দেশের সময় ওয়েবডেস্কঃ দিল্লির দিকে তাকিয়ে কদিন আগেই ব্রিগেড সমাবেশ হলো। তার দু’মাস আগে থেকে জেলায় জেলায় কত মিটিং, মিছিল। অথচ সেই তৃণমূলকেই ভোটের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে দিদিকে বলতে হল, “আরে আগের মতন একটু জাগুন তো! এই বাঁ দিকে কোনও রেসপন্স নেই কেন ।আবার কখনও বা বেহালার নেতাদের বললেন,কী হলো ভয় পাচ্ছেন, নাকি দুর্বল হচ্ছেন? তা হলে বলে দিন খোলাখুলি আলোচনা হয়ে যাক।”
দিল্লির দিকে তাকিয়ে কদিন আগেই ব্রিগেড সমাবেশ হলো। তার দু’মাস আগে থেকে জেলায় জেলায় কত মিটিং, মিছিল। অথচ সেই তৃণমূলকেই ভোটের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে দিদিকে বলতে হল, আরে আগের মতন একটু জাগুন তো! এই বাঁ দিকে কোনও রেসপন্স নেই কেন। আবার কখনও বা বেহালার নেতাদের বললেন,কী হলো ভয় পাচ্ছেন, নাকি দুর্বল হচ্ছেন? তা হলে বলে দিন খোলাখুলি আলোচনা হয়ে যাক।যে কোন দিন লোকসভা ভোটের নির্ঘন্ট ,ঘোষণা করে দিতে পারে জাতীয় নির্বাচন কমিশন। তার আগে সোমবার তৃণমূলের প্রাক-নির্বাচন শেষ কোর কমিটির বৈঠক ডেকেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বস্তুত ভোটের আগে এমনতর মিটিং ডেকে ভোকাল টনিক দেওয়া সব রাজনৈতিক দলেই দস্তুর। তবে দলকে চাঙ্গা রাখতে গিয়ে দিদি এ দিন যা যা বললেন ,তা রাজনৈতিক ভাবে তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা।
নজরুল মঞ্চের সভায় দাঁড়িয়ে এ দিন এ কথা সে কথার পরই সোজা চলে আসেন বিজেপি-র প্রসঙ্গে। বলেন, ভোট এসে গেছে। এজেন্সি দিয়ে ভয় দেখানোও শুরু হয়ে গিয়েছে। কী ভয়ানক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। আর কতগুলো গদ্দার রয়েছে। কেমন করে ফোন করে সব বলছে, চলে আসুন, কত টাকা লাগবে? টাকা দিয়ে সব কিনে নিতে চাইছে৷
তৃণমূলের নেতারাই বলছেন, গদ্দার বলতে একদা দলের সেকেন্ড ম্যান তথা অধুনা বিজেপি নেতা মুকুল রায়ের কথাই বোঝাতে চেয়েছেন মমতা। বলতে চেয়েছেন, টাকার ঝুলি নিয়ে তৃণমূল ভাঙাতে নেমেছে বিজেপি। কিন্তু এ কথা বলার পরক্ষণেই কার্যত হুঁশিয়ারির সুরে মমতা বলেন, টাকার লোভে যাবে তো! যাক! কিন্তু আজকে বিজেপি-র কোলে উঠে বাঁচছ, আগামীকাল বাঁচবে তো ।এতো সস্তা নয় সব।অনেকের মতে, যেটা বলতে চাইলেন অথচ বললেন না দিদি, তা হল, লোকসভা ভোটের পরেও বাংলায় তৃণমূলই কিন্তু সরকারে থাকবে। তখন বিজেপি বাঁচাবে তো।
মমতা এ দিন বলেন, ওরা ইভিএম এবং ভিভি প্যাট ম্যানিপুলেট করার চেষ্টা করবে। সেই সঙ্গে দিদির অভিযোগ, আমাদের কাছে খবর আছে ওরা শুধু বাংলার জন্যই একটি সংস্থাকে এ সব করার জন্য ঠিক করেছে। এর পরেই দলীয় নেতাকর্মীদের উদ্দেশে মমতা বলেন, “ওই যে বলছে না বাইশটা পাব, চব্বিশটা পাব, এই জন্যই বলছে। পাওয়াবো ভাল করে৷
নজরুল মঞ্চ থেকেই নেতাদের সতর্ক করে দিয়ে তৃণমূলনেত্রী বলেন, কাউন্টিং-এ তাঁদের পাঠান, যাঁরা শুধু ইভিএম নয়, ভিভি প্যাটের বিষয়টা বোঝেন। বক্তৃতা দিতে দিতেই দিদি এ ব্যাপারে দলীয় নেতাদের ট্রেনিং-এর জন্য একটি কমিটি গড়ে দেন। তিন সদস্যের ওই কমিটিতে থাকবেন দীনেশ ত্রিবেদী, সৌগত রায় এবং পার্থ চট্টোপাধ্যায়। জেলা নেতাদের উদ্দেশে মমতা বলেন, বিকেল তিনটে থেকে পাঁচটা পর্যন্ত এঁরা তৃণমূল ভবনে থাকবেন। জেলা সভাপতিরা এসে যেন ট্রেনিং নিয়ে যান।
নিঃসন্দেহে ভোটের আগে এমন আশঙ্কা এবং অভিযোগ তোলা মানে তা গিয়ে ধাক্কা মারবে নয়াদিল্লির জাতীয় নির্বাচন কমিশনের দফতরেও। কারণ লোকসভা ভোট করাবে জাতীয় নির্বাচন কমিশনই। প্রসঙ্গত, গুজরাতের বিধানসভা নির্বাচনে অল্প ব্যবধানে বিজেপি-র জয়ের পর ইভিএম কারচুপি নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন দিদি। এ দিন ফের একবার সেই কথাই বললেন। তবে আগের থেকে অনেক জোরালো ভাষায় ও ভঙ্গিতে।
বিজেপি এ বার পাখির চোখ করেছে বাংলাকে। ২৩,২৪টি আসনের টার্গেটের কথা ক’দিন আগে পর্যন্ত বললেও গেরুয়া শিবির এখন আরও বড় স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। শনিবার একটি সর্বভারতীয় হিন্দি চ্যানেলের অনুষ্ঠানে বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ বলেছেন, বাংলা থেকে এ বার ৩০ জন বিজেপি-র সাংসদ পার্লামেন্টে যাবেন।
অতীতে বাম জমানাতেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একাধিকবার সায়েন্টিফিক রিগিং-এর অভিযোগ তুলেছেন। কিন্তু সে সময় যা বলতেন সবই ভোটের ফল ঘোষণার পর। এ বার ভোটের নির্ঘণ্ট ঘোষণার আগেই মমতার এই অভিযোগকে তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে করছে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের অনেকে।
বিজেপি অবশ্য মমতার এই বক্তব্যের অন্য ব্যাখ্যা করছে। একদা তৃণমূলের সেকেন্ড ম্যান তথা আজকের বিজেপি নেতা মুকুল রায় বলেন, মমতা ভয় পেয়েছেন। তাই এ সব বলছেন। ফলপ্রকাশের পর যখন বিজেপি-র আসন সত্যি সত্যিই ওই জায়গায় যাবে, তখন উনি বলবেন, আগেই তো বলেছিলাম ওরা কারচুপি করবে। তাই এত আগে থেকেই কাঁদুনিটা গেয়ে রাখলেন।
দলের নেতা, পদাধিকারীদের উদ্দেশে মমতা আরও বলেন, এই ভোটটা এমপি-দের। কিন্তু তা বলে আমার ভোট নয় ভেবে কেউ যেন হাত গুটিয়ে না থাকেন। প্রার্থী হবেন এক জন, কিন্তু আমরা লড়ব সবাই। যেমন বিধাননসভা ভোটে সবাই লড়ি, পঞ্চায়েত ভোটে সবাই মিলে লড়ি, তেমনই। এখানেই না থেমে দিদি আরও বলেন, আর কদিনের মধ্যে ভোট ঘোষণা হবে। তার পর চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকাও ঘোষণা হয়ে যাবে। কিন্তু কে প্রার্থী হলেন, কে হতে পারলেন না তা নিয়ে আর কোনও কথা যেন না হয়। তাঁর কথায়, যাঁরা ভাল কাজ করেছেন, তাঁরা থাকবেনই। তবে যাঁরা টিকিট পাবেন না তাঁদের সম্মান ও মর্যাদা দিয়ে দল কাজে লাগাবে।
মমতার এই মন্তব্য থেকেও অনেকে আন্দাজ করছেন যে চোদ্দর ভোটের তুলনায় তৃণমূলের এ বার প্রার্থী তালিকায় বেশ কিছু বদলের সম্ভাবনা রয়েছে। সম্ভবত তারই ইঙ্গিত দিয়ে রাখলেন মমতা।
তবে পর্যবেক্ষকদের মতে, এ দিনের সভা থেকে দৃশ্যত দুটো ছবি পরিষ্কার। এক, কোথায় যেন তৃণমূলের উন্মাদনায় ভাঁটা পড়েছে। হতে পারে অতিরিক্ত মিটিং মিছিল করে অনেকেই হাঁফিয়ে গিয়েছেন। বা এও হতে পারে বিজেপি-কে বিপদ বলে অনেকেই বুঝতে পারছেন না। কেন না, তৃণমূলের মতাদর্শ বলে আজকাল স্পষ্ট কিছু নেই। অতীতে যদি কোনও মতাদর্শ থেকে থাকে, তা ছিল সিপিএম-বিরোধিতা। বামেদের লাল শালু দেখলেই তৃণমূল কর্মীদের রক্ত গরম হত। রাজনীতির জমিতে এখন সিপিএমের বিশেষ দেখা নেই। তৃণমূলেরও সেই তেজ যেন নিখোঁজ। হয়তো সেই কারণেই তাঁদের আগের মতো জাগতে বলতে হচ্ছে দিদিকে।
দ্বিতীয়ত, দিদির মনে হয়তো আশঙ্কা রয়েছে, ভোটের আগে প্রলোভনের ফাঁদে অনেকেই পা দিতে পারেন। তা ছাড়া দলের বহু সাংসদ যে হেতু নিজের নির্বাচন কেন্দ্রেই স্থানীয় সংগঠনের থেকে বিচ্ছিন্ন, তাই এই আশঙ্কাও রয়েছে, নিচু তলার সব নেতা ভোটে লড়াইয়ের জন্য ঝাঁপাবে কিনা।
এ ব্যাপারে প্রাক্তন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী এ দিন বলেন, দিদি এক সময় টাকা দিয়ে, পুলিশ দিয়ে, প্রশাসন দিয়ে বিরোধী দল ভাঙিয়ে তৃণমূলে লোক বাড়িয়েছেন। সেই নেতা আরও বড় টাকার অফার পেলে তো দল ছাড়তেই পারে। মতাদর্শহীন কোনও দলের এটাই অবধারিত পরিণতি। হুমকি, হুঁশিয়ারি দিয়েও তা কত দিন ঠেকাবেন তিনি৷
এককথায় কেন্দ্র থেকে মোদি সরকারকে উৎখাত করতে বাংলায় ৪২টি আসনেই জিততে হবে। নজরুল মঞ্চে কোর কমিটির বৈঠকে দলীয় কর্মীদের সেই বার্তাই দিলেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।