ভারতবর্ষের ইতিহাসে তৃণমূল ছাড়া এমন কোন রাজনৈতিক দল নেই যা তৈরি হয়েছে একেবারে নিচুতলা থেকে। গড়ে উঠেছে লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে, বৃদ্ধি পেয়েছে একের পর এক প্রতিকূলতার মোকাবিলা করে। জননেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একক প্রচেষ্টায় গড়ে তুলেছিলেন এই দল। আমি দেশের সব রাজনৈতিক দলগুলির ইতিহাস মাথায় রেখেই কথাগুলি বললাম। গত কিছুদিন ধরে লক্ষ্য করছি, দলের একশ্রেণীর সুবিধাবাদী নেতা ভোটের মুখে তাঁর বিরুদ্ধে নানারকম বিষোদ্গার করে বিজেপিতে যোগ দিচ্ছেন।
আমি জানি, তৃণমূল নামে দলটি এবং তার নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় না থাকলে এই মানুষগুলির পরিচিতি দূরে থাক, কোন রাজনৈতিক অস্তিত্বই থাকতো না। পরজীবী এই মানুষগুলির মুখে দিদির সমালোচনা শুনে আমার অবাক লাগে। মন্ত্রী, সান্ত্রী, চেয়ারম্যান, সভাধিপতি, প্রশাসক ইত্যাদি যারা স্রেফ তৃণমূলে আসার কারণেই হয়েছেন তারাই আজ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সবচেয়ে বড় সমালোচক! এর একটাই কারণ, আরও ক্ষমতার নেশা, লোভ এবং অকৃতজ্ঞতা তাদের অন্ধ করে দিয়েছে।
আমার অবাক লাগে, রাতারাতি বিজেপি হয়ে যাওয়া এই মানুষগুলিকে দেখে! আমি জানি, বিজেপির আদর্শ, ইতিহাস, সংগঠন, কর্মপন্থা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে এই মানুষগুলি দিনের পর দিন সমালোচনা করে সাম্প্রদায়িক দল বলে গলা ফাটিয়েছেন। আজ দেখছি তারাই এটাই ‘আসল দল’, ‘এরাই দেশের মঙ্গল করবে’ জাতীয় কথাবার্তা বলে বিজেপি দলের ছাতার নিচে আশ্রয় নিচ্ছেন।
আমি চোখের সামনেই দেখেছি এই লোকগুলোর বাড়বাড়ন্ত হয়েছে দিদির ছত্রছায়ায়। শূন্য থেকে নিজের চেষ্টায় গড়ে তোলা তৃণমূলে এদের আশ্রয় দিয়েছিলেন। আর এরাই এখন বেশি ক্ষমতা ও অর্থের নেশায় দলনেত্রীর সেই বিশ্বাসের অমর্যাদা করলেন। এমন একটি দলে এরা যোগ দিলেন যারা দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে বিরোধিতা করেছিলেন। এবং গত কয়েকবছর ধরে এদের আদর্শহীন দখলদারী নীতিতে দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থা ধ্বংসের মুখে।
আসল কথা হল, এই দলত্যাগীরা বিজেপির ধ্বংসাত্মক নীতি বা দেশের পরিস্থিতি নিয়ে ভাবিত বা চিন্তিত নয়। এরা আরো ক্ষমতার লোভ, কেন্দ্রের শাসকদের কাছ থেকে কিছু প্রাপ্তিযোগের আশায় বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। নাহলে আপনারা বলুন, ভারতবর্ষ বা পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে কি এমন পরিবর্তন ঘটলো যার ফলে এরা মত বদলে ফেললেন! আমার কথা মানার দরকার নেই, আপনারা যে কেউ এই মানুষগুলোকে বিজেপিতে যোগ দেওয়ার কারণ বলতে বললে দেখবেন, এরা আপনার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন।
একটা জিনিস বুঝতে পারি, অতি সাধারণ এই মানুষগুলিকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাদের যোগ্যতার থেকেও বেশি সন্মান দিয়েছিলেন। বহু গুরুত্বপূর্ণ পদে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। নির্বাচনের টিকিট দিয়েছিলেন। ভোটে জেতার পর মন্ত্রিত্ব বা গুরুত্বপূর্ণ পদও দিয়েছিলেন। এমনিতে আদর্শগত কারণে কেউ কোন দলে যোগ দিতেই পারেন, এটাই তো গণতন্ত্র। কিন্তু এদের এই দলত্যাগে কোন আদর্শ নেই।
বিজেপির কি আদর্শ, তা নিজের আদর্শের সঙ্গে কীভাবে মিলছে, দেশ ও দশের কোন উপকারটা বিজেপি করেছে এসব কিছুই বলতে পারবেন না তারা। দলত্যাগ করার সময়ও দলত্যাগের কারণ হিসেবে স্পষ্ট করে কেউ কিছু জানাতে পারেননি। তাই ক্ষমতার মোহ আর ধান্দাবাজি করার স্বার্থে দেশের শাসকদলের সঙ্গে ভিড়ে যাওয়া ছাড়া এই দলত্যাগকে আর কিছুই বলা যাবেনা।
বাংলার জননেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে আপনাদের রাজনীতির হাতেখড়ি। তার নেতৃত্বে লড়াই করে বাংলায় বাম অপশাসনের অবসান হয়েছে। বিজেপির বিভেদপন্থা সম্পর্কে তিনি আপনাদের সচেতন করেছিলেন। বাংলার মানুষকে আপনারাই একসময় বিজেপির ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে বুঝিয়েছিলেন, সচেতন করেছিলেন তাদের। কোভিড আসার আগে বিজেপি সরকারের আনা কালো আইন এনআরসি আর সিএএ এর বিরুদ্ধে হাজার হাজার মানুষ নিয়ে জননেত্রীর সঙ্গে পায়ে পা মিলিয়ে যে আওয়াজ তুললেন, যে মানুষগুলোর অধিকার রক্ষার শপথ নিলেন, আর আজ নির্বাচনের আগে সেগুলো ভুলে লোভের কাছে আত্মসমর্পণ করলেন!!
এবার আপনারা মানুষের কাছে গিয়ে বিজেপিকে সমর্থন করার কথা বলবেন যখন, তখন আপনাদের মুখ কোথায় থাকবে? তারা তো আপনাদের বিশ্বাসঘাতক বলবেন। আরও একটা কথা উচ্চাকাঙ্ক্ষী অনেকেই নিজেদের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চাইছেন, কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী তো একজনই হয়। বিজেপিতে গিয়েও কি আপনাদের সেই স্বপ্ন পূরণ হবে? তখন তো একূল ওকূল দুকূলই যাবে।
এসব নিয়ে বেশি কিছু বলতে ইচ্ছে করেনা। এদের সবাইকে আমি চিনি, সাংবাদিকতার সময় দিনের পর দিন দেখা ছাড়াও ২০১১ থেকে সব দেখেছি ইকুয়েশনগুলিও জানি। এও জানি যে লোভে এরা বিজেপিতে ভিড়লেন, তা মোটেই সফল হবেনা। কারণ, পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি ক্ষমতায় আসবে ধরে নিয়ে যারা দল ছাড়লেন। ২০২১ এ ভোটের ফল বেরোনোর পর এরা ফেল্টু ছাত্রদের মত আবার মুখ নিচু করে তৃণমূলে ফেরার চেষ্টা করবেন। কালীঘাট ট্রাম লাইন এর পাশে ঘুরঘুর করবেন যদি একবার গাড়ি থেকে দিদি আপনাদের দেখতে পায়।
আমি শুধু দেখবো কি বলবেন এবার মানুষদের, দুদিন আগেও মোদী অমিত শাদের নামে কি কুৎসাটাই না করলেন। আর এখন তাদের চরণে ফুল দিয়ে দ্বিতীয় ইনিংস শুরু করছেন। বিশ্বাসঘাতকদের ইতিহাস ক্ষমা করেনা। ভোটের ফলেই মানুষ এই বিশ্বাসঘাতকতার জবাব দেবেন।