দেশের সময়: বনগাঁ: সীমান্ত শহর বনগাঁ। দিনভর হাজারো ট্রাকের আনাগোনা। পণ্য বোঝাই হয়ে কখনও বাংলাদেশ যাচ্ছে ট্রাক। কখনও ওপার থেকে মাল নিয়ে আসছে এ পারে। এই সমস্ত ট্রাকের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তা থাকে মালিক ও চালক উভয়পক্ষেরই। কারণ সীমান্ত এলাকায় সর্বদাই তৎপর থাকে দুষ্কৃতীরা। অসাবধান হলেই ট্রাক থেকে মাল চুরি যাওয়ার সম্ভাবনা। অনেকসময় মাদক পাচারেরও মাধ্যম হয়ে ওঠে এই ট্রাকগুলি। তাই সব ভেবেই নিরাপত্তা যাতে নিশ্চিত থাকে সেদিকটা খেয়াল রাখতেই হয়। সেই খেয়াল রাখতেন বনগাঁ পুরসভার প্রাক্তন পুরপ্রধান শংকর আঢ্য।
ছোটখাটো ব্যবসা দিয়েই শুরু হয়েছিল। পরে এলাকার মানুষের পড়ে থাকা জমি নিয়ে ট্রাকের পার্কিং লট করে ফেলতেন। সেখানে গাড়ি রেখে কিছুটা জিরিয়ে নেওয়ার সুযোগ মিলত চালকদের। শঙ্করের লোকজনই নিরাপত্তা দিত ট্রাকগুলিকে। এভাবেই ধীরে ধীরে বনগাঁয় প্রভাব বাড়তে শুরু করে শঙ্করের। টাকার হাত ধরেই আসে ক্ষমতা। রাজনীতিতে বড় হওয়ার স্বপ্ন ততদিনে দেখতে শুরু করে দিয়েছেন শঙ্কর। বাম আমলেও গুরু মেনেছিলেন জ্যোতিপ্রিয় মল্লিককেই। বালুর হাত ধরেই রাজনীতিতে এসেছিলেন শঙ্কর।
২০১১ সালে রাজ্যে পালাবদল। বামেদের হারিয়ে ক্ষমতায় আসে তৃণমূল। ওই বছরই হাবরা বিধানসভা থেকে ভোটে জিতে বিধায়ক হন জ্যোতিপ্রিয়। তারপরে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি শঙ্করকেও। ব্যবসা যেমন ফুলেফেঁপে ওঠে, তেমনই বালুর সহচর হয়ে রাজনীতিতেও মোক্ষলাভ।
২০১৫ সালে পুরভোটে দাঁড়িয়ে কাউন্সিলর। মাথায় বালুর হাত থাকায় বনগাঁ পুরসভার পুরপ্রধান হতেও অসুবিধা হয়নি। একটা সময় জেলা রাজনীতিতে ক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছে যান শঙ্কর। স্থানীয় বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, সীমান্ত এলাকায় এমন মেশিনারি তিনি তৈরি করে ফেলেছিলেন যে তাঁর কথা ছাড়া একটা মাছিও গলত না। এভাবেই নাম জড়ায় রেশন দুর্নীতিতে। ইডির আধিকারিকরা জানান, জ্যোতিপ্রিয়ই জেরায় নাম বলেছেন শঙ্করের।
শুক্রবার সকাল সাড়ে সাতটা থেকে রাত সাড়ে বারোটা পর্যন্ত দীর্ঘ ১৭ ঘণ্টার ম্যারাথন জেরার পর গভার রাতে বনগাঁ পৌরসভার প্রাক্তন পৌর প্রধান শংকর আঢ্যকে গ্রেফতার করে ইডি। শারীরিক পরীক্ষার জন্য শনিবার তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় জোকা ইএসআই হাসপাতালে।
উত্তর ২৪ পরগনার বনগাঁর প্রাক্তন পুরপ্রধান শঙ্কর ওরফে ডাকু মুখে মাস্ক, গায়ে জ্যাকেট এবং ট্রাউজার্স পরে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী আধিকারিকদের ঘেরাটোপে গাড়িতে ওঠেন। কিন্তু তাঁর গ্রেফতারি নিয়ে তিনি কোনও মন্তব্য করেননি। অন্য দিকে, শঙ্করের মেয়ের অভিযোগ, তাঁর বাবাকে ফাঁসানো হচ্ছে।
অন্য দিকে, সিজিও কমপ্লেক্স থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময়ে শঙ্করের স্ত্রী জ্যোৎস্না আঢ্য জানান, তাঁর স্বামীকে গ্রেফতারের আগে ইডির এক অফিসার বলেছেন, ধৃত মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক নাকি তাঁর নাম নিয়েছেন। তবে জ্যোৎস্নার দাবি, তাঁর স্বামীকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হচ্ছে। তাঁর ব্যাখ্যা, রাজনৈতিক কারণে জ্যোতিপ্রিয়ের সঙ্গে শঙ্করের যোগাযোগ ছিল। বাড়িতে যাতায়াতও ছিল। কিন্তু সেটা পুরোটাই রাজনৈতিক সম্পর্ক। তার সঙ্গে রেশন দুর্নীতির কোনও সম্পর্ক নেই। জ্যোৎস্নার অভিযোগ, ইডি-র আধিকারিকেরা তাঁর স্বামীর সঙ্গে ব্যবসা সংক্রান্ত কথাই বলেছেন। রাতে ইডির অফিসাররা কোনও একটি নথি দেখিয়ে জানান যে, রেশন দুর্নীতি মামলায় তাঁকে গ্রেফতার করা হল।
শঙ্করের মেয়ে বলেন, “এটা অবশ্যই চক্রান্ত। রাজনৈতিক ভাবে ফাঁসানো হচ্ছে। কোনও লেনদেন (বেআইনি আর্থিক লেনদেন) নেই বাবার সঙ্গে। আমার আবেদন, এর যেন সঠিক বিচার হয়।” কিন্তু ষড়যন্ত্র কার? তাঁর কথায়, “কে চক্রান্ত করেছে, বলতে পারছি না। তদন্ত যত এগোবে জবাব দিয়ে দেব।” শঙ্করের শ্বশুরবাড়ি থেকে প্রায় আট লক্ষ টাকা উদ্ধার হয়েছে বলে ইডি সূত্রে খবর। তবে শঙ্করের মেয়ের দাবি, যে টাকা উদ্ধার হয়েছে, সেটা এক জন সাধারণ মানুষের বাড়িতে থাকতেই পারে।
ইডি সূত্রে খবর, শঙ্করের একাধিক সংস্থা রয়েছে। শঙ্কর এবং তাঁর পরিবার একাধিক বিদেশি মুদ্রা বিনিময় ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। তাঁদের অর্থলগ্নি সংস্থাও আছে। সেখানকার আর্থিক লেনদেনের খুঁটিনাটি জানতে চাইছেন তদন্তকারীরা। তার সঙ্গে রেশন দুর্নীতির কোনও যোগসূত্র রয়েছে কি না, সেটাও দেখা হচ্ছে।