহারা দেখে ভেঙে পড়েছেন পরিবেশপ্রেমীরা। রাস্তার দু’ধারে ছিন্নভিন্ন ভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে প্রায় ৩০০ বছরের প্রাচীন গাছগুলি।পরিবেশপ্রেমীরা ফের বৃক্ষরোপণের ডাক দিয়েছেন । এই বিষয় নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াতেও জোড় চর্চা শুরু হয়েছে। বনগাঁর একদল তরুণ- তরুণী বনগাঁবাসিদের উদ্দেশ্যে লিখেছেন, ‘‘ সকলকে আহ্বান জানাই আসুন নতুন করে গাছ লাগাই,সবুজের জন্য লড়াই করতে হবে। ভুলে গেলে চলবে না,এই গাছগুলিই আমাদের প্রাণরক্ষা করেছে।’’ আবার , পাল্টা পোস্টে লেখা হয়েছে, ‘‘প্রাচীন গাছগুলি নিয়ে আন্দোলন করে শহরের মধ্যে উড়ালপুল তৈরি রুখে দিয়ে যানজটে মানুষকে অবরুদ্ধ করে জীবনযাত্রার গতি কমিয়ে কী পেলাম ? সেই তো ঝড়ে মুখ থুবড়ে পড়ল মৃত প্রায় গাছগুলি। অকারণে উন্নয়নটা আটকে গেল।’’ 

পরিবেশপ্রেমী কবি বিভাস রায়চৌধুরী বলেন, ‘‘শতবর্ষ প্রাচীন গাছগুলি ধ্বংস হয়েছে দেখে মন ব্যথায় ভরে আছে। বেআইনি ভাবে যখন কাটা হচ্ছিল, তখনও কষ্ট পেয়ে অন্যদের সঙ্গে এই গাছ রক্ষার জন্য পথে নেমেছিলাম। পরিবেশের উপরে এর যথেষ্ঠ প্রভাব পড়বেই।’’ 

বনগাঁ মহকুমা পুলিশ আধিকারিক অশেষ বিক্রম দোস্তিদার বলেন প্রায় একবছর কর্মসূত্রে এখানে রয়েছি কখনো চাঁদের আলোয় কখনোবা অন্ধকারে টর্চ জ্বেলে, আবার সকালের ঝলমলে রোদে দেখেছি এই প্রাচীন গাছগুলিকে আর তাতে বাসা বেঁধে আছে দেশি বিদেশি বিভিন্ন পাখিরা৷ সখের ক্যামেরায় তাঁদের ছবি ফ্রেম বন্দি করেছি আবার পাখিধরাদেরকেও থানায় বন্দি করেছি ৷ কাজের সুবাদে পাখিদের জন্য গাছগুলো আমার পরম আত্মীয় হয়েগেছে।কিন্তু আমপানে বিধ্বস্ত গাছগুলির দিকে এখন তাকালে চোখে জল এসে যাচ্ছে।পাখিদের এতো বড় আশ্রয়স্থলটা এখন যেন কষ্কালপুরী।

ঈগল,ইন্ডিয়ান প্যারাডাইস ফ্লাই ক্যাচার, ঝড়ের সময় ওদের বাচ্চাদেরকে ডানা দিয়ে আগলে রাখার সময় ঝড়ের দাপটে দুটো ডানাই ভেঙে গেছে ,ওদেরকে আলিপুর চিড়িয়াখানা হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য পাঠিয়েছি৷ এদিকে দুধরাজ তার তিনটে বাচ্চা সমেত তাদের মাও বাসা খুঁজে বেড়াচ্ছে যশোর রোড ধরে প্রাচীন গাছ গুলোর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত৷

প্রসঙ্গত প্রায় বছর তিনেক আগে যশোর রোড সম্প্রসারণের জন্য বনগাঁ ,হাবড়া,অশোকনগর, এবং বারাসাত এই পাঁচটি শহরের মধ্যে দিয়ে উড়ালপুল তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কেন্দ্র সরকার। সমীক্ষায় জানানো হয়েছিল যশোর রোডের ধারের গাছ কাটা প্রয়োজন। সেই মতো বনগাঁয় গাছ কাটার কাজও শুরু হযেছিল। এরপরেই গাছ বাঁচিয়ে সড়ক সম্প্রসারণের দাবিতে সরব হন পরিবেশ প্রেমীরা। যশোর রোডে নেমে নাটক-কবিতা-গান, মূকাভিনয়, মোমবাতি জ্বেলে মিছিলের মাধ্যমে তাঁরা গাছ বাঁচানো আর্জি জানান সরকারের কাছে। এবং গাছ বাঁচানোর দাবি জানিয়ে আদালতের দ্বারস্থ হয়, একটি মানবাধিকার সংগঠন। বিষয়টি এখনও শীর্ষ আদালতে বিচারধীন।

ঝড়ের দশদিন পরে যশোর রোডে গিয়ে দেখা গেল বহু গাছ ভেঙে  মাথা নীচু করে মাটিতে শুয়ে আছে। কিছু গাছ ডালপালা খুইয়ে কঙ্কালের মতো দাঁড়িয়ে আছে। যত দূর চোখ যাচ্ছে শুধুই সবুজের নিথর দেহ পড়ে আছে। বনগাঁর বাসিন্দারা জানান যশোর রোডের কয়েকশো বছরের প্রাচীন এই গাছগুলি তাঁদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতীক। অনেকে যেমন পাহাড় , সমুদ্র,নদী দেখতে যায় অন্যত্র, তেমনি বহু দেশি বিদেশি পর্যটক আসেন বনগাঁয় শুধু মাত্র এই সবুজ বিশাল গাছ দেখতে।

পরিবেশপ্রেমীদের কথায়, গাছ ভেঙে পড়ায় এলাকার বাস্তুতন্ত্র ও পরিবেশের উপরে তার প্রভাব পড়বে বলে মনে করা হচ্ছে। প্রাচীন ওই গাছগুলিতে দেশি-বিদেশি পাখিরা এসে ভিড় করত। খেতের পোকা-মাকড় খেয়ে পাখিরা ফসল রক্ষা করত। এই ক্ষতি অপূরণীয় বলে মনে করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। 

Previous articleলকডাউন ৫ : চলবে ৩০ জুন পর্যন্ত, কনটেনমেন্ট জোন ছাড়া ধাপে ধাপে অানলক! ৮ জুন থেকে ধর্মস্থান, শপিংমল রেস্তোরাঁ খুলে যাবে
Next articleদেশের সময়/Desher Samay

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here