দেশের সময় ওয়েবডেস্কঃ নাম সমীর দীনেশ চৌধুরী। হায়দরাবাদের অরুণোদয় কলেজের ছাত্র। হাতে মোটা করে বাঁধা লাল তাগা। ধর্ম নিয়ে কোনও সন্দেহই নেই। ২৬/১১ মুম্বই হামলায় মৃত্যু হলে মহম্মদ আজমল আমির কাসভের এই পরিচয়ই হত। মুম্বইতে লস্কর হামলার সেই ভয়াবহ দিনটিকে হিন্দু সন্ত্রাসবাদী হামলা বলে চালাতে চেয়েছিল পাক মদতপুষ্ট এই জঙ্গি সংগঠন।
কাসভের সঙ্গেই যে দশ জঙ্গি সেদিন হামলা চালিয়েছিল তাদের প্রত্যেককেই সাজানো হয়েছিল কলেজছাত্র হিসেবে। পরিচয়পত্রে লেখা ছিল ভারতীয় ও হিন্দু।
২০০৮ সালের ১১ নভেম্বর মুম্বইয়ে জঙ্গি হানায় ১০ জঙ্গির মধ্যে একমাত্র কাসভই ধরা পড়ে। বাকিদের মৃত্যু হয় পুলিশের সঙ্গে এনকাউন্টারে। চার বছর পরে ২০১২ সালের ২১ নভেম্বর পুণের ইয়েরওয়াড়া জেলে ফাঁসি দেওয়া হয় কাসভকে। এই চার বছরের সময়কালে জেলের ভিতরে কাসভ ও তদন্তকারী অফিসারদের যে সমীকরণ তৈরি হয়েছিল সেটা আগেও সামনে আনে মুম্বই পুলিশ।
বছর সতেরোর এক কিশোর কতটা কঠিন হতে পারে, কীভাবে জিহাদের ভাবনায় এতটা অনুপ্রাণিত হতে পারে, সেটা চমকে দিয়েছিল দুঁদে পুলিশ কর্তাদের। মুম্বই পুলিশের প্রাক্তন কমিশনার রাকেশ মারিয়া তাঁর বই ‘লেট মি সে ইট নাও’-তে এমনই চাঞ্চল্যকর কিছু তথ্য তুলে ধরেছেন। কাসভের হাতে বাঁধা লাল তাগার আসল উদ্দেশ্যও সামনে এনেছেন তিনি।
২৬ নভেম্বর, ২০০৮। পাকিস্তান থেকে আরব সাগর পেরিয়ে মুম্বইয়ে ঢুকে পড়েছিল ১০ জঙ্গি। ছড়িয়ে পড়েছিল বাণিজ্যনগরীর লিওপোল্ড কাফে, নরিম্যান হাইস, তাজ হোটেল, ছত্রপতি শিবাজী বাস টার্মিনাস, ট্রাইডেন্ট হোটেল, কামা হাসপাতাল-সহ শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায়।
তারপরেই শুরু হয়েছিল এলোপাথাড়ি গুলিবর্ষণ। ভয়ঙ্কর সেই হামলার বলি হয়েছিলেন মোট ১৬৪ জন নিরপরাধ মানুষ। আহত হয়েছিলেন ৩০৮ জন। ধরা পড়েছিল আজমল কাসভ। মুম্বই হামলার দায় স্বীকার করেছিল লস্কর-ই-তৈবা।
তদন্তে জানা গিয়েছিল, আইএসআইয়ের নেতৃত্বে এই হামলার ছক কষেছিল লস্কর। প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার রাকেশ মারিয়া বলছেন, হামলাকারী জঙ্গিদের ভারতীয় হিন্দু হিসেবে সাজিয়ে দেশে ঢোকানো হয়েছিল। প্রত্যেকের নামও ছিল ভুয়ো, পরিচয়পত্রে লেখা ছিল তারা হায়দরাবাদের অরুণোদয় কলেজের ছাত্র। আজমল কাসভের হাতে বেঁধে দেওয়া হয়েছিল লাল তাগা। যাতে তার মৃত্যু হলে, তাকে হিন্দু বলেই ভাবেন পুলিশ ও গোয়েন্দারা।
পাকিস্তানের ফরিদকোটের বাসিন্দা ছিল আজমল কাসভ। প্রাক্তন কমিশনার রাকেশ মারিয়া বলেছেন, তদন্তে কাসভের পরিচয় গোপন থাকেনি। লস্করে যোগ দেওয়ার আগে ছোটখাটো চুরি, ডাকাতি করত কাসভ। বন্ধু মুজফফর লাল খানের সঙ্গে ডাকাতি করতে গিয়েই সম্ভবত লস্করের কোনও সক্রিয় সদস্যের সঙ্গে আলাপ হয কাসভের।
অস্ত্র প্রশিক্ষণ নেয় সে। মারিয়া বলেছেন, মুম্বই হামলার জন্য বহু আগে থেকেই প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছিল কাসভ ও দশ জঙ্গিকে। মানুষ খুন করার ট্রেনিং দেওয়া হয়েছিল লস্কর শিবিরে। এই কাজের জন্য ১ লক্ষ ২৫ হাজার টাকা পেয়েছিল কাসভ। আর তার পরিবারকে এক সপ্তাহের লম্বা ছুটি কাটানোর খরচ দেওয়া হয়েছিল।
মহারাষ্ট্রে শিনা বরা কাণ্ডে তদন্তের দায়িত্বে ছিলেন রাকেশ মারিয়া। নিজের বইতে তিনি লিখেছেন, ২০০৮ সালের ২৬ নভেম্বর হামলার সময়ই মুম্বই পুলিশের ক্রাইম ব্রাঞ্চের প্রধান ছিলেন রমেশ মহালে। ২৬/১১ হামলার তদন্তের ভার ছিল তাঁর হাতেই। কাসভকে ধরার পর প্রথম ৮১ দিন তাকে নিজেদের কাছেই রেখেছিল ক্রাইম ব্রাঞ্চ।
তার পরেই কাসভকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল আর্থার রোড জেলের বিশেষ ভাবে বানানো বুলেটপ্রুফ কারাগারে। প্রায় চার বছর ধরে কাসভের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল তাঁর ও রমেশের। বিভিন্ন সময় কাসভের নানা কাজকর্ম চমকে দিত তাঁকে। মারিয়া বলেছেন, কাসভ বিশ্বাস করত ভারতের মসজিদগুলিতে মুসলিমদের নমাজ পড়তে দেওয়া হয় না।
জেলবন্দি থাকার সময় দিনে যে পাঁচবার আজান সে শুনত, সেটা নাকি ছিল তার ভ্রম। বহুদিন পর্যন্ত এই বিশ্বাস নিয়েই ছিল কাসভ। পরে শহরের ব্যস্ত মোড়ে একটি মসজিদে নিয়ে গিয়ে তাকে দেখানো হয় সত্যিটা ঠিক কী।
মারিয়া বলেছেন, ‘‘মসজিদে মুসলিমদের ঢুকতে দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল কাসভ। কারণ সে বিশ্বাস করত ভারতীয় মুসলিমদের জন্য মসজিদের দরজা নাকি বন্ধ থাকে। কাসভের অভিব্যক্তিতে আশ্চর্য বদল এসেছিল।’’
জিহাদের ভাবনায় কীভাবে সতেরো বছরের এক কিশোরের মগজধোলাই করা হয়েছিল, এটাই তার প্রমাণ।
মাত্র ১৭ বছরের ওই কিশোরের বুদ্ধি অবাক করে দিত তাঁকে, এমনটাই দাবি করেছেন রাকেশ মারিয়া। তদন্তের প্রথম দিনই তিনি বুঝে গিয়েছিলেন, সহজ রাস্তায় কাসভের কাছ থেকে কথা বার করা যাবে না। তাই কাসভের সঙ্গে আন্তরিক ব্যবহারের মাধ্যমে সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। একটা সময় তাঁকে ‘জনাব’ (স্যর) বলে সম্বোধন করত কাসভ।
প্রথমবার ফাঁসির সাজার কথা শুনে মৃত্যুভয়ও দেখা গিয়েছিল কাসভের মুখে। বোরখা পরিয়ে আর্থার রোড জেলের ‘আন্ডা সেল’ থেকে রাতের আঁধারে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল পুণের ইয়েরওয়াড়া জেলে। সমস্ত পদস্থ কর্তাদের মোবাইল নিয়ে নেওয়া হযেছিল। সাঙ্কেতিক ভাষায় খবর পৌঁছে দেওয়ার কাজ হয় সেই সময়। পরদিন ভোরেই ফাঁসি দেওয়া হয় আজমল কাসভকে।