কুশল দাশগুপ্ত , জলপাইগুড়ি : নিম্নচাপের জেরে লাগাতার বৃষ্টিতে বেহাল উত্তরবঙ্গ। বুধবারই এক্স হ্যান্ডলে পোস্ট করে পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দার্জিলিং, কালিম্পং ও জলপাইগুড়ির প্লাবিত এলাকাগুলি থেকে সমস্ত বাসিন্দাদের নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।
মুখ্যমন্ত্রী জানান, পরিস্থিতি অনুযায়ী বিপর্যয় মোকাবিলায় সমস্তরকম ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য রাজ্যের মুখ্যসচিবকে বলা হয়েছে। রাজ্যের মন্ত্রী ও শীর্ষ আধিকারিকরা ইতিমধ্যেই উত্তরবঙ্গে রওনা হয়েছেন। ত্রাণ ও উদ্ধারকাজের তদারকি করছেন তাঁরা। প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রাণ ও সম্পত্তিহানি রুখতে সতর্ক রয়েছে প্রশাসন।
সিকিমে হরপা বানে ২৩ জন সেনার নিখোঁজ হওয়ার ঘটনাতেও এদিন গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। মেঘভাঙা বৃষ্টিতে মঙ্গলবার থেকে তোলপাড় সিকিমও। যে কোনও দরকারে প্রতিবেশী রাজ্যের পাশে থাকারও আশ্বাস দিয়েছেন মমতা।

সিকিমে মেঘ ভাঙা বৃষ্টির জেরে ভয়াবহ জলস্ফীতি দেখা দিয়েছে তিস্তায়। পরিস্থিতি বিবেচনা করে তিস্তার দোমহনী থেকে বাংলাদেশ পর্যন্ত অসংরক্ষিত এলাকায় হলুদ সতর্কতা জারি করেছে সেচ দফতর। জলপাইগুড়িতে তিস্তার পাড়ে মাইক নিয়ে প্রচার শুরু করেছে পুলিশ। নদীর ধারে বসবাসকারী সমস্ত বাসিন্দাকে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। জলপাইগুড়ি জেলাশাসক শামা পারভিন জানান, তিস্তা চরের বিভিন্ন এলাকায় ভোররাত থেকেই শুরু হয়েছে উদ্ধার কাজ। সতর্কতা জারি হয়েছে গোটা জেলায়।
জলপাইগুড়ি: সিকিমে মেঘভাঙা বৃষ্টিতে ফুঁসছে তিস্তা। উদ্বেগজনক পরিস্থিতি সমতলের তিস্তা সন্নিহিত এলাকায়। তারই মধ্যে গজলডোবা সংলগ্ন মিলনপল্লি এলাকায় ভেসে আসা তিনটি মৃতদেহ আতঙ্ক বাড়াল নদী পাড়ে।
সিকিমে মেঘভাঙা বৃষ্টির জেরে বুধবার কাকভোর থেকেই জল বাড়ছে তিস্তায়। পাহাড় থেকে ফুঁসতে ফুঁসতে নামছে নদী। ইতিমধ্যেই সিকিমের সঙ্গে সারা দেশের মূল সংযোগরক্ষাকারী ১০ নম্বর জাতীয় সড়ক ভাসিয়ে নিয়ে গেছে তিস্তা। পাহাড়ে ভেসে গেছে বেশকিছু ঘরবাড়ি। বুধবার সকাল ১০ টা থেকে লাল সতর্কতা জারি হয়েছে তিস্তানদীর অসংরক্ষিত এলাকায়। সংরক্ষিত এলাকায় জারি হয়েছে হলুদ সতর্কতা।
গজলডোবা সংলগ্ন এই মিলনপল্লি শিলিগুড়ি পুলিশ কমিশনারেটের আওতাধীন। বুধবার সকালে তিনটি দেহ নজরে আসার পরেই খবর দেওয়া হয় পুলিশকে। পুলিশ এসে দেহ তিনটি ময়নাতদন্তে পাঠায়। মৃতদের নাম পরিচয় এখনও জানা যায়নি। এই ঘটনায় শোরগোল পড়েছে গজলডোবায়।
এদিন টাকিমারিতে জলে ভেসে আসা কাঠ ধরতে গিয়ে জলের তোড়ে ভেসে যান সাধন দত্ত ও শিমুল দত্ত নামে স্থানীয় দুই বাসিন্দা। পরে অবশ্য তাঁদের উদ্ধার করা হয়েছে বলে অসমর্থিত সুত্রের খবর। ভোর থেকেই তিস্তা সংলগ্ন এলাকায় উদ্ধার কাজ শুরু করে প্রশাসন। নদীর ধার থেকে বাসিন্দাদের সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। জল আরও বাড়তে পারে বলে সেচ দফতরের আশঙ্কা। এরইমধ্যে তিস্তানদীতে ভেসে আসা তিনটি মৃতদেহ উদ্বেগ বাড়াল প্রশাসনের। মৃতদের নাম পরিচয় জানার চেষ্টা চলছে।
তিস্তায় জল বাড়ছে, করোনেশন ব্রিজ বিপদে

সিকিমে মেঘভাঙা বৃষ্টিতে ভেসে গেছে তিস্তা। উদ্বেগজনক পরিস্থিতি উত্তরবঙ্গের তিস্তা সন্নিহিত অঞ্চলগুলিতে। জলস্তর ক্রমশ বাড়ছে তিস্তায়। জল আরও বাড়লে কালিঝোড়ার জলবিদ্যুৎ প্রকল্প, সেবকের করোনেশন সেতু বিপদে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ইতিমধ্যেই উন্মত্ত তিস্তা ভাসিয়ে নিয়ে গেছে ১০ নম্বর জাতীয় সড়কের একটা বড় অংশ। ফলে উত্তরবঙ্গের সঙ্গে সিকিমের যোগাযোগ পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। গরুবাথান-লাভা হয়ে চলাচল করছে কিছু গাড়ি। বেলা যত বাড়ছে ততই আশঙ্কার প্রহর গুণছে সমতল। ইতিমধ্যেই লাল সতর্কতা জারি হয়েছে তিস্তায়।

উত্তর সিকিমের চুংথাংয়ে দক্ষিণ লোনাক হ্রদের বাঁধ ভাঙায় তিস্তায় জলস্তর বৃদ্ধি পেয়েছে অস্বাভাবিক হারে। জল ধরে রাখতে না পেরে তিস্তা ব্যারেজ থেকে জল ছাড়া হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে নদী ভয় ধরাচ্ছে সন্নিহিত এলাকায়। যে কোনও ধরণের বিপর্যয় রুখতে কড়া সতর্কতা নেওয়া হয়েছে উত্তরবঙ্গের জেলাগুলিতে। জলপাইগুড়ি জেলায় সমতলে নেমেছে তিস্তা। ভোরের মেঘভাঙা বৃষ্টির জলে তিস্তা ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছে সিকিমের সঙ্গে দেশের মূল সংযোগরক্ষাকারী ১০ নম্বর জাতীয় সড়ক। পাহাড়ে তিস্তার জলে ভেসে গেছে বেশকিছু বাড়ি। তবে প্রশাসন আগে থেকেই বাসিন্দাদের সরিয়ে নিয়ে যাওয়ায় প্রাণহানি এড়ানো গেছে।
কালিঝোড়ার বিদ্যুৎ প্রকল্প ও শিলিগুড়ির করোনেশন সেতু নিয়েও উদ্বেগ বাড়ছে প্রশাসনের। কোনওভাবেই যাতে করনেশন সেতু ও বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলির ক্ষতি না হয় তারজন্য বাড়তি সতর্কতা নেওয়া হয়েছে। তিস্তার অসংরক্ষিত এলাকায় সকাল দশটা থেকে লাল সতর্কতা জারি করা হয়েছে। হলুদ সতর্কতা জারি রয়েছে সংরক্ষিত এলাকায়। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি আরও জটিল হওয়ার আশঙ্কা। জলপাইগুড়িতে সমস্ত স্কুল ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়েছে। ভোররাত থেকে তিস্তাপাড়ের বাসিন্দাদের নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
দার্জিলিং-কালিম্পং-জলপাইগুড়ির পাশাপাশি কোচবিহার জেলাতেও মঙ্গলবার গভীর রাত থেকে তিস্তার বাঁধ সংলগ্ন এলাকায় মাইক নিয়ে মানুষকে সতর্ক করছে প্রশাসন। নদী সংলগ্ন এলাকার মানুষজনকে উদ্ধার করে সুরক্ষিত জায়গায় নিয়ে আসা হয়। মেখলিগঞ্জেও তিস্তায় জলস্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। ফকতের চর, নিজতরফ চরে উদ্ধারকাজ শুরু করেছে প্রশাসন।
রাস্তা ভেঙে দু’ভাগ, কাদায় ডুবে গিয়েছে সেনার ৪১টি গাড়ি, সিকিমের নদীতে নিখোঁজ ২৩ সেনা জওয়ান

উত্তর সিকিমে তিস্তা নদীতে নিখোঁজ হয়ে গিয়েছেন সেনা বাহিনীর ২৩ জওয়ান। কলকাতায় পূর্ব ভারতের সেনা সদর থেকে বুধবার একটু আগে এক বিবৃতিতে এই ঘটনার কথা জানানো হয়েছে। নিখোঁজ সেনাদের উদ্ধারে তল্লাশি অভিযান শুরু করেছে সেনা বাহিনী। মেঘভাঙা বৃষ্টিতে প্রবল জলোচ্ছ্বাসের কারণে সেনা নৌকা উল্টে যায় বলে মনে করা হচ্ছে।
Prayers for the safety of 23 missing army jawans, during a flash flood in Sikkim. pic.twitter.com/IxQYMLApX4
— Go Northeast (@GoNorthEastIN) October 4, 2023
জানা গিয়েছে, সিকিমের ওই প্রান্তে দিন সাতেক হল অবিরাম বৃষ্টিপাত চলছে। তার জেরে চুংথাং বাঁধ থেকে জল ছাড়ার ফলে তিস্তায় জলের স্তর হঠাৎ করে ১৫-২০ ফুট বেড়ে গিয়েছে। তার উপর বুধবার ভোরে মেঘভাঙা বৃষ্টি শুরু হলে আচমকা জলস্তর আরও বেড়ে যায়।
এর ফলে সিংটামের কাছে বারদাং-এ পার্ক করা সেনা গাড়িগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ২৩ জন কর্মী নিখোঁজ। বেশকিছু যানবাহন ডুবে গেছে বলে জানা গেছে, বিবৃতিতে জানিয়েছে পূর্বাঞ্চলের সেনা সদর।
সিকিমের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে এনজেপীতে আটকে বহু পর্যটক:

বুধবার সকাল থেকে শিলিগুড়ি-সিকিমগামী সমস্ত সরকারি ও বেসরকারি বাস পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।যার ফলে সমস্যায় পড়েছেন শিলিগুড়িতে আসা পর্যটক, শ্রমিক সহ যাত্রীরা।বহু পর্যটক, শ্রমিক ও কর্মীরা আটকে পড়েছেন এনজেপি স্টেশনে।ছোট গাড়ি চলাচল করলেও বিকল্প রাস্তা দিয়ে নিয়ে যেতে দ্বিগুণ ভাড়া নেওয়া হচ্ছে।কিছু সংখ্যক মানুষের পক্ষে তা সম্ভব হলেও শ্রমিকদের পক্ষে অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। যার ফলে স্টেশনেই রয়েছেন তারা। এখনো প্রচুর পর্যটক এনজেপী তে আসছেন ঘন্টা পর পর। এত পর্যটক আসার ফলে এন জেপীতে অন্যান্য যাত্রীরাও সমস্যায় পড়ে যাচ্ছেন। জল এবং খাবার ঠিচমতো নেই অনেক পর্যটকের কাছে, তার ফলে একদিকে যেমন খাবারের সমস্যা তৈরী হয়েছে অন্যদিকে শিলিগুড়িতে বৃষ্টি শুরু হওয়ায় থাকবার জন্য জায়গা পেতেও সমস্যায় পড়ে গেছেন পর্যটকেরা। যদিও রেলের তরফ থেকে পর্যটকদের জন্য আজ দুপুরে খাবারের ব্যাবস্থা হয়েছে।
এদিকে অনেকে জরুরি কাজে সিকিমে যাওয়ার জন্য মঙ্গলবারই শিলিগুড়িতে পৌঁছেছেন।সকালে বিপর্যয়ের কথা শুনেই চিন্তায় রয়েছেন। সন্ধ্যায় কিছু পর্যটকের ফিরে যাবার কথা থাকলেও অনেক পর্যটকের আজকের টিকিট না থাকায় সমস্যায় পড়ে গেছেন তারা।