Tea চা চাই? চা… তেঁতুল চা ! ঢাকা শহরের এই চায়ে মজেছে আট থেকে আশি, রইল রেসিপিও

0
117
ইরফান রহমান, ঢাকা:

ভারতবর্ষের মানুষের চা ছাড়া দিন শুরু হয় না। সকালে এক কাপ গরম চা না পেলে অধিকাংশ মানুষেরই মন কেমন যেন আনচান করে।অনেক ধরনের চায়ের নাম হয়তো আপনি শুনেছেন৷ যেমন  কালো চা, সবুজ চা, ইস্টক চা, দার্জিলিং চা, উলং বা ওলোং, প্যারাগুয়ে চা ইত্যাদি ইত্যাদি৷ এছাড়াও সাদা চা, হলুদ চা, পুয়ের চা-সহ আরো বিভিন্ন ধরনের চা রয়েছে। তবে সর্বাধিক পরিচিত ও ব্যবহৃত চা হলো সাদা, সবুজ, উলং এবং কালো চা। কিন্তু তেঁতুল চা এর নাম ক’জন শুনেছেন?

কেটে রাখা মাল্টা, লেবু, কাঁচা মরিচ সাজিয়ে রাখা থরে থরে। চলছে কাপের পর কাপ চা বানানোর উৎসব। কেউ খাচ্ছেন মাল্টা চা, কেউবা দুধ চা, কেউ আবার লেবু চা৷ তবে সবচেয়ে বেশি চলে তেঁতুল চা৷ বলছি বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার প্রাণবন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের মধ্যে অবস্থিত চা-প্রেমী ও ভোজনরসিকদের এক রত্নস্থান টিএসসি মোড়ের চায়ের দোকানগুলোর কথা৷ টিএসসির পূর্ণরূপ হচ্ছে টিচার-স্টুডেন্ট সেন্টার যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মিলনস্থল৷ এখানে বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন ধরনের খাবারদাবারের পাশাপাশি চায়ের পর চায়ের কাপে আলাপে-আড্ডায় নিজেদের বন্ধনকে সুদৃঢ় করে৷

তবে টিএসসি এখন শুধুই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ নেই৷ সব শ্রেণি-পেশার মানুষ বেলা গড়াতেই ঘুরতে আসে এখানে৷ চা-বিস্কুট, শিঙারা, খিচুড়ি, মম, ছোলা-পেঁয়াজু, লাচ্ছির সাথে চলে ঝোড়ো সংলাপ, গল্পবাজি, ক্যারাম-দাবা-তাস খেলা, গানবাজনা৷ প্রায় ৪০ ধরনের চায়ের দেখা মেলে এই টিএসসি প্রাঙ্গণে৷ এর মধ্যে তেঁতুল চা বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে৷

যদিও এই চা টিএসসির পাশের এলাকা পলাশীর মোড়েও মেলে৷ তবে টিএসসিই বেশি জনাকীর্ণ থাকে৷ চলুন তবে ঢুঁ মেরে আসি টিএসসিতে তেঁতুল চায়ের সন্ধানে; সাথে এর উৎপত্তি, উপাদান আর এই চা পান করে যে একটা অদ্ভুত সংবেদনশীল ভাবের উদ্ভাসন খেলে যায় শরীরজুড়ে, তা নিয়েও আলাপ করা যাক৷

মূলত তেঁতুল চা-এর উৎপত্তি বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার কোলাহলপূর্ণ ফুটপাতেই৷ সময়টা বেশিকাল আগে নয়৷ এই প্রায় এক-দেড় যুগ আগের কথা৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিস্তৃত এলাকা শাহবাগের কোনো এক চা কারিগর যার নাম জানা যায়নি, তিনি তেঁতুলের সাথে চা-পাতার ব্লেন্ড ও বিভিন্ন মশলার মিশ্রণে এই চা উদ্ভাবন করেছিলেন যা প্রথমে পরীক্ষিত পর্যায় বা টেস্টিং স্টেটে রেখেছিলেন, পরে ধীরে ধীরে তা সাধারণ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে৷ চায়ের স্বাদের সীমানা পেরিয়ে স্বতন্ত্রভাবে তথা অনন্য স্বাদের এক চা বানানোর স্পৃহা থেকে ওই কারিগর এমনটা করেছিলেন বলে আন্দাজ করা যায়৷

উপাদানের বিচিত্রতায় তেঁতুলের অম্ল-মিষ্টি রাঙানি, সাথে বিভিন্ন দেশি মাসালা আর কাঁচা লঙ্কার মিশ্রণ যে একটা সূক্ষ্ম প্রাণবন্ত ঝাঁজ যোগ করে এই তেঁতুল চায়ে, তা অন্য সব পানীয়র থেকে একদমই আলাদা৷ একবার পান না করলে এর কোনো কিছুই বুঝা যাবে না, বুঝা যাবে না পান করার সময় এটা শরীরের প্রতিটা প্রান্তকে একীভূত করে কেমন একটা সংসক্তিতে!

কীভাবে বাংলার চা-প্রেমীদের উম্মাদনায় নতুন মাত্রা দিয়েছে এই তেঁতুল চা, তা বুঝতে হলে আসতেই হবে এই টিএসসির মোড়ে কারণ এখানকার চা-কারিগর বা চাওয়ালারা পরম্পরা ধরে এই চা বানিয়ে আসছেন, তাই বাসায় যতোই বানানোর চেষ্টা করি, তাদের বানানো চায়ের স্বাদের সাথে এর বিস্তর তফাত আছে বৈকি৷ দক্ষতা, নির্ভূলতায় স্বাদের ভারসাম্যের যে গভীরতা দরকার, এরা তাতে সুনিপুণ৷ এই চা বানানোও একটা শিল্পের অংশ৷ টিএসসি মোড়ের এমনই একজন চাওয়ালা মোহাম্মদ শাহজালালের থেকেই শুনুন সারমর্ম, “চা বানানো আমাদের কাছে একটা আর্ট৷ নতুনত্বের সাথে ঐতিহ্যও মিশে আছে৷ টকমিষ্টি তেঁতুলের সাথে মরিচের (কাঁচা লঙ্কা) ব্লেন্ড আর চায়ের লিকার, সাথে আছে আমাদের সিক্রেট মাসালা যেটা কয়েক ধরনের মাসালা আমরা একসাথে মিশিয়ে বানাই৷”

চায়ের কাপ থেকে বাষ্প উড়ে উড়ে যায় আর তেঁতুল-মাসালার সুগন্ধি সুবাস মাতোয়ারা করে দেয়, প্রতি চুমুকে প্রাণে খেলে যায় এক বহুমাত্রিক সংবেদনশীলতা৷ প্রথম চুমুকের সাথে সাথে জিভ হতে গলা অবধি মৃদু উষ্ণতা ছড়ায়, সৃষ্টি করে অসাধারণ অনুভূতির৷ পরবর্তী প্রতি চুমুকে স্বাদের গভীরতায় ডুবে গিয়ে একদম শেষ ফোঁটা শেষ হবার পরেও অনেকটা সময় এর রেশ রয়ে যায়৷ এই যে অপূর্ব মিশ্রণের এক অপ্রতিরোধ্য সম্মোহন -এটাই তেঁতুল চা কে অন্য ধরনের চা-গুলো থেকে অনন্য করেছে কালক্রমে৷ সালেহা শিউলি একজন ফ্রিল্যান্স ইন্টেরিয়র ডিজাইনার ও শিল্প-সমঝদার৷ ঢাকার মোহাম্মদপুরে পরিবার নিয়ে বাস করছেন৷ অসম্ভব চা-প্রেমী তিনি৷ দেশ বিদেশের হরেক পদের চায়ের ব্লেন্ড সংগ্রহ করা ও তা পান করার অভিজ্ঞতা নেওয়া তার নেশা৷ তেঁতুল চা, মাল্টা চা, মাসালা চায়ের টানে প্রায়শ মেডিকেল কলেজপড়ুয়া মেয়ে তাহসিন হককে নিয়ে চলে যান টিএসসি৷ কথা হলো তার সঙ্গে, “তেঁতুল চায়ের স্বাদ আমার কাছে এককথায় অতুলনীয়৷ প্রতিবার স্বাদই শুধু না, স্বাদের বাইরে গিয়ে এক একটা গল্প আবিষ্কার করি এই চায়ের মধ্যে৷ টক, মিষ্টি, ঝালের যে একটা সমাহার তা কেবল চা পান করার অনুভূতিই দেয় না, একটা রোম্যান্টিক, নস্টালজিক ভাইব ক্রিয়েট করে যা আমার মনটাকে তাৎক্ষণিকভাবে উদ্দীপ্ত করে৷ প্রতিটা চুমুক আমার কাছে মনে হয় একটা জাদুমন্ত্রের মুগ্ধতার মতো৷ এই চা আমায় আত্মার প্রশান্তি দেয়, এক মুহূর্তের চিরন্তনতা সঞ্চার করে আমার মাঝে৷”

শৈল্পিক আবেদনের বাইরেও তেঁতুল চা বাংলাদেশের সমৃদ্ধ সংস্কৃতি, ঐতিহ্য আর উদ্ভাবনের অন্যতম প্রতীক হয়ে উঠেছে৷ ভারতবর্ষ এমনিতেই এমন একটা জায়গা যেখানে চা শুধুই একটা পানীয় না, এর থেকেও বেশি কিছু৷ সামাজিক আচার, স্বাচ্ছন্দ্যের উৎস আর প্রতিবেশী, স্বজন কিংবা চেনা-অচেনা মানুষের একে অপরের আত্মার সাথে আত্মার সংযোগের একটি উপায় চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে একসাথে আলাপ-আড্ডা, খোশগল্পে মেতে ওঠা৷

উঠতে বসতে রাত কিংবা দিন, বন্ধু বা আত্মীয়-স্বজনের জমায়েতে, এক কাপ চায়ের চুমুক প্রতিটা বাঙালির কাছে এক প্রকার ‘নিকোটিন’৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার টিএসসির মোড়ে অবস্থিত চায়ের দোকানগুলো এই শহরের মানুষগুলোকে দিনের শুরু কিংবা শেষে এক করে দেয়৷ হরেক পদ ও স্বাদের চায়ে চুমুক দিতে দিতে মানুষ নিজেদের প্রাত্যহিক জীবন, ভূত-ভবিষ্যত নিয়ে আড্ডায় মাতে, বহু স্বপ্ন আর দুনিয়া-কাঁপানো সব বৈপ্লবিক ধারণার জন্ম দেয়, একে অপরের সাথে ভাগ করে নেয় আনন্দ, কষ্ট সবকিছু৷ তেঁতুল চা এতে যোগ করেছে অনিন্দ্য এক মাত্রা৷ ভোজনরসিক বা চা-প্রেমী, আপনি যা-ই হোন না কেনো, যদি কখনো বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাতে আসা হয়, এই অসাধারণ তেঁতুল চা চেখে দেখার সুযোগ হাতছাড়া করবেন না৷

তেঁতুল চায়ের সাধারণ একটা রেসিপি শেয়ার করলাম৷ বাসায় বসে তৈরি করার চেষ্টা করতে পারেন-

উপকরণ:

  • তেঁতুল ২ টি
  • চিনি স্বাদ অনুযায়ী
  • বিট নুন বা কালা নামাক স্বাদ অনুযায়ী
  • কাঁচা লঙ্কা ১/২ কুচি চা চামচ
    * চা পাতা আধা চা-চামচ।

প্রণালি:
তেঁতুলে অল্প পানি দিয়ে হাত দিয়ে তেঁতুলের মাড় বের করে নিন। চুলোতে ২ কাপ পানি দিন। ১ কাপ এর চেয়ে একটু বেশি পানি থাকতে তেঁতুলের মাড় ঢেলে দিন। ১ মিনিট পর চিনি, কাঁচা লঙ্কা, বিট নুন স্বাদমতো দিন এবং ভালোভাবে নাড়তে থাকুন। এভাবে ১ মিনিট জ্বাল দিতে থাকুন। চা পাতা দিয়ে সাথে সাথে নামিয়ে নিন। ছেঁকে নিন। তৈরি হয়ে গেল তেঁতুল চা। এবার নিজের মতন পরিবেশন ও উপভোগ করুন৷

উল্লেখ্য, তেঁতুলে টারটারিক এসিড থাকায় খাবার সহজে হজমে সহায়তা করে। পেটের বায়ু, হাত-পা জ্বালায় তেঁতুলের শরবত খুব উপকারী। রক্তে কোলেস্টেরল কমানোর কাজে আধুনিককালে তেঁতুল ব্যবহার হচ্ছে। জ্বরে ভোগা রোগীর জ্বর কমানোর জন্যও এ ফল ব্যবহৃত হচ্ছে৷

Previous articleDilip Ghosh মোদীর শপথের পরই রাজ্য বিজেপির সভাপতি বদল? সরানো হবে জে পি নাড্ডা কেও? ফিরতে পারেন দিলীপ ঘোষ
Next articleNarendra Modi meets Droupadi Murmu : ‘রবিবার সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী পদে শপথ নেব’, রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে বেরিয়ে ঘোষণা মোদীর

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here