অন্বেষা বন্দ্যোপাধ্যায়: দু’হাজার কুড়ি-র (২০২০) শুরুটা হয়েছিল অন্যান্য নতুন বছরের মতোই। আনন্দ, উদযাপন, নতুন আশা আর নতুন প্রাপ্তির অঙ্গীকার নিয়ে। কিন্তু ছবিটা ঘুরে গেল খুব তাড়াতাড়িই। ত্রিশে জানুয়ারি কেরালায় চিন ফেরত এক ভারতীয়ের দেহে প্রথম মিলল কোভিড-১৯এর জীবাণু। সেই শুরু। বছরের শেষে বাড়তে বাড়তে সেই সংখ্যাটা দাঁড়িয়েছে ১কোটি ২৬ হাজারে। এই একবছরে কত মানুষ হারালেন প্রিয়জনকে। রুজি রোজগার হারিয়ে সর্বস্বান্ত হলেন কত পরিবার। মানুষের রোজকার জীবনে ঢুকে পড়ল মাস্ক, স্যানিটাইজারের মতো শব্দ। ‘আরও কাছাকাছি, আরও কাছে এসো’-র বদলে এল সামাজিক দূরত্ব। দুর্দশা আর মৃত্যুভয়- পদে পদে তাড়া করে বেড়ালো গোটা ২০২০-কে। কী না দেখলাম আমরা এ বছরে!
ফেব্রুয়ারির ২৩ তারিখ দিল্লির শাহিনবাগের এনআরসি, সিএএ বিরোধী আন্দোলন সাম্প্রদায়িক রূপ নিল। উত্তর-পূর্ব দিল্লিতে শুরু হল হিংসা৷ পুড়ল স্কুল, বাড়ি, যানবাহন, আরও কত কী৷ রাজধানীতে জাঁকিয়ে বসল ভয়, আতঙ্ক!
এর মধ্যেই মার্চের শেষ থেকে দেশজুড়ে শুরু হল লকডাউন। কড়া লকডাউন। প্রথমে ২১ দিন, তারপর অনির্দিষ্টকালের জন্য… এই সুদীর্ঘ লকডাউনে কাজ হারালেন কয়েক লক্ষ মানুষ। অপূরণীয় ক্ষতি হল শিল্পসেক্টরগুলোয়। কাজ হারিয়ে, অনিশ্চয়তায়, বাড়ি ফেরার আশায় পথে নামলেন হাজার হাজার অভুক্ত পরিযায়ী শ্রমিক৷ ২০২০ দেখাল সদ্যোজাতকে কোলে নিয়ে খালি পায়ে এই সুজলা-সুফলা দেশের বুকেই হাজার হাজার ভুখামানুষের মৃত্যুমিছিল। পুলিশি ‘জুলুমে’ রাজধানীর বুকে ভেঙে দেওয়া হল শাহিনবাগ আন্দোলন।
মৃত্যুমিছিল, সেও কি কম দেখল ‘পোড়া দেশ’! প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি থেকে শিল্পী, গায়ক, অভিনেতা, কবি, নাট্যকার- শীতের ঝরা পাতার মতো দূরে হারিয়ে গেল কত প্রিয় নাম, প্রিয় ব্যক্তিত্ব। ধর্মকে কেন্দ্র করে, রাজনীতিকে জড়িয়ে বারবার সংঘাত বাঁধল। বারবার উলুখাগড়ার মতো প্রাণ গেল দিন আনি দিন খাই সাধারণ মানুষের।
তবে শুধুই কি অন্ধকার? সামান্য হলেও আশার আলো দেখাল দীর্ঘ টালবাহানার পর চার নৃশংস নির্ভয়া ধর্ষকের ফাঁসি। ন্যায় পেলেন ‘নির্ভয়া’ জ্যোতি সিংহ।
মহামারীর মধ্যে যুদ্ধ জিগির তৈরি হয়েছে। পূর্ব লাদাখের গালওয়ান উপত্যকারয় ভারত-চিন সামরিক সংঘাত ১৯৬২-এর স্মৃতিকে ফিরিয়ে এনেছিল এই কুড়িতেই।
আবার তার কয়েক মাসের মধ্যেই হাথরাসের ধর্ষণকাণ্ড বুঝিয়ে দিল এদেশে মেয়েরা যে তিমিরে ছিল, সে তিমিরেই আছে৷ বুঝিয়ে দিল ফাঁসি দিয়ে ধর্ষণ ঠেকানো যাবে না। সামাজিক অবক্ষয়ের শিকড় অনেক গভীরে নিহিত ।উত্তরভারতের মৃত দলিত মেয়েটির জন্য আবারও গর্জে উঠল আসমুদ্র-হিমাচল। বছরের শেষেও সেই গর্জনের রেশ ফুরোয়নি। কৃষি আইনের বিরুদ্ধে ফুঁসছে আমাদের অন্নদাতারা। শক্তি পাচ্ছে কৃষক বিক্ষোভ৷ প্র্তিদিন সংখ্যা বাড়ছে সিংঘু সীমান্তে। মহারাষ্ট্র থেকে দিল্লির পথে ধেয়ে আসছে কিষান মিছিল।
করোনা মহামারি রাতের ঘুম কেড়েছে অনেকের। কেড়ে নিয়েছে প্রিয়জনদের। কিন্তু তার চেয়েও অনেক বড় বড় বিপদ, মহামারী পেরিয়ে এসেছে আমাদের সভ্যতা। ঘুরে দাঁড়িয়েছে৷ ঘুরে দাঁড়াব আমরাও৷ গত বছরের এই সর্বাত্মক নেতিই জীবনের একমাত্র সত্যি হতে পারে না৷ আমরা জানি “এ পথেই আলো জ্বেলে- এ পথেই, পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হবে”… সেই আলোর অপেক্ষা নিয়েই শুরু হল ২০২১। শুরু হল ‘তমসো মা জ্যোতির্গময়’ বলে আমাদের নতুন পথচলা…
কারণ এই মাটিতেই জীবনানন্দ লিখে গিয়েছেন, ” এই পৃথিবীর রণ-রক্ত-সফলতা সত্য, তবু শেষ সত্য নয়, এ শহর একদিন কল্লোলিনী তিলোত্তমা হবে, তোমার কাছে আমার হৃদয়।”