Shiva Gajonচৈত্র শেষের গাজন চড়কের ফোঁড় পৃথিবীর বুকে নবাঙ্কুরের প্রাণসঞ্জীবনের কোনও এক প্রাচীন প্রচেষ্টা : দেখুন ভিভিও

0
12
অর্পিতা দে, দেশের সময়

হিন্দু ধর্মের দেবাদিদেব মহাদেব শিব নিষ্কিঞ্চন, নিঃস্ব, শ্মশানবাসী ভিখারি; তিনি নটরাজ। শিবের তান্ডব নিয়ে প্রাচীন ভারতীয় সঙ্গীত, স্তুতি, কাব্যকলা, সঙ্গীত, নৃত্য, ভাস্কর্য, চিত্র রুপময়। বাংলার প্রাচীন লোককাব্যও শিবনৃত্যরঙ্গে উচ্ছল। বিস্তৃত সুদূর অতীতকাল থেকে মহাকাল নেচে আসছেন চৈত্রমাসে ভক্তদের মাথায় চড়ে, গ্রামবাংলার গাজনে গাজনে।

বাংলার শিবের গাজন মহাকালের এমনই একটি নৃত্য উৎসব। রাঢ বঙ্গের শুকনো ফুটিফাটা গ্রীষ্মে গাজনের দেবতা স্নানে বের হন ঢাকের বোলে। বাংলার গ্রামে গ্রামে শিব ঠাকুরকে নিয়ে ভক্তের দল গাজনে মাতে। সমাজের উঁচু তলার মানুষের চেয়ে বেশি নিচুতলার মানুষের মধ্যেই গাজনের এই মাতুনি সক্রিয়। পরণে গেরুয়া, স্থান ভেদে লাল কাপড়, ধুতি কিংবা কৌপিন, গলায় কুশের সঙ্গে পাটা, হবিষ্যান্ন গ্রহণ, শিবের পুজো করা, ফুলকাড়ানো, শরীরের নানা স্থানে বাণ ফোঁড়া, কাঁটাতে, বঁটিতে, আগুনে ঝাঁপ দেওয়া, বিশালাকার চড়ক গাছের মাথায় বঁড়শিতে চড়ক সন্যাসীরা নিজেদের বেঁধে ঘোরেন, এসবই শিবগাজনের আচার অনুষ্ঠান।নীলপুজোর দিনে মহিলারাও উপবাসী থেকে শিবের পুজো করেন।

মুর্শিদাবাদ, নদীয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে গাজনের উৎসব শুরু হয় চৈত্র সংক্রান্তির দুদিন আগেই। নবদ্বীপের পশ্চিমাংশ, দক্ষিণপূর্বের কিছু অংশ এবং নবদ্বীপের কিছু দূরে স্বরূপগঞ্জের পথে মুর্শিদাবাদের কান্দি, রূপপুর এইসমস্ত অঞ্চল একসময় বৌদ্ধ ধর্মসাধনার কেন্দ্র ছিল বলে অনুমান করা হয় সেখানকার ধ্বংসাবশেষ থেকে। সেই বুদ্ধই পরবর্তীকালে ‘ধর্ম’ ঠাকুরের রূপ নেয়। এখানকার শিবলিঙ্গগুলি বেশিরভাগই বেশ প্রাচীন। নিরাকার হলেও গালা দিয়ে তার চোখ, মুখ, গোঁফ তৈরি করা।

নব্যব্রাম্ভণ্যবাদের পুনরুজ্জীবনে সেই ‘ধর্ম’ পরবর্তীকালে শিবের রূপ নিয়েছেন। এই সমস্ত অঞ্চলের ওপর দিয়ে বিভিন্ন সময়ে যে বৌদ্ধ, তান্ত্রিক, বৈষ্ণব ধর্মমতের যে উত্তাল তরঙ্গ বয়ে গেছে এইসমস্ত লোকাচার যেন তারই প্রতিফলন। গভীর রাতে শবের পুজো, শবদেহ ও শিব নিয়ে নৃত্যোৎসব, রুদ্রের আরাধনা এসবই তন্ত্রসাধনারই রূপমাত্র। দেখুন ভিডিও

মুর্শিদাবাদের কান্দিতে রূপপুরের রুদ্রদেবকে গভীর রাতে মন্দির প্রাঙ্গনে বের করে নিয়ে আসা হয়। শিবের ভৈরব রূপের পুজো হয় তখন। রাত জুড়ে চলে ঢাক, কাঁসরের তালে তালে নটরাজের ভক্তরাও সারা গায়ে লাল রঙ মেখে মাথায়, গলায় ঘন সাদা ফুলের মালা পড়ে, হাতে লাঠি নিয়ে যেভাবে ভক্তরা নাচে, স্থানীয় মানুষের ভাষায় তা স্বয়ং শিবের নাচ। মহাকাল যেন নিজেই নাটের সঙ্গে নাচছেন আর সবাইকে নাচাচ্ছেন।

রাত যত গভীর হয় আশে পাশের গ্রাম থেকে গাজনের এই শিবের নাচন দেখতে মন্দির প্রাঙ্গনে, রাস্তার ধারে ঢল নামে মানুষের। যারা গাজনের সন্যাস নেয়নি এমনও বহু মানুষ এসে যোগ দেন সেই নাচে। স্থানীয় মতে শিবের গাজনে সন্যাস না নিলেও শিবের সঙ্গে নাচলেও দেহান্তে শিবভক্তরূপে কৈলাসে সে স্থান পাবে। এখানকার গাজন চৈত্র সংক্রান্তির চার পাঁচদিন আগে থেকেই শুরু হয়ে যায়। গভীর রাত্রের লাঠিয়ালদের নাচ, মশাল নাচ, ফুল নাচ, ফল নাচ, শব নাচই এখানকার গাজনের মূল আকর্ষণ। সন্যাসীরা গায়ে আলতা মেখে নতুন গামছা নিয়ে পুকুরে স্নান করতে যান, রাতে লাঠিখেলা, মশাল জ্বালিয়ে নাচ, ঢাক আর কাঁসরের তালে তালে এক পা এগিয়ে এক পা পিছিয়ে নাচ, কখনও চক্রাকারে ঘুরে, নাচতে থাকেন। একদল সন্যাসী আবার মরার খুলি লাঠির মাথায় বেঁধে নাচেন। সন্যাসীদের নাচের তালে ঢাকের বোলে রাতের অন্ধকার ফুঁড়ে ভোর নামে রুদ্রদেবের মন্দিরে। নীলের পুজোর দিন সকালে শিবঠাকুরকে মন্দির থেকে বার করে এনে তামার পাত্র, পিঁড়ি কিংবা পালকিতে চাপিয়ে নিয়ে নাচের মিছিল বার হয় বিভিন্ন পাড়া, গ্রাম ঘুরে নাচতে থাকেন সন্যাসীরা। বিগ্রহকে স্নান করিয়ে এনে আবার মন্দিরে বসানো হয়।


শিবের অনুচর ভূত, প্রেত, দৈত্য, দানব। গাজনের সন্যাসীরা গায়ে রঙ মেখে, মুখোশ পড়ে ঢাক, বাজনা, কাঁসর বাজিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ান। হাওড়া, হুগলি, বর্ধমানের বাতানল, সোনাপলাশী অঞ্চলের বিভিন্ন গ্রামে গাজনে সং সেজে, কোথাও আগুনে ঝাঁপ, শরীরে বাণ ফোঁড়া, তরোয়াল, খাঁড়া, শরের বিছানায় শুয়ে, ক্রুশ বিদ্ধ করে সারা গ্রাম ঘোরার রীতি আছে চড়কে।

আদিম কৃষি নির্ভর সমাজ একসময় জমির উর্বরতা, সুবর্ষণ কামনায় জাদুবিদ্যা, তন্ত্রমন্ত্র, কৃচ্ছসাধন, ব্রত অনুষ্ঠান পালন করে এসেছে। গ্রীষ্মের দহনে যখন নদী নালা পুকুর শুকিয়ে যায়, বাংলার গ্রামে গ্রামে গাজনের ব্রতীরা তখনই শিব ঠাকুরের মাথায় জল ঢালে, ছড়া পড়ে যেন বৃষ্টির কামনায়। মশাল জ্বেলে, শব নাচিয়ে শ্মশান জাগানোর রীতি, রুদ্রের পুজোর প্রাচীন ব্যবস্থাকে প্রখর সূর্যের দগ্ধ দহন থেকে পৃথিবীর বুকে নবাঙ্কুরের প্রাণসঞ্জীবনের কোনও এক প্রাচীন প্রচেষ্টা বললে কি ভুল হবে?

Previous articleMamata Banerjee – Kalighat Skywalk Inauguration  কালীঘাট থেকে নববর্ষে সহিষ্ণুতার বার্তা মুখ্যমন্ত্রীর
Next articleBengali New Year মিষ্টিসুখে বাঙালির নববর্ষ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here