পরপারে পাড়ি জমালেন দুই বাংলার কিংবদন্তি ব্যান্ড সংগীতশিল্পী শাফিন আহমেদ

0
51
জাকির হোসেন, ঢাকা:

মৃত্যুর বাস্তবতায় পরপারে পাড়ি জমালেন উপমহাদেশের অন্যতম সেরা ব্যান্ড তারকা ও সংগীতশিল্পী শাফিন আহমেদ। আমেরিকার ভার্জিনিয়ার হাসপাতালে মৃত্যু হয় তাঁর। শাফিনের মৃত্যুর খবরে শোকের ছায়া নেমেছে দুই বাংলার সঙ্গীতশিল্পী এবং তাঁর অনুরাগীদের মধ্যে।

কথা ছিল ২০ জুলাই ভার্জিনিয়ার একটি কনসার্টে তিনি অংশ নেবেন। সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল। কিন্তু শোয়ের ঠিক আগে অসুস্থ হয়ে পড়েন শাফিন আহমেদ। সে সময় থেকে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। কিন্তু আর ফেরা হলো না শাফিনের। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৬৩ বছর বয়সে আমেরিকাতেই মৃত্যুবরণ করেছেন তিনি৷ জানা গেছে, ২৫ জুলাই বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সময় সকাল ৬টা ৫০ মিনিট নাগাদ তিনি মারা গেছেন। শাফিন আহমেদ স্ত্রী ও তিন সন্তান রেখে গেছেন। শাফিন আহমেদের ভাই হামিন আহমেদ গতকাল জানালেন, কনসার্টে অংশ নিতে যুক্তরাষ্ট্রে যান শাফিন।

২০শে জুলাই তার কনসার্ট ছিল ভার্জিনিয়ায়। কিন্তু শোয়ের আগে অসুস্থ হয়ে পড়েন শাফিন। সেদিনই তাকে ভার্জিনিয়ার একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিন্তু এরপর তার নানা অর্গান অকার্যকর হতে থাকে। নেয়া হয় লাইফ সাপোর্টে। হামিন জানান, এর আগেও বেশ কয়েকবার হার্ট অ্যাটাক করেন শাফিন৷ ১৫ বছর ধরে হার্টের সমস্যায় ভুগছিলেন শাফিন৷ তিনি আরও জানান, তিনি গতকালই যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। সেখানে গিয়ে দ্রুত ভাইয়ের মরদেহ দেশে আনার ব্যবস্থা করছেন৷ শাফিন আহমেদের জন্ম ১৯৬১ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি কলকাতায়। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর ১৯৬৭ সালের দিকে গোটা পরিবারসহ পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমানে বাংলাদেশ) চলে আসেন তাঁরা।

মা উপমহাদেশের কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পী ফিরোজা বেগম এবং বাবা উপমহাদেশের কিংবদন্তি সুরকার কমল দাশগুপ্ত। এই পরিবারে জন্ম নেয়ার কারণে ছোটবেলা থেকেই শাফিন আহমেদ গানের আবহেই বড় হন। শৈশবে বাবার কাছে উচ্চাঙ্গ সংগীত শিখেছেন আর মায়ের কাছে শিখেছেন নজরুলগীতি। এরপর বড় ভাই হামিন আহমেদসহ বিলেতে পড়াশোনার সুবাদে পাশ্চাত্য সংগীতের সংস্পর্শে এসে ব্যান্ড সংগীত শুরু করেন। দেশে ফিরে গড়ে তোলেন মাইল্‌স। যা ৪৫ বছর ধরে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ -দুই বাংলাতেই অন্যতম শীর্ষ ও জনপ্রিয় ব্যান্ড। এই ব্যান্ডের বেশির ভাগ গান শাফিন আহমেদের গাওয়া। গানগুলো পেয়েছেও তুমুল জনপ্রিয়তা। তিনি কণ্ঠের পাশাপাশি ব্যান্ডটির বেজ গিটারও বাজাতেন।

২০১০ সালে ‘মাইল্‌স’ ভেঙে গেলে ‘ভয়েস অব মাইল্‌স’ নামে আলাদা দল গড়ে তোলেন শাফিন৷ দরদি কণ্ঠ আর বেস গিটারের চমৎকারিত্বে তিনি হয়ে উঠেছিলেন বাংলা ব্যান্ড সংগীতের অন্যতম আইকন। বাংলা ব্যান্ড সংগীতকে একে একে উপহার দিয়েছেন জাদুকরী ‘বিগ কোরাস সং’। ‘চাঁদ তারা সূর্য নও তুমি’, ‘ধিকি ধিকি আগুন জ্বলে’, ‘জ্বালা জ্বালা অন্তরে’, ‘ফিরিয়ে দাও, আমারই প্রেম তুমি ফিরিয়ে দাও’-এর মতো বিগ কোরাস গান দিয়ে শ্রোতাদের মাতিয়ে রেখেছিলেন শাফিন আহমেদ। শাফিন আহমেদের গাওয়া আরও তুমুল জনপ্রিয় কিছু গানের মধ্যে রয়েছে- ‘আজ জন্মদিন তোমার’, ‘পাহাড়ি মেয়ে’, ‘ফিরে এলে না’, ‘হ্যালো ঢাকা’, ‘জাতীয় সংগীতের দ্বিতীয় লাইন’ প্রভৃতি।

হামিন, শাফিন, শাহিদুল, কমল ও নিনা মিলে ১৯৭৮ সালে গঠন করেন ব্যান্ড ‘ব্যারাক’। কিন্তু কমল ও নিনা বিদেশে চলে গেলে ভেঙে যায় সেই দল। ১৯৭৯ সালে জনপ্রিয় ব্যান্ড ‘লাইটনিংস’-এর ভোকালিস্ট ও বেস গিটারিস্ট ফরিদ রশিদ একদল তুখোড় মিউজিশিয়ানকে নিয়ে গঠন করেন ব্যান্ড ‘মাইলস’। ফরিদ রশিদ, হ্যাপি আখন্দ, রবিন, কামাল মঈনুদ্দিন, ল্যারি বর্নাবী, ইশতিয়াক, মুসা ছিলেন সেই দলে। ‘মাইলস’ সে সময় ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের চ্যাম্বিলি রেস্টুরেন্টে পারফরম করা শুরু করে। এ সময় ‘মাইলস’ তিনটি শো করে।

১৯৭৯ সালেই ‘মাইলস’-এ যোগ দেন হামিন আহমেদ। পরবর্তী সময়ে ‘মাইলস’-এ গায়ক ও রিদম গিটারিস্ট হিসেবে যোগ দেন শাফিন আহমেদ। ‘মাইলস’-এর প্রথম অ্যালবাম ‘মাইলস’ নামে প্রকাশিত হয় ১৯৮১ সালে। পরবর্তী সময়ে ‘আ স্টেপ ফারদার’ (১৯৮২), ‘প্রতিশ্রুতি’ (১৯৯১), ‘প্রত্যাশা’ (১৯৯৩), ‘প্রত্যয়’ (১৯৯৬), ‘প্রয়াস’ (১৯৯৭), ‘প্রবাহ’ (২০০০), ‘প্রতিধ্বনি’ (২০০৬), ‘প্রতিচ্ছবি’ (২০১৫) প্রকাশিত হয়। প্রতিটি অ্যালবামে শাফিন আহমেদের গাওয়া গান আছে।

চলতি বছর প্রকাশিত হয় শাফিনের জীবনীগ্রন্থ ‘পথিকার’। সেখানে তার জীবনের নানা অজানা গল্পের পাশাপাশি দুর্লভ কিছু ছবিও স্থান পেয়েছে৷ শাফিনের মতো যে ব্যান্ড তারকারা গত শতকের আশি বা নব্বইয়ের দশকে মঞ্চ কাঁপিয়েছেন, তাদের বেশ কয়েকজন ইতোমধ্যে চিরবিদায় নিয়েছেন। তাহলে আগামীতে দেশের ব্যান্ড সংগীতের ঝাণ্ডা কারা বইবে, সেই প্রশ্নে গত জুন মাসে একটি গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে শাফিন বলেছিলেন, “উত্তরাধিকার অবশ্যই আসবে৷”

পরিবার সূত্রে জানা গেছে, ঢাকার বনানী কবরস্থানে বাবা কমল দাশগুপ্তের কবরে সমাহিত করা হবে শাফিন আহমেদকে। পাশে তাঁর মা সংগীতশিল্পী ফিরোজা বেগমের কবর রয়েছে। ১৯৭৪ সালে মারা গেছেন কমল দাশগুপ্ত। ফিরোজা বেগমকে বিয়ের পর ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন কমল দাশগুপ্ত। তাঁদের তিন সন্তানের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ হলেন শাফিন৷ বাকি দুজন সন্তান- তাহসিন আহমেদ ও হামিন আহমেদ৷

Previous articleAkash Institute Announces ANTHE Dates in Celebration of 15th Anniversary
Next articleMamata Banerjee-NITI Aayog Meeting রাজ্যের দাবি তুলতেই ‘মাইক বন্ধ’! মোদীর নীতি আয়োগের বৈঠক ছেড়ে বেরিয়ে এলেন ক্ষুব্ধ মমতা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here