দেশের সময়, কলকাতা: শঙ্কর আঢ্যের ১৪ দিনের জেল হেফাজতের নির্দেশ দিল নগর দায়রা আদালত। তাঁর বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ উঠে এসেছে। অভিযোগ, দশ বছরে শঙ্কর আঢ্যর সংস্থার মাধ্যমে হাজার কোটি টাকা বিদেশি মুদ্রায় বদল হয়েছে। ২০১২-১৩ অর্থবর্ষ থেকে ২০২২-২৩ অর্থবর্ষের মধ্যে হাজার কোটি টাকা বিদেশি মুদ্রায় পরিবর্তিত করা হয়েছে।
এসআর আঢ্যর ফিনান্স প্রাইভেট লিমিটেডের মাধ্যমে এই বদল হয়েছে বলে তদন্তে পেয়েছে ইডি। এই সংক্রান্ত নথিও উদ্ধার হয়েছে। একই সঙ্গে তাঁর সিএ-কে জিজ্ঞাসাবাদ করেও এই বদল সম্পর্কে জানতে পারে ইডি।
একবার নয়। একাধিকবার নিজের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন রেশন দুর্নীতিতে গ্রেফতার হওয়া শঙ্কর আঢ্য। যখনই সাংবাদিকরা তাঁকে প্রশ্ন করেছেন, বলেছেন তিনি নির্দোষ। এমনকী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিককের সঙ্গে যোগাযোগ নেই সেই বিষয়ও জানিয়েছেন। শনিবারও একই বুলি আওড়ালেন শঙ্কর। এই চক্রান্তের বিচার ভগবান করবে বলেও জানান তিনি।
আজ শুনানির পর বিচারক জেল হেফাজতের নির্দেশ দিয়েছেন শঙ্কর আঢ্যকে। ৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তাঁকে থাকতে হবে কারাগারেই। এ দিন প্রিজন ভ্যানে ওঠার সময় সাংবাদিকদের শঙ্কর বললেন, “যে বা যাঁরা তাঁর বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছেন তাঁর বিচার করবে ঈশ্বর।” শুধু তাই নয়, সাংবাদিকরা তাঁকে বিদেশি মুদ্রার বদল নিয়ে প্রশ্ন করলে ঈশ্বরের কথাই উল্লেখ করেন তিনি। বারেবারে বলতে থাকেন, “ভগবান বিচার করবে” কিন্তু কে বা কারা তাঁর বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছে সেই তত্ত্ব জিইয়ে রাখলেন তিনি।
অনেকদিন হয়ে গিয়েছে পরিবারের থেকে দূরে। প্রায় প্রতিদিন শঙ্করকে দেখতে তাঁর মেয়ে ঋতুপর্ণা আঢ্য পৌঁছে যাচ্ছেন। তবে চোখের দেখা টুকুই সার। দু-দন্ড বসে যে বাবার সঙ্গে সময় কাটাবেন তা হচ্ছে না। এর মধ্যে শনিবার শঙ্করকে দেখে আবেগ প্রবণ হয়ে গেলেন তাঁর স্ত্রী জ্যোৎস্না আঢ্য। আদালত কক্ষের বাইরে হাউহাউ করে কেঁদে লুটিয়ে পড়লেন তিনি।
শনিবার কলকাতা নগর দায়রা আদালতে তোলা হয় শঙ্করকে। আদলতকক্ষ থেকে বের করে নিয়ে যাওয়ার সময় কেঁদে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তাঁর স্ত্রী। কার্যত স্বামীর পায়ে কাছে বসে পড়েন। বলতে থাকেন শঙ্করের চেহারা খারাপ হয়ে গিয়েছে। জ্যোৎস্নাকে বলতে শোনা যায়, “হ্যাঁ গো তোমার চেহারার কী হাল হয়েছে। তোমাকে তো দেখে চেনা যাচ্ছে না।” এরপর শঙ্কর নিজের স্ত্রীকে তোলেন।তার পর তাঁকে সান্ত্বনা দেন। অন্যদের জানান, স্ত্রীকে যেন সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয় সেখান থেকে।
সূত্রের খবর, আঢ্যর ফোরেক্স-সহ চারটি কোম্পানির মাধ্যমে তাঁর সিএ অরবিন্দ সিং ৩৫০ কোটি টাকা বিদেশি মুদ্রায় কনভার্ট করেন। আরও ১১৭ কোটি কনভার্ট করা হয় হীরামোতি এক্সপোর্ট নামে একটি কোম্পানির মাধ্যমে। তাঁকে জেলে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবেন তদন্তকারী অফিসাররা।
‘অসুস্থতা’ ও ‘হাসপাতাল’ এ যেন সমার্থক শব্দ হয়ে উঠছে দিনদিন। গ্রেফতার হওয়ার পর অভিযুক্তদের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার আর্জি এ রাজ্যে নতুন নতুন নয়। এবার সেই পথেই হাঁটলেন রেশন দুর্নীতি মামলায় গ্রেফতার হওয়া তৃণমূল নেতা শঙ্কর আঢ্য।
শনিবার তাঁকে তোলা হয়েছিল বিশেষ ইডি আদালতে। তবে তাঁর আইনজীবী জাকির হোসেন নিজের মক্কেলের জন্য জামিন প্রার্থনা করেননি বিচারকের কাছে। তবে শঙ্করের চিকিৎসার প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন তিনি। যদিও, ইডির আইনজীবীর দাবি, অভিযুক্ত তৃণমূল নেতা সম্পূর্ণ সুস্থ রয়েছেন। হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন নেই।
শনিবার আদালত কক্ষে শঙ্কর আঢ্যর আইনজীবী জানান, তাঁর মক্কেলের একটি কিডনি নেই। বলেন, “আমরা জামিন চাইছি না। ওনার কিডনির সমস্যা রয়েছে। একটি কিডনি নেই। হাসপাতালে রেখে চিকিৎসার দরকার।” জেল হাসপাতালে চিকিৎসার সব রকম পরিকাঠামো নেই বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
তবে অভিযুক্তের এই দাবি মানতে চাননি ইডির আইনজীবী। তাঁর বক্তব্য, প্রয়োজন পড়লে ভর্তি করা হবে। তবে এখন শঙ্কর সুস্থই রয়েছেন। এ প্রসঙ্গে বিচারকের সামনে এসএসকেএম-হাসপাতালে বেড আটকে পড়ে থাকার দৃষ্টান্তও এ দিন আদালতে তুলে ধরেছেন ইডির আইনজীবীরা। বলেছেন, “হাসপাতালে বেড আটকে পড়ে থাকার ঘটনা ঘটেছে।
এসএসকেএম-এর ঘটনা আমাদের সকলের জানা। সেখানে তিন মাস ভর্তি হওয়ার পরও জানা যায়নি আদতে কোন অসুখ হয়েছে।” এরপর তাঁর বিচারকের কাছে সওয়াল করেন, “আজকের রিপোর্ট অনুযায়ী শঙ্কর আঢ্য সুস্থ আছেন। হাসপাতালে ভর্তি করার প্রয়োজন নেই। জেলে একান্ত কোনও সমস্যা হলে চিকিৎসক সিদ্ধান্ত নেবেন। জেল কোড মেনে চিকিৎসা হবে। তখন যদি প্রয়োজন হয় সিদ্ধান্ত তখন নেওয়া হবে।” আজ শঙ্করকে ১৪ দিনের জন্য জেল হেফাজতে পাঠানোর আবেদন ইডি-র। জেলে গিয়ে জেরার আবেদন জানিয়েছেন আইনজীবীরা।
উল্লেখ্য, নিয়োগ-পুরনিয়োগ বা রেশন! দুর্নীতি মামলায় গ্রেফতার হওয়ার পর তাবড় তাবড় নেতা মন্ত্রীদের এসএসকেএম-এ ভর্তির থাকার ঘটনা এ রাজ্যে নতুন নয়। পার্থ-সুজয়কৃষ্ণ-জ্যোতিপ্রিয় সহ অনেকেই নিজেদের শারীরিক অসুস্থতার কারণ দর্শিয়ে ভর্তি হয়েছেন হাসপাতালে। জ্যোতিপ্রিয় তো এখন রয়েছেন সেখানে। এমনকী, গরুপাচার মামলায় গ্রেফতার হওয়া অনুব্রত মণ্ডলও ভর্তি হতে চেয়েছিলেন এসএসকেএম-এ। অভিযোগ, উঠেছে বেড আটকে রাখার। এবার ঠিক সেই পথেই হাঁটলেন শঙ্করও।
প্রসঙ্গত গত ৫ জানুয়ারি উত্তর ২৪ পরগনার বনগাঁয় শঙ্করের বাড়িতে প্রায় ১৭ ঘণ্টা টানা তল্লাশি চালায় ইডি। তার পর রাতে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। শঙ্করকে নিয়ে যাওয়ার সময় স্থানীয়দের বিক্ষোভের মুখে পড়ে ইডি। পরে তাঁকে আদালতে হাজির করিয়ে ইডি জানায়, ২০ হাজার কোটি টাকার বিদেশে লেনদেন হয়েছে শঙ্করের একাধিক ফরেক্স সংস্থার মাধ্যমে। রেশন ‘দুর্নীতি’র সঙ্গে সেই টাকার যোগ থাকতে পারে বলে ইডির অনুমান। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার দাবি, ওই ২০ হাজার কোটির মধ্যে অন্তত ৯ থেকে ১০ হাজার কোটি জ্যোতিপ্রিয়ের। শঙ্কর অবশ্য সে সব অভিযোগ প্রথম থেকেই অস্বীকার করে আসছেন।