কৃষি বিজ্ঞানীদের বক্তব্য, সবুজ বিপ্লবের লক্ষ্য ছিল সঙ্কর প্রজাতির ফসল তৈরি করা। এই প্রজাতির শস্যের ফলন যেমন বেশি, তেমনই কীট প্রতিরোধক। তার ফলে দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু শস্যের পুষ্টিগুণের দিকে সেভাবে নজর দেওয়া হয়নি। বিপত্তিটা ঘটেছে সেখানেই।
অর্পিতা বনিক, সৃজিতা শীল ও রিয়া দাস, : দেশের সময়
ভাত ছাড়া বেশির ভাগ বাঙালির একটা দিনও চলে না। তবে স্বাস্থ্যরক্ষায় এখন অনেকেই রুটিতেও অভ্যস্ত হয়ে পড়ছেন। কিন্তু এক থালা ভাত হোক বা দুটো গরম রুটির মধ্যেই যে বিপদের হাতছানি রয়েছে, সেই তথ্য এবার প্রকাশ্যে এল। আমাদের কাকা-জেঠারা যে চাল-গম খেতেন তার অর্ধেক পুষ্টিও আমাদের পেটে ঢুকছে না। উল্টে জমছে বিষ। দেখুন ভিডিও
ভেজাল এখন কোথায় নেই? খাবারে আর সেই পুষ্টিগুণ কোথায়! এখন তো তেলেও ভেজাল আর দুধেও ভেজাল। ডিমও আসল নাকি প্লাস্টিকের তা বোঝা দায়। কিন্তু ভয় ধরিয়ে দেওয়ার মতো তথ্য দিয়েছেন একদল বাঙালি কৃষিবিজ্ঞানী। তাঁদের দাবি, আমরা রোজ যে ভাত বা রুটি খাচ্ছি, তাও নাকি পুষ্টিগুণে ভরা নয়। বরং ধান ও গমেই থাকছে এমন বিষ যা রিফাইন হওয়ার পরেও যাচ্ছে না। এই বিষাক্ত উপাদান রোজের খাবারের সঙ্গেই ঢুকছে পেটে এবং পরবর্তীতে নানা জটিল ও মারণ রোগের কারণ হয়ে উঠছে।
মোহনপুরের বিধানচন্দ্র কৃষি বিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী বিশ্বপতি মণ্ডল বলেছেন, ১৯৬০ সালে ধান-গমে যে পুষ্টিগুণ ছিল, ২০০০ সাল থেকে তা উধাও হতে বসেছে। আর এখন পুষ্টিগুণ কম বরং বিষাক্ত উপাদান বেশি। ছয়ের দশক থেকে ধান ও গমে পুষ্টিগুণের মাত্রা প্রায় ৪৫ শতাংশ কমে গেছে। কাজেই আমাদের বাবা-ঠাকুর্দারা যে ভাত-রুটি খেতেন তা ছিল অনেক বেশি পুষ্টিকর, কিন্তু এখনকার প্রজন্ম যে খাবার খাচ্ছে তা শরীরের জন্য বিষ।
ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব এগ্রিকালচারাল রিসার্চ (আইসিএআর) এই বিষয়ে একটি রিপোর্ট দিয়েছিল। কৃষিবিজ্ঞানীরা বলেছিলেন, ২০১০ সালের পর থেকে দেখা গেছে ধান বা গমে ক্যালসিয়াম, আয়রন এবং জিঙ্ক-সহ প্রয়োজনীয় উপাদানগুলির ঘনত্ব মাত্রাতিরিক্ত কম। অথচ ক্যালসিয়াম লাগে হাড়ের স্বাস্থ্যের জন্য, আয়রন হিমোগ্লোবিনের জন্য আর জিঙ্ক শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। এই স্বাস্থ্য-বান্ধব খনিজগুলো না থাকলে বা এদের মাত্রা কমে গেলে যা খাবারই খাওয়া হোক না কেন আখেরে কোনও লাভ হবে না।
বাঙালি বিজ্ঞানীদের গবেষণা বলছে, ২০১০-এর দশকে চাষ করা গমে ক্যালসিয়ামের মাত্রা ৫০ বছর আগের তুলনায় ৩০ শতাংশ কম, আয়রনের মাত্রা ১৯ শতাংশ এবং জিঙ্কের মাত্রা ২৭ শতাংশ কম। ছয়ের দশকের তুলনায় ধানে প্রায় ১৬ গুণ বেশি আর্সেনিক এবং ৪ গুণ বেশি ক্রোমিয়াম রয়েছে। প্রতিদিন ভাতের সঙ্গে আমাদের পেটে বিষই ঢুকছে।
ভাত, রুটি, চিঁড়ে, খই, মুড়ি— আর্সেনিক বিষ ছড়িয়ে সব কিছুতেই। আর তা ছড়াচ্ছে একেবারে গোড়া থেকেই। চাষের কাজে ভূগর্ভস্থ আর্সেনিক যুক্ত জল ব্যবহার করা হচ্ছে, ফলন বাড়াতে অতিরিক্ত কীটনাশক ও রাসায়নিক সারের প্রয়োগ হচ্ছে, কৃত্রিম উপায়ে দ্রুত ফলন বাড়ানোর জন্য এমন রাসায়নিক ব্যবহার করা হচ্ছে যা শস্যদানায় বিষের মাত্রা বাড়াচ্ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মান অনুযায়ী এক জন পূর্ণবয়স্ক মানুষের শরীরের প্রতি কেজি ওজনে দুই মাইক্রোগ্রাম আর্সেনিক থাকাটা স্বাভাবিক। কিন্তু সংগৃহীত চালের নমুনা পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে, গড়ে প্রতি কেজি চালে একশো পাঁচ মাইক্রোগ্রাম আর্সেনিক রয়েছে।
আবার কোনও চালের নমুনায় প্রতি কেজিতে ন্যূনতম চুরানব্বই মাইক্রোগ্রাম, কোনওটিতে আবার প্রতি কেজিতে সর্বোচ্চ একশো বাষট্টি মাইক্রোগ্রাম আর্সেনিকও পাওয়া গেছে। গমের ক্ষেত্রেও গড়ে প্রতি কেজিতে পাওয়া গেছে ছিয়াশি মাইক্রোগ্রাম আর্সেনিক। আর্সেনিকের যে বিভিন্ন ধরন রয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে বিপজ্জনক ‘আর্সেনিক-থ্রি’–যাকে সাধারণভাবে আর্সেনাইড বলা হয়। এখনকার যে চাল ও গম বাজারে বিক্রি হয় তার বেশিরভাগের মধ্যেই এই আর্সেনাইড পাওয়া গেছে। হার্টের রোগ, কিডনির অসুখ, ফুসফুসের জটিল অসুখ, নানা ধরনের ক্যানসারের কারণ এই আর্সেনাইড।
পরীক্ষায় দেখা গিয়েছে,
২০০০-এর দশকে চাষ করা ধানে গড় ক্যালসিয়ামের মাত্রা ১৯৬০-এর দশকের তুলনায় ৪৫ শতাংশ কম ছিল
আয়রনের মাত্রা ছিল ২৭ শতাংশ কম, জিঙ্কের মাত্রা ছিল ২৩ শতাংশ কম
২০১০-এর দশকে চাষ করা গমে ক্যালসিয়ামের মাত্রা ৫০ বছর আগের তুলনায় ৩০ শতাংশ কম
আয়রনের মাত্রা ১৯ শতাংশ এবং জিঙ্কের মাত্রা ২৭ শতাংশ কম
বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, প্রয়োজনীয় খনিজের মাত্রা কমে আসাটা স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। কারণ, হাড় গঠনের জন্য ক্যালসিয়াম, হিমোগ্লোবিনের জন্য আয়রন, এবং প্রজনন ও স্নায়বিক স্বাস্থ্যের জন্য জিঙ্ক গুরুত্বপূর্ণ
পাঁচ দশকে কী এমন হল যে এদেশে ধান, গমের পুষ্টিগুণে এত বিশাল বদল ঘটে গেল?
কৃষি বিজ্ঞানীদের বক্তব্য, সবুজ বিপ্লবের লক্ষ্য ছিল সঙ্কর প্রজাতির ফসল তৈরি করা। এই প্রজাতির শস্যের ফলন যেমন বেশি, তেমনই কীট প্রতিরোধক। তার ফলে দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু শস্যের পুষ্টিগুণের দিকে সেভাবে নজর দেওয়া হয়নি। বিপত্তিটা ঘটেছে সেখানেই।
কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অভিজি নন্দী বলেছেন, “হাইব্রিড ভ্যারাইটে পুষটিগুণ থাকছে না। তাই ব্রিডিংয়ের সময় পুষ্টিগুণ কীভাবে রাখা যায় তা ভাবতে হবে।”
কমছে পুষ্টি, বাড়ছে ‘বিষ’
শুধু পুষ্টিগুণ কম হলেও না হয় মেনে নেওয়া যেত। না হয় শরীরে পুষ্টি একটু কম ঢুকবে। কিন্তু বিপদ তো অন্য জায়গায়। বাংলার কৃষি বিজ্ঞানীদের করা সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, সারা দেশে চাষ করা কিছু জনপ্রিয় ধানের দানায় ৬-এর দশকের শস্যের তুলনায় প্রায় ১৬ গুণ বেশি আর্সেনিক এবং ৪ গুণ বেশি ক্রোমিয়াম রয়েছে। প্রতিদিন ভাতের সঙ্গে আমাদের পেটে আক্ষরিক অর্থে বিষ ঢুকছে। আর্সেনিক শরীরের সমস্ত সিস্টেমকে আক্রমণ করে। ক্ষতিগ্রস্ত হয় কিডনি, লিভার ও ফুসফুস। হতে পারে ক্যানসারও বেড়ে যায় হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা। হাত বা পায়ের অংশ পচে যেতে পারে। সংক্রমণ ঘটে শরীরের নার্ভাস সিস্টেমেও।
আশঙ্কার বিষয়টি ইতিমধ্যে কেন্দ্রীয় কৃষি গবেষণা সংস্থার কানে তুলেছেন বাঙালি গবেষকরা। অনেকেই বলছেন, এই বিপদ থেকে রক্ষা পেতে আরও একটা কৃষি বিপ্লবের প্রয়োজন হয়ে পড়েছে আমাদের দেশে। তাহলে কী উপায়?
পুষ্টিবীদ সঞ্চিতা শীল বলেন, “ব্রাউন রাইস অনেক বেশি জনপ্রিয়। অন্যান্য চালের থেকে এই চালে অনেক বেশি মিনারেলস থাকে। এর মধ্যে থাকে আয়রন থাকে। এর মধ্যে প্রচুর পুষ্টি।”
এমনকী বিষাক্ত উপাদানযুক্ত খাবার খেলে জটিল স্নায়ুর রোগ বাড়ার সম্ভাবনাও দেখছেন বিজ্ঞানীরা।