দেশের সময় ওয়েবডেস্কঃ উল্টোরথ। আষাঢ় মাসের দশমী তিথিতে গুন্ডিচা মন্দির থেকে পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে ফিরতি রথযাত্রা হয়। এটি উল্টো রথ বা বহুদা যাত্রা নামেও পরিচিত। মাসি গুণ্ডিচার বাড়িতে আট দিন কাটিয়ে এদিনই ঘরে ফেরেন জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা। উল্টোরথ শুরু হওয়ার আগে মন্দিরের পুরোহিত জগন্নাথদেবের জগন্নাথদেবের দ্বাররক্ষীদের পুজো করেন, এটি দ্বারপাল পুজো নামে পরিচিত।
পুরাণ মতে, প্রায় দু’হাজার বছর পূর্ব থেকেই রথযাত্রা ও উল্টোরথ প্রচলিত হয়। ‘উৎকলখণ্ড’ এবং ‘দেউল তোলা’ নামক ওড়িশার প্রাচীন পুঁথিতে জগন্নাথদেবের রথযাত্রার ইতিহাস প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে, এই রথযাত্রার প্রচলন হয়েছিল সত্যযুগে। সে সময় আজকের ওড়িশার নাম ছিল মালবদেশ। সেই মালবদেশের অবন্তীনগরী রাজ্যে ইন্দ্রদ্যুম্ন নামে সূর্যবংশীয় এক পরম বিষ্ণুভক্ত রাজা ছিলেন, যিনি ভগবান বিষ্ণুর এই জগন্নাথরূপী মূর্তির রথযাত্রা শুরু করার স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন।
সোজা রথ থেকে নয় দিনের মাথায় আয়োজন করা হয় উল্টো রথের। উল্টোরথ উপলক্ষে শ্রীক্ষেত্র পুরীতে প্রায় ২০ লক্ষ ভক্ত সমাগম হয়েছে। একবার প্রভুকে দর্শন করে রথের দড়ি স্পর্শ করতে হাজির হয়েছেন। পুরীতে রথযাত্রাকে সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক রাখতে তৎপর পুলিশ প্রশাসন ও রাজ্য সরকার ।
উল্টো রথের আগে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি চলছে জোর কদমে । গুন্ডিচা মন্দিরের বাইরে রথের পাশে ঘোরা থেকে আরম্ভ করে বিভিন্ন দেব দেবীর মূর্তি নতুন করে সাজানোর কাজ চলছে।
কোভিড মহামারি পরিস্থিতির পর দীর্ঘ দুই বছর পরে এবছর রথযাত্রা উৎসব আয়োজিত হচ্ছে । রথযাত্রা উৎসব উপলক্ষে ছোট ছোট ব্যাবসায়ীরাও আশার আলো দেখছেন।
জানা গিয়েছে, ভক্তদের জন্য প্রভু জগন্নাথ দেব গুন্ডিচা মন্দির থেকে দুপুরে আগে বের হবেন। রথে চাপবেন। তারপরে ধীরে ধীরে মূল মন্দিরের উদ্দেশে রওনা দেবেন বলভদ্র ও সুভদ্রাকে নিয়ে।
উল্টো রথ পুরীতে পরিচিত বহুড়া যাত্রা বা জগন্নাথদেবের রথের প্রত্যাবর্তন যাত্রা হিসেবে। এটি জগন্নাথ রথযাত্রার সমাপ্তি চিহ্নিত করে।
সুভদ্রার দর্পদলন রথটি মাঝখানে থাকে ৷ তার পর পশ্চিমে বলভদ্রের তালধ্বজ রথ এবং পূর্বে জগন্নাথের নন্দীঘোষ রথ। রথভোগ হল একটি বিশেষ শুকনো খাবার যা অনুষ্ঠানের সমাপ্তিতে পরিবেশন করা হয়।
উল্টো রথযাত্রার সময় ভগবান জগন্নাথ, বলভদ্র এবং সুভদ্রার রথ মৌসিমা মন্দিরে থামে । রথযাত্রা পতিতপাবনযাত্রা, নবযাত্রা, গুন্ডিচাযাত্রা নামেও পরিচিত।
ভগবান জগন্নাথের মাসিকে উৎসর্গ করা মৌসিমা মন্দিরে তিন দেবতাকে ‘পোড়া পিঠা’ পরিবেশন করা হয়, যা ভাত, নারকেল, মসুর এবং গুড় সমন্বিত একটি অনন্য সুস্বাদু খাবার । এর পরে, জগন্নাথের রথ গজপতির প্রাসাদের সামনে লক্ষীনারায়ণ ভেতা বা লক্ষ্মীর সমাবেশের জন্য থামে ।
তার পর রথের রশিতে ফের টান পড়ে এবং গন্তব্যে চূড়ান্ত গন্তব্যে পৌঁছায়। ফাসি, ভাউনরা, আসানা মূলত এই তিন ধরনে কাঠের প্রয়োজন হয় রথ নির্মাণে। যা ১২ ধরনের কাঠ থেকে আসে এবং সেখান থেকেই ৮ ফুটের বিশেষ ৮৬৫ টি গুঁড়ি বেছে নেওয়া হয়।
জগন্নাথের রথের নাম নন্দীঘোষ ৷ রশির নাম ‘শঙ্খচূড়া নাগুনি’ ৷ জগন্নাথের রথে সওয়ার হন আরও ৯ দেবতা ৷ এঁদের মধ্যে রয়েছেন গোবর্ধন, কৃষ্ণ, নরসিংহ, রাম, নারায়ণ, হনুমান, রুদ্র ৷ জগন্নাথের রথে একজন রক্ষীও থাকেন৷ এই রক্ষীর নাম গারুদা ৷ রথে জগন্নাথের সঙ্গী হন মদনমোহন ৷ উচ্চতা ৪৫ ফুট। রথের গায়ে থাকে হলুদ এবং সোনালি রং। এই রথে রয়েছে সাত ফুট ব্যাসের ১৬টি চাকা। জগন্নাথের রথের সারথির নাম মিতালি। ৮৩২ কাঠের টুকরো দিয়ে তৈরি হয় এই রথ ৷ রথের মাথায় থাকা পতাকার নাম ত্রৈলোক্যমোহিনী ৷ রথে ৪টি ঘোড়া থাকে৷
মাসির বাড়ি থেকে ফেরার পরও জগন্নাথ-সুভদ্রা-বলরাম প্রবেশ করেন না মূল মন্দিরে। তিন দিন এরকম ভাবেই বাইরে থাকে রথ-সহ বিগ্রহ। কিন্ত এখন প্রশ্ন হল বাইরে কেন বিগ্রহ? কারণ এই তিন দিন ধরে পালিত হয় কিছু অনুষ্ঠান। যার মূল কেন্দ্রবিন্দু-তে থাকেন জগন্নাথদেব। বছরে এক বার মাসির বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেন জগন্নাথ, কিন্ত ফিরে আসার পর রীতিমত ধূমধাম করে সমারোহের সঙ্গে জগন্নাথ-সুভদ্রা-বলরাম কে মন্দিরে রত্নবেদি-তে তোলা হয়। তিনদিন ধরে পালিত হয় বিশেষ অনুষ্ঠান।
একাদশী তিথিতে ও জগন্নাথ সহ সুভদ্রা – বলরাম সেজে ওঠেন নানা সোনার গয়নার সাজে। পুনর্যাত্রার পর একাদশী তিথিতে পালিত হয় এই সোনাবেশ।
অধরপনা: এই উৎসব পালিত হয় দ্বাদশীর সন্ধ্যায়। এই রীতি অনুযায়ী জগন্নাথদেবকে শরবত খাওয়ানোর পালা চলে।
রসগোল্লা উৎসব :ত্রয়োদশীর দিন জগন্নাথদেবের উদ্দেশ্যে ভোগ হিসেবে কয়েকশো হাঁড়ি রসগোল্লা নিবেদন করা হয়।
সবশেষে নীলাদ্রিবিজয় উৎসবের মাধ্যমে শেষ হয় এই সমস্ত রীতি-রেওয়াজ। এই ভাবেই বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানের পর জগন্নাথ-সুভদ্রা-বলরামকে মন্দিরে মূল রত্নবেদিতে তোলা হয়।
প্রচলিত বিশ্বাস, পুরীর রথে জগন্নাথ মহাপ্রভুর দর্শন হওয়া অত্যন্ত শুভ । রথ দেখার জন্য ফি বছর সমবেত হন লক্ষ লক্ষ ভক্ত ও দর্শনার্থী।