বাইপাসের দুর্ঘটনায় যারা আহত হয়েছেন তাঁদের সঙ্গে ট্যাংরার ঘটনায় মৃতদের পারিবারিক যোগ মিলেছে। পুলিশের কাছে আহতরা দাবি করেছেন, তাঁরা সকলেই আত্মহত্যা করার পরিকল্পনা করেছিলেন। ট্যাংরার বাড়িতে তিনজন হাতের শিরা কেটে নিজেদের শেষে করেছেন, তাঁরা গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছিলেন আত্মহত্যা করতে! তবে বাড়ির সামনের যে সিসিটিভি ফুটেজ সামনে এসেছে তা দেখে প্রাথমিকভাবে মনে হয় না যে কেউ আত্মহত্যা করার জন্য বেরিয়েছেন।
ই এম বাইপাসে যে গাড়ির দুর্ঘটনা ঘটেছে তাতে দুই পুরুষ ছাড়াও এক নাবালক ছিল। ওই দুই পুরুষ সম্পর্কে দুই ভাই, প্রণয় এবং প্রসূন দে। পুলিশকে তাঁরা জানিয়েছেন, পায়েসের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ খেয়েছিলেন পরিবারের সকলে। তারপর তিনজন হাতের শিরা কাটেন এবং তাঁরা গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যান। কিন্তু সিসিটিভি ফুটেজে কাউকে দেখে মনেই হচ্ছে না তাঁরা ঘুমের ওষুধ খেয়ে বেরিয়েছেন!
যে ফুটেজ ভাইরাল হয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে, প্রথমে এক ভাই বেরিয়ে গ্যারেজ খুলে গাড়ি বের করেন। তারপর আবার গ্যারেজের দরজা বন্ধ করে গাড়িতে উঠে পড়েন। কিছুক্ষণ পরে ওই নাবালক বেরোয়। তার হাঁটা দেখে কিছুটা অস্বাভাবিক মনে হয়েছে বটে। তবে তৃতীয় জন অর্থাৎ আরেক ভাইয়ের সিসি ফুটেজে হাঁটাচলা দেখেও অস্বাভাবিক কিছু মনে হয়নি। তিনজনই ওই গাড়িতে ওঠেন এবং বেরিয়ে যান।
এই ইস্যুতে পুলিশ কমিশনার মনোজ ভার্মা বলেন, সিসিটিভি ফুটেজ খতিয়ে দেখা হচ্ছে। আহতদের বয়ানের ভিত্তিতে তদন্ত হচ্ছে তবে তাঁরা কতটা ঠিক বলছেন বা ভুল বলছেন, সেটাও তদন্তসাপেক্ষ। সিপি এও বলেন, মৃতদের দুজনের শরীরে আঘাতের চিহ্ন মিলেছে তবে কিশোরীর শরীরে তেমন কোনও চিহ্ন নেই। একতলার তিনটি আলাদা ঘরে তিনজনের দেহ মিলেছিল। একজনের হাত ছাড়াও গলায় আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে।
সিপির কথায়, এই ঘটনার আসল কারণ কী, কারা করেছে, অন্য কেউ জড়িত কিনা, সব বিষয়ই খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তাই এখনই এটা বলা মুশকিল যে এই ঘটনা আত্মহত্যা নাকি খুনের। তিনি জানান, ঘটনাস্থল থেকে কিছু জিনিসও উদ্ধার হয়েছে। একটি ছুরিও মিলেছে। অনুমান, তা দিয়েই হাতের শিরা কাটা হয়েছে।
ট্যাংরার দে পরিবারের সদস্য ১৪ বছরের প্রিয়ম্বদা দে। মা এবং কাকিমার সঙ্গে তার দেহও উদ্ধার করা হয়েছে বুধবার। কিশোরীর মুখ থেকে গ্যাঁজলা বেরোচ্ছিল বলে জানা গিয়েছে পুলিশ সূত্রে। পুলিশ কমিশনার মনোজ বর্মা জানালেন, ওই কিশোরীর ঠোঁট এবং নাকের নীচে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গিয়েছে। কী ভাবে সেই আঘাত লাগল, তা এখনও স্পষ্ট নয়। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এ ছাড়া, কিশোরীর মা এবং কাকিমার (রোমি দে এবং সুদেষ্ণা দে) হাতের শিরা কাটা ছিল।
দু’জনের গলাতেই আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গিয়েছে। তার বাবা, কাকা (প্রণয় দে এবং প্রসূন দে) এবং খুড়তুতো ভাই (প্রতীপ দে) পথদুর্ঘটনায় জখম হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। বাইপাসের ধারে অভিষিক্তা মোড়ের কাছে তাঁদের গাড়ি পিলারে ধাক্কা মারে বুধবার ভোর রাতে।
সিপি জানিয়েছেন, ট্যাংরার ঘটনার পুনর্নির্মাণ করা হবে। যে হেতু পরিবারের দুই সদস্যই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন, তাই সেই প্রক্রিয়ায় দেরি হচ্ছে। এখনই পুনর্নির্মাণ করা যাচ্ছে না। প্রণয় এবং প্রসূন সুস্থ হলে তাঁদের ঘটনাস্থলে নিয়ে গিয়ে পুনর্নির্মাণের চেষ্টা করবেন তদন্তকারীরা।
ট্যাংরার দে পরিবারের বাড়িটি চার তলার। তার মধ্যে দোতলার তিনটি পৃথক ঘরে দুই মহিলা এবং এক কিশোরীর দেহ পাওয়া গিয়েছে। ছিল কাগজ কাটার একটি ছুরিও। সেটি হাতের শিরা কাটতে ব্যবহার করা হতে পারে বলে পুলিশের অনুমান। সিপি জানিয়েছেন, পরিবারের সকল সদস্যের মোবাইল পাওয়া গিয়েছে। তার তথ্য খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ময়নাতদন্তের রিপোর্টের জন্য পুলিশ অপেক্ষা করছে। কী ভাবে তিন জনের মৃত্যু, ওই রিপোর্ট থেকেই তা আরও স্পষ্ট হবে।
তবে ট্যাংরাকাণ্ডে যা যা তথ্য পুলিশ পেয়েছে, তার সবটা এখনও প্রকাশ্যে আনা হয়নি। সিপি বলেন, ‘‘আরও কিছু তথ্য আমাদের হাতে এসেছে। হাসপাতাল থেকে আহতেরা যা বয়ান দিয়েছেন, তা যাচাই করা হচ্ছে। তদন্তের স্বার্থে এখনই আমরা সব তথ্য প্রকাশ করতে পারছি না। কোনও সুইসাইট নোট পাওয়া যায়নি।’’
হাসপাতালে চিকিৎসাধীন যে শিশু, তার হাতেও আঘাতের চিহ্ন আছে। সিপি জানান, প্রণয় এবং প্রসূনের মধ্যে এক ভাইয়ের শরীরে আঘাতের চিহ্ন আছে। কিন্তু অন্য ভাইয়ের তেমন কিছু হয়নি। দুর্ঘটনার আগে না পরে ওই আঘাত লেগেছে, তা-ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এলাকার সিসি ক্যামেরার ফুটেজ যাচাই করছে পুলিশ।
কিশোরী-সহ দুই মহিলার মৃত্যুর সময় নিয়েও ধন্দে পুলিশ। স্থানীয়েরা জানাচ্ছেন, এক দিন আগে থেকেই ওই বাড়ির কাউকে ডাকাডাকি করে সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে মৃত্যুর সময়ের জন্যেও ময়নাতদন্তের রিপোর্টের দিকে তাকিয়ে তদন্তকারীরা।
তদন্ত প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে বলে এখনই আর বাড়তি কিছু বলবেন না বলে জানান মনোজ ভার্মা।