মাত্র ৩৮ মিনিট ২১ সেকেন্ডেই শেষ হয়েছে শেষ উদ্ধার অভিযানের শেষ পর্ব। আর তারপরই গোটা দেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে স্বস্তি। উদ্ধারকারী দলের নিরলস প্রচেষ্টার প্রশংসায় পঞ্চমুখ সকলে। প্রধানমন্ত্রী মোদী থেকে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু, কে কী বললেন?
দেশের সময় ওয়েবডেস্কঃ গত ১৭ দিন ধরে যে মুহূর্তের অপেক্ষায় ছিল গোটা দেশ, অবশেষে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় এসেছে সেই মুহূর্ত। উত্তরাখণ্ডের ধসে পড়া সিল্কিয়ারা টানেল থেকে এক এক করে ৪১ জন শ্রমিককেই নিরাপদে বের করে আনা গিয়েছে বাইরে। ধ্বংসস্তূপের মধ্য দিয়ে পাইপ পাঠানোর পর, মাত্র ৩৮ মিনিট ২১ সেকেন্ডেই শেষ হয়েছে শেষ উদ্ধার অভিযানের শেষ পর্ব।
এদিন ৮টা নাগাদ এক শ্রমিককে উদ্ধার করতেই যেন উদ্ধারস্থলে শুরু হয়ে যাওয়া অকাল দিওয়ালি। ফাটতে শুরু করে বাজি। এনডিআরএফের এক আধিকারিক জানাচ্ছেন, “নিরাপদেই সকলেই বাইরে বের হচ্ছেন। কোনও অসুবিধা নেই। এখনও পর্যন্ত ২ থেকে ৩ জন বাইরে এসে গিয়েছেন। মেডিকেল টিম তৈরি হয়েছে। আর এখন কোনও সমস্যা নেই। একজন শ্রমিককে উদ্ধার করতে আমাদের ১৫ মিনিটের কাছাকাছি লাগছে।”
আর তারপরই গোটা দেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে স্বস্তি। উদ্ধারকারী দলের নিরলস প্রচেষ্টার প্রশংসায় পঞ্চমুখ সকলে। আটকে পড়া শ্রমিকদের নিরাপদে বের করে আনায় উদ্ধারকারী দলের ভুয়সী প্রশংসা করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও।
সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম এক্সে করা এক পোস্টে তিনি বলেছেন, “উত্তরকাশীতে আমাদের ভাইদের উদ্ধার অভিযানের সাফল্যে সবাই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছেন। সুড়ঙ্গে আটকে পড়া বন্ধুদের বলতে চাই, আপনাদের সাহস এবং ধৈর্য সকলকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। আমি আপনাদের সকলের সুস্থতা ও সুস্বাস্থ্য কামনা করছি।” আরও এক এক্স পোস্টে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, “দীর্ঘ অপেক্ষার পর আমাদের এই বন্ধুরা এখন তাঁদের প্রিয়জনদের দেখা পাবেন। এটি অত্যন্ত তৃপ্তির বিষয়। এই চ্যালেঞ্জিং সময়ে এই সমস্ত পরিবারগুলি যে ধৈর্য এবং সাহস দেখিয়েছে, তার জন্য কোনও প্রশংসাই যথেষ্ট নয়।” এই উদ্ধার অভিযানকে তিনি ‘মানবতা এবং দলবদ্ধভাবে কাজের’ অসাধারণ উদাহরণ বলেছেন। শুধু টুইট করাই নয়, উত্তরাখণ্ডের মুক্যমন্ত্রী পুষ্কর সিং ধামিকে ফোন করে উদ্ধার হওয়া শ্রমিকদের শরীর-স্বাস্থেরও খবর নেন তিনি।
उत्तरकाशी में हमारे श्रमिक भाइयों के रेस्क्यू ऑपरेशन की सफलता हर किसी को भावुक कर देने वाली है।
— Narendra Modi (@narendramodi) November 28, 2023
टनल में जो साथी फंसे हुए थे, उनसे मैं कहना चाहता हूं कि आपका साहस और धैर्य हर किसी को प्रेरित कर रहा है। मैं आप सभी की कुशलता और उत्तम स्वास्थ्य की कामना करता हूं।
यह अत्यंत…
উচ্ছ্বাস ও স্বস্তি প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুও। এক্স পোস্টে তিনি বলেছেন, “উত্তরাখণ্ডের একটি সুড়ঙ্গে আটকে পড়া সমস্ত শ্রমিককে উদ্ধার করা হয়েছে জেনে আমি স্বস্তি পেয়েছি এবং খুশি হয়েছি। উদ্ধার প্রচেষ্টা বারবার বাধার সম্মুখীন হওয়ায় ১৭ দিনেরও বেশি সময় ধরে তাদের যে কষ্ট তা মানুষের ধৈর্যশক্তির প্রমাণ।” উদ্ধারকারী দলের সকল সদস্য এবং যে সমস্ত বিশেষজ্ঞ এই কাজে পরামর্শ দিয়েছেন, তাঁদের সকলকে অভিনন্দন জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি।
I feel relieved and happy to learn that all the workers trapped in a tunnel in Uttarakhand have been rescued. Their travails over 17 days, as the rescue effort met with obstacles, have been a testament of human endurance. The nation salutes their resilience and remains grateful…
— President of India (@rashtrapatibhvn) November 28, 2023
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেছেন, “উত্তরকাশীতে একটি সুড়ঙ্গে আটকে পড়া আমাদের ৪১ জন শ্রমিক ভাইকেই নিরাপদে উদ্ধার করা হয়েছে। এটি দেশের জন্য বড় খবর। এতদিন টানেলে এমন চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য তাদের সাহসিকতাকে সেলাম জানায় দেশ। আমাদের সহ-নাগরিকদের জীবন বাঁচানোর জন্য অক্লান্ত প্রচেষ্টা চালানো সমস্ত ব্যক্তি এবং সংস্থাকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই।”
কেন্দ্রীয় সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক মন্ত্রী নীতিন গড়করি বলেছেন, সিল্কিয়ারা টানেল ধসে আটকা পড়া ৪১ জন শ্রমিককে সফলভাবে উদ্ধার করায় আমি খুশি এবং সম্পূর্ণ স্বস্তি পেলাম।” সাম্প্রতিক কয়েক বছরের মধ্যে সবথেকে উল্লেখযোগ্য উদ্ধার অভিযানগুলির একটি হিসেবে এই উদ্ধার অভিযানকে চিহ্নিত করেছেন তিনি। উদ্ধারকারীদের প্রতি তিনি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী মোদী ক্রমাগত এই অভিযান পর্যবেক্ষণ করেছেন এবং প্রয়োজন অনুযায়ী নির্দেশ ও সহায়তা প্রদান করছেন বলে, তাঁকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানিয়েছেন নীতিন গড়করি। উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী পুষ্কর ধামি এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জেনারেল ভিকে সিং-কেও ধন্যবাদ জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক মন্ত্রী।
কংগ্রেস সাংসদ রাহুল গান্ধী বলেছেন, “উত্তরকাশীর সিল্কিয়ারা টানেলে আটকে পড়া শ্রমিক ভাইদের নিরাপদে প্রত্যাবর্তন খুব খুশির খবর। তাঁদের এবং তাঁদের পরিবারকে আমার আন্তরিক অভিনন্দন। আমাদের শ্রমিক ভাইরা, যারা ভারত গড়েছেন, তাঁদের নিরাপত্তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমি সকল সাহসী কর্মী, যাঁরা এই কঠিন অভিযান সফল করেছেন, তাঁদের সেলাম জানাই।”
দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরীবাল বলেছেন, “এনডিআরএফ, সেনাবাহিনী এবং অন্যান্য সংস্থাগুলির কঠোর পরিশ্রম ফলপ্রসূ হয়েছে এবং উত্তরাখণ্ডের সুড়ঙ্গে আটকে থাকা সমস্ত কর্মীকে নিরাপদে উদ্ধার করা হয়েছে। আমি এই অভিযানে জড়িত, যারা এটিকে সফল করতে দিনরাত কাজ করেছেন, তাঁদের সকলের প্রচেষ্টা এবং কঠোর পরিশ্রমকে অভিনন্দন জানাই। সমস্ত দেশবাসীর প্রার্থনা কাজে লেগেছে। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে যাঁরা একে অপরকে সমর্থন করেছেন, উত্সাহ দিয়েছেন, আমি সেই সমস্ত শ্রমিকদের ধৈর্য ও সাহসকেও অভিনন্দন জানাই। এটা ভারতের জনগণের ঐক্যের জয়।”
কেমন ছিল আটকে থাকা শ্রমিকদের কাছে পৌঁছনোর সেই মুহূর্ত?
গত সতেরো দিনে বারবার ব্যর্থ হয়েছে যন্ত্র। এমনকি, আমেরিকায় তৈরি অগার মেশিনও গিয়েছিল ভেঙে। উত্তরকাশীর সিল্কিয়ারা সুড়ঙ্গে আটকে পড়া শ্রমিকদের উদ্ধারে শেষ। ভরসা ছিলেন তাঁরাই। গাঁইতির মতো সরঞ্জাম দিয়ে হাতে হাতে ইঁদুরের মতে গর্ত খুঁড়ে, শেষ পর্যন্ত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় তাঁরাই পৌঁছে গিয়েছেন আটকে থাকা শ্রমিকদের কাছে। তাদের উদ্যোগেই এক এক করে ৪১ জন শ্রমিককেই নিরাপদে বের করে আনা গিয়েছে ধসে যাওয়া সুড়ঙ্গটির বাইরে। আর তাই ব়্যাট-হোল-মাইনিংয়ের শ্রমিকরা এখন নায়ক। গত ২৪ ঘণ্টা ধরে একটানা কাজ করেছেন তাঁরা। সুড়ঙ্গের কালো অন্ধকারে কিছু দেখা যাচ্ছিল না। এমনকি শ্বাস নেওয়াও ছিল চ্যালেঞ্জের। কিন্তু, এত পরিশ্রমের পরও আজ তাঁদের মুখের যুদ্ধ জয়ের হাসি। আসলে, তাঁদের সব ক্লান্তি ভুলিয়ে দিয়েছেন আটকে থাকা শ্রমিকরাই। ব়্যাট-হোল-মাইনিংয়ের শ্রমিকরা জানিয়েছেন, যে সম্মান আটকে থাকা শ্রমিকরা তাঁদের দিয়েছেন, তা তাঁরা সারা জীবনেও ভুলতে পারবেন না। কিন্তু, ধ্বংসস্তূপ ভেঙে যখন তাঁরা প্রথম পৌছেছিলেন শ্রমিকদের কাছে, সেই সময়টা কেমন ছিল?
দিল্লি থেকে আসা ব়্যাট-হোল-মাইনিংয়ে দক্ষ শ্রমিক ফিরোজ কুরেশি জানিয়েছেন, মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ঠিক ৭টা বেজে ৫ মিনিটে তাঁরা ধ্বংসস্তূপ ভেঙে পৌঁছে গিয়েছিলেন আটকে থাকা ৪১ শ্রমিকের কাছে। যে পাইপ দিয়ে চাকা লাগানো স্ট্রেচারে করে শ্রমিকদের বার করা হয়েছে, শেষ পর্যায়ে সেই পাইপে জমে থাকা ধ্বংসাবশেষ পরিষ্কার করেছেন ফিরোজ। সুড়ঙ্গ থেকে বেরিয়ে এসে তাঁর চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি তিনি। কাঁদতেই কাঁদতেই সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদের তিনি বলেছেন, “আমি আটকে পড়া কর্মীকে জড়িয়ে ধরেছিলাম। আমার চোখ দিয়ে শুধু জল বের হচ্ছিল।”
ধ্বংসস্তূপ ভেঙে সিল্কিয়ারা টানেলে আটকে পড়া শ্রমিকদের কাছে প্রথম পৌঁছেছিলেন আরেক ব়্যাট-হোল-মাইনিং শ্রমিক, মুন্না কুরেশি। তিনি বলেছেন, “শেষ পাথরটা সরানোর সঙ্গে সঙ্গে আমি ওদের (আটকে পড়া ৪১ শ্রমিক) দেখতে পাচ্ছিলাম। তারপরে আমি আর থাকতে পারিনি। ওই ফাটল দিয়ে তাদের কাছে চলে গিয়েছিলাম। ওরা আমাদের জড়িয়ে ধরেছিল। আমাদের কোলে তুলে নিয়েছিল। ওদের উদ্ধার করতে এসেছি বলে আমাদের বারবার ধন্যবাদ জানাচ্ছিল। আমরা গত ২৪ ঘন্টা একটানা কাজ করেছি। আমি খুশি, কিন্তু এতে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করার কিছু নেই। এটা আমি আমার দেশের জন্য করেছি। আমার এটাই কাজ। আটকে পড়া শ্রমিকরা আমাদের যে সম্মান দিয়েছে, আমি সারা জীবনে ভুলতে পারব না।”
দেবেন্দ্র নামে আরেক ব়্যাট-হোল-মাইনিং শ্রমিক বলেছেন, “আমরা ১৫ মিটার খনন করেছি। আমরা যখন সেখানে পৌঁছেছিলাম এবং তাদের উপস্থিতির আভাস পেয়েছিলাম, তখন আমাদের মনে খুবই আনন্দ হয়েছিল। আটকে থাকা শ্রমিকরাও আমাদের দেখে খুব খুশি হয়েছিল। ওরা আমাদেরকে জড়িয়ে ধরে বাদাম উপহার দিয়েছিল।”
গত বৃহস্পতিবার রাতে, আমেরিকা থেকে আমদানি করা উচ্চ প্রযুক্তির অগার মেশিনটি অভিযানের চূড়ান্ত পর্যায়ে ভেঙে গিয়েছিল। এরপরই, উদ্ধারকারীরা ব়্যাট-হোল-মাইনিংয়ের মতো নিষিদ্ধ পদ্ধতি অবলম্বন করেছিলেন। খনি শ্রমিকরা হাতে হাতে পাথর কেটে আটকে পড়া শ্রমিকদের বের করার পথ খনন করা শুরু করেছিলেন। এদিন উদ্ধার অভিযান সফল হওয়ার পর, ব়্যাট-হোল-মাইনিং শ্রমিকদের দলের নেতা বলেছেন, “ওরা প্রত্যেকে অত্যন্ত কঠোর পরিশ্রম করেছে। আমরা জানতাম আটকে পড়া শ্রমিকদের আমাদেরই উদ্ধার করতে হবে। আমরা আমাদের জীবনে একবারই এই সুযোগ পাব। ওদের বের করে আনতে আমাদের শ্রমিকরা ২৪ ঘন্টা অবিরাম কাজ করেছে।”
সমস্ত শ্রমিকদের বের করে আনার পর, সাংবাদিক সম্মেলন করে এই ব়্যাট-হোল-মাইনিং-এর শ্রমিকদেরও ‘ধন্যবাদ’ জানিয়েছেন উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী পুষ্কর সিং ধামি। তিনি বলেন, “মেশিনগুলো বারবার ভেঙে গিয়েছে। কিন্তু আমি ম্যানুয়াল খনি শ্রমিকদের ধন্যবাদ জানাতে চাই। আটকে পড়া শ্রমিকদের সঙ্গেও আমি দেখা করেছি। তাঁরা বলেছেন, সুড়ঙ্গের ভিতরে তাদের কোনও সমস্যা হয়নি।” শ্রমিকদের নিরাপত্তাগত ঝুঁকি এবং পরিবেশগত সমস্যার কারণে, ২০১৪ সালেই ব়্যাট-হোল-মাইনিং পদ্ধতি নিষিদ্ধ করেছিল জাতীয় গ্রিন ট্রাইবুনাল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত, উত্তরাখণ্ডে সুড়ঙ্গে আটকে পড়া শ্রমিকদের প্রাণ রক্ষা করল এই ম্যানুয়াল ড্রিলিং কৌশলই।