দেশের সময় ওয়েবডেস্কঃ বুধবার সকালে মন্ত্রিসভার বৈঠক ডেকে নরেন্দ্র মোদী সরকার নাগরিকত্ব বিলে যে অনুমোদন দিয়ে দিতে পারে সেই সম্ভাবনার কথা গতকাল লেখা হয়েছিল ‘দেশের সময়’এ। হলও তাই।
বুধবার সকাল সাড়ে ন’টা নাগাদ মন্ত্রিসভার বৈঠক বসে। ওই বৈঠকে নাগরিকত্ব সংশোধন বিলের খসড়া পেশ করেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ। পরে সরকারি সূত্রে জানানো হয়েছে, প্রস্তাবিত সংশোধন বিলে অনুমোদন দিয়ে দিয়েছে মন্ত্রিসভা। এও জানা গিয়েছে, মন্ত্রিসভার বৈঠকে অমিত শাহ ও প্রধানমন্ত্রী দু’জনেই বলেন সংসদের ভিতরে এমন ভাবে কক্ষ সমন্বয় করে চলতে হবে যাতে চলতি শীত অধিবেশনেই তা লোকসভা ও রাজ্যসভায় পাশ করানো যায়।
প্রসঙ্গত, নাগরিকত্ব সংশোধন বিলের মূল বক্তব্য হল, প্রতিবেশি দেশগুলি থেকে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, জৈন, পারসি ও শিখ শরণার্থীদের ভারতীয় নাগরিকত্ব দেওয়া হবে।
এর আগে সোমবারই সংসদে দাঁড়িয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী পষ্টাপষ্টি বলেছেন যে, অনুপ্রবেশকারীদের ভারতে থাকতে দেওয়া হবে না। সবাইকে বহিষ্কার করা হবে। সেই সঙ্গে অমিত শাহ এও জানিয়েছেন, ২০২৪ সালের মধ্যে গোটা দেশে জাতীয় পঞ্জিকরণ তথা ন্যাশনাল রেজিস্টার অফ সিটিজেনস বাস্তবায়িত হবে। আবার গতকাল প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিংহ বলেছিলেন, নাগরিকত্ব সংশোধন বিল দ্রুত পাশ করানো সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকারের বিষয়।
সন্দেহ নেই এর একটি রাজনৈতিক দিক রয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে প্রথমে বিজেপি শাসিত অসমে এনআরসি বাস্তবায়ন করা হয়। কিন্তু তাতে দেখা গিয়েছে প্রচুর হিন্দুর নামও জাতীয় নাগরিক পঞ্জি থেকে বাদ পড়েছে। এই পরিস্থিতিতে অসমের বিজেপি নেতারাই রাজনৈতিক ভাবে বিপন্ন বোধ করছেন। আবার বাংলাতেও সদ্য উপনির্বাচনে দেখা গিয়েছে, তিনটি আসনেই হেরেছে বিজেপি। অনেকে বিশেষ করে তৃণমূল প্রচার করছে এনআরসি নিয়ে মানুষকে ভয় দেখানোর জন্যই জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে বিজেপি। সেই সঙ্গে তৃণমূল আরও জোরদার এনআরসি বিরোধী প্রচার শুরু করে দিয়েছে।
কিন্তু অমিত শাহ ঘনিষ্ঠরা বলছেন, সবে সিনেমার অর্ধেক হয়েছে। বিরতির পর বাকি কাহিনি জানতে পারবে তৃণমূল। নাগরিকত্ব সংশোধন বিল সংসদে পাশ হলেই অসম হোক বা বাংলা—সব বিভ্রান্তি কেটে যাবে।
প্রসঙ্গত, লোকসভা ভোটের পর বাংলায় একটি কর্মীসভা করেছিলেন অমিত শাহ। সেই সভা থেকেই তিনি বলেছিলেন যে, বাংলায় হিন্দু শরণার্থীদের কোনও চিন্তা নেই। তাঁদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। দেশের অন্য নাগরিকদের সঙ্গে তাঁদের কোনও ফারাক থাকবে না। যোগ্যতা থাকলে তাঁদের মধ্যে থেকে কেউ দেশের প্রধানমন্ত্রীও হতে পারেন।
রাজ্য বিজেপি নেতারা মনে করছেন, নাগরিকত্ব সংশোধন বিল পাশ হলে উত্তর চব্বিশ পরগণা, নদিয়া এবং উত্তরবঙ্গের দুই দিনাজপুর, কোচবিহার সহ বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী জেলাগুলির শরণার্থী হিন্দুদের বিপুল সমর্থন পাবে বিজেপি। তা ছাড়া তাতে বাংলায় মেরুকরণও সম্পূর্ণ হবে। কারণ, তখন মুসলিম অনুপ্রবেশকারীদের পক্ষে সওয়াল করতে হবে তৃণমূলকে।
বাংলার শাসক দল যে বিজেপি তথা অমিত শাহদের খেলা ধরতে পারছে না তা নয়। যতদূর পর্যন্ত খবর, বিভিন্ন সাংবিধানিক কারণ দেখিয়ে সংসদে নাগরিকত্ব সংশোধন বিলের বিরোধিতা করতে পারে তৃণমূল। তবে বিজেপির দাবি, সংসদের দুই সভাতেই তাঁদের ও তাঁদের বন্ধুদের যে সংখ্যার শক্তি রয়েছে তাতে বিল পাশ করাতে অসুবিধা হবে না।
নজরে জেনে নিন এই বিল সম্পর্কে জরুরি ১০ তথ্য–
১। এই বিলের উদ্দেশ্য ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইন সংশোধন। আফগানিস্তান, বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান থেকে ভারতে আসা হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পারসি এবং খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের ভারতীয় নাগরকিত্ব দেওয়ার জন্যই এই বিল।
২। সহজ কথায় ভারতের প্রতিবেশী মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলির সংখ্যালঘু নাগরিকদের সহজে ভারতীয় নাগরিকত্ব দেওয়ার জন্য এই বিলের অবতারণা।
৩। ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনে ভারতের নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য ১২ মাস টানা ভারতে থাকার নিয়মের সঙ্গে বিগত ১৪ বছরের মধ্যে ১১ বছর ভারতবাস জরুরি। এবারের সংশোধনীতে দ্বিতীয় অংশে পরিবর্তন ঘটানো হচ্ছে। উপরোক্ত দেশগুলি থেকে আসা ছ’টি ধর্মাবলম্বীদের জন্য ১১ বছর সময়কালটিকে নামিয়ে আনা হচ্ছে ৬ বছরে।
৪। বর্তমান নাগরিকত্ব আইনের আওতায় ভারতে জন্ম নেওয়া কোনও ব্যক্তি অথবা যাঁর বাবা মা ভারতীয়, অথবা যিনি ভারতে একটি নির্দিষ্ট সময়কাল জুড়ে বাস করে এসেছেন, তিনি ভারতীয় নাগরিকত্ব পাওয়ার যোগ্য।
৫। বর্তমান আইনে কেউ যদি পাসপোর্ট বা ভিসা ছাড়া ভারতে প্রবেশ করেন অথবা বৈধ নথি নিয়ে প্রবেশ করার পরে নির্দিষ্ট সময়ের বেশি ভারতে বাস করেন, তাহলে তিনি অবৈধ অভিবাসী বলে গণ্য হবেন।
৬। ভারতের বিদেশি আইন ১৯৪৬ এবং পাসপোর্ট আইন ১৯২০ অনুসারে অবৈধ অভিবাসীকে জেলে পাঠানো বা প্রত্যর্পণ করা হয়ে থাকে।
৭। ২০১৫ ও ২০১৬ সালে সরকার কিছু ছাড় দিয়েছে। ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর ও তার আগে আফগানিস্তান, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান থেকে ভারতে আগত হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পারসি এবং খ্রিস্টানদের ছাড় দেওয়া হয়েছে।
৮। ওই নির্দিষ্ট গোষ্ঠীগুলির সদস্যরা বৈধ কাগজপত্র ছাড়া ভারতে বাস করলেও তাঁদের জেলে বা নিজেদের দেশে পাঠানো হবে না।
৯। ২০১৬ সালের নাগরিকত্ব (সংশোধনী) বিল সংসদে আনা হয়েছে যাতে ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব বিল সংশোধন করে এই ব্যক্তিদের ভারতীয় নাগরিকত্ব দেওয়া যায়।
১০। এই বিল নিয়ে বিরোধীদের প্রধান আপত্তির বিষয় হল এখানে মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের টার্গেট করা হয়েছে। সংবিধানের ১৪ নং অনুচ্ছেদে যে সমতার অধিকার সুনিশ্চিত করা হয়েছে, এ বিল তার পরিপন্থী বলে দাবি সমালোচকদের।