তিব্বতে ভয়াবহ ভূমিকম্পে মৃতের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে চলেছে। এ পর্যন্ত ৫৩ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে বেজিং প্রশাসন। আহতের সংখ্যা শতাধিক। কয়েকশো ঘরবাড়ি ভেঙেচুরে নিশ্চিহ্ন হয়েছে। ধ্বংসস্তূপের নীচে চাপা পড়ে আছেন এখনও বহু মানুষ। মৃত ও জখমদের খুঁজতে ও উদ্ধারে চিনা সেনাবাহিনী দুর্গত এলাকায় ড্রোন নামিয়েছে। মঙ্গলবার দুপুর পিপলস লিবারেশন আর্মির (PLA) ওয়েস্টার্ন থিয়েটার কমান্ড জানিয়েছে, উদ্ধারকাজে সহায়তার জন্য সেনাবাহিনী অনুসন্ধানী ড্রোন পাঠিয়েছে। আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে ৬২ জনকে। দেখুন ভিডিও
ভূমিকম্পের ধাক্কা কাটিয়ে শুরু হয়েছে উদ্ধারের চেষ্টা। মৃত এবং আহতের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। মঙ্গলবার সকালে ৭.১ তীব্রতার জোরালো ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে তিব্বত। যার প্রভাব পড়ে নেপাল, ভুটান এবং ভারতেও। সংবাদ সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, শিগাতসের এই ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন অন্তত আট লক্ষ মানুষ। ভূমিকম্পের উৎসস্থল তিব্বতের তিংরি প্রদেশে। এই অঞ্চলটিকে এভারেস্টের উত্তরের প্রবেশদ্বার হিসাবে দেখা হয়।
প্রথম জোরালো ভূমিকম্পের ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে না-উঠতে পর পর কম্পন (আফটারশক) হতে থাকে ওই অঞ্চলে। সংবাদমাধ্যম ‘দ্য গার্ডিয়ান’ জানিয়েছে, প্রথম ভূমিকম্পের পর ৪০টিরও বেশি কম্পন হয়েছে সেখানে। তার মধ্যে ১৬টি কম্পনের মাত্রা ছিল ৩-এর বেশি। ভূমিকম্পের পর বেশ কিছু ভিডিয়োও সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে, যার সত্যতা যাচাই করেনি দেশের সময় অনলাইন। তবে একটি ভিডিয়ো প্রকাশ করেছে রয়টার্স। তারা জানিয়েছে, ওই ভিডিয়োটি তিব্বতের লাৎসে শহরের কাছে। ভিডিয়োয় দেখা যাচ্ছে, রাস্তার ধারে দোকান ভেঙে পড়েছে। ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে রাস্তার উপর। সংবাদমাধ্যম ‘দ্য গার্ডিয়ান’-এর এক প্রতিবেদন অনুসারে, ভূমিকম্পের উৎসস্থলের কাছাকাছি অঞ্চলে প্রচুর ভবন ভেঙে পড়েছে।
সাধারণত এই ধরনের জোরালো মাত্রার কোনও ভূমিকম্পের জেরে মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা থাকে। চিনের সরকারি সংবাদ সংস্থা জিনহুয়া জানিয়েছে, সরকারি আধিকারিকেরা ভূমিকম্পের জেরে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাপ জানার চেষ্টা করছেন। ক্ষতিগ্রস্ত শহরগুলির মৃত এবং আহতের সংখ্যা জানার চেষ্টা চালাচ্ছে প্রশাসন।
তিব্বতে ভূমিকম্পের উৎসস্থল থেকে প্রায় ৪০০ কিলোমিটার দূরে নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু।
সেখানেও কম্পন অনুভূত হয়েছে। প্রাণভয়ে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসেন কাঠমান্ডুর বাসিন্দারা। প্রভাব পড়েছে এভারেস্টের পাদদেশে অবস্থিত নেপালের সোলুখুম্বু জেলাতেও। সেখানকার মুখ্য জেলা আধিকারিক অনোজ রাজ ঘিমিরে রয়টার্সকে জানিয়েছেন, সোলুখুম্বুতে জোরালো কম্পন অনুভূত হয়েছে। তবে এখনও পর্যন্ত কারও মৃ্ত্যু বা আহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়নি। নেপালের স্থানীয় পুলিশ, নিরাপত্তা বাহিনী এবং স্থানীয় প্রশাসন ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানার চেষ্টা করছে। ভুটানের রাজধানী থিম্পু এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে, বিশেষ করে বিহার, উত্তরবঙ্গ, সিকিমের মতো জায়গাগুলিতে কম্পন অনুভূত হয়েছে।
এর আগে ২০২৩ সালের নভেম্বরেও ৬.৪ মাত্রার জোরালো ভূমিকম্প হয় নেপালে। সেই বারের ভূমিকম্পে শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয় হিমালয়ের কোলে থাকা এই পাহাড়ি দেশে। ২০০৮ সালে দক্ষিণ পশ্চিম চিনের সিচুয়ান প্রদেশে এক ভূমিকম্পে প্রায় ৭০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। ২০১৫ সালে নেপালের কাঠমান্ডুর কাছেও ৭.৮ মাত্রার এক জোরালো ভূমিকম্প হয়। তাতে প্রায় ৯ হাজার মানুষ প্রাণ হারান। আহত হন কয়েক হাজার মানুষ। ক্ষয়ক্ষতির হিসাবে সেটিই নেপালের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প। নেপাল, উত্তর-পূর্ব ভারত এবং দক্ষিণ-পশ্চিম চিনে মাঝেমধ্যেই ভূমিকম্পের খবর পাওয়া যায়। বিজ্ঞানীদের একাংশের মতে, ভারতীয় পাতের সঙ্গে ইউরেশীয় পাতের সংঘর্ষের প্রবণতার কারণে এই অঞ্চলে ভূমিকম্পের আশঙ্কা বেশি থাকে।
ওয়েস্টার্ন থিয়েটার কমান্ডের তরফে ভূমিকম্পের খবর পাওয়া মাত্রই বিমানবাহিনীকে সক্রিয় হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিপর্যয় মোকাবিলায় ইতিমধ্যেই দুর্গতদের উদ্ধারে পরিবহণ, চিকিৎসা, হেলিকপ্টার এবং সেনাবাহিনীকে তৈরি রাখা হয়েছে। সর্বশেষ খবরে জানা গিয়েছে, এদিন ভারতীয় সময় বেলা ১১টা ২৭ মিনিট নাগাদ ফের একটি আফটারশকে কেঁপে ওঠে শিজাং (তিব্বত) স্বশাসিত এলাকা। রিখটার স্কেলে কম্পনের তীব্রতা ছিল ৪.৫। চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং সকলকে সর্বাত্মক শক্তিতে উদ্ধারকাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
হিমালয়ের উত্তর পাদদেশ এলাকার নেপাল-তিব্বতের সীমান্ত এলাকায় ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল ছিল। তীব্র ভূকম্পনে কেঁপে উঠেছে তিব্বত, নেপাল, ভুটান, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার এমনকী দক্ষিণ ভারতেরও কোনও কোনও এলাকায়। এভারেস্ট অঞ্চলের উত্তরভাগের গেটওয়ে বলে খ্যাত টিংরি নামে একটি গ্রামীণ তালুকে ছিল ভূমিকম্পের উৎসস্থল। চিনের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র সংবাদ সংস্থা রয়টার্সকে জানিয়েছে, মাটি থেকে ১০ কিমি নীচে ভূমিকম্পের উৎস ছিল।
এদিন সকাল ৬টা ৩৫ নাগাদ প্রথম কম্পনটি হয়। তার কিছুক্ষণ পরই কেঁপে ওঠে চিনের শিজাং। পরপর ৫ বার আফটারশক অনুভূত হয়। দ্বিতীয় কম্পনটি হয় সকাল ৭টা ২ নাগাদ। কম্পন মাত্রা ছিল ৪.৭। ঠিক পাঁচ মিনিট পরে আবার তৃতীয় কম্পন হয় সকাল ৭টা ৭-এ। তীব্রতা ছিল ৪.৯। প্রথম দু’টি ভূমিকম্প হয়েছে পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে ১০ কিলোমিটার গভীরে। তৃতীয়টি ৩০ কিলোমিটার গভীরে। ছ’মিনিট পরে আরও একটি কম্পন অনুভূত হয়, যার তীব্রতা ছিল ৫।