Shahid Khudiram Bose: অত্যাচারী বিচারক কিংসফোর্ডকে হত্যার পরিকল্পনায় ফাঁসি তরুণ বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসু’র

0
191

১৯০৬ সালের মার্চে মেদিনীপুরের এক কৃষি ও শিল্পমেলায় রাজদ্রোহমূলক ইস্তেহার বণ্টনকালে ক্ষুদিরাম প্রথম পুলিশের হাতে ধরা পড়লেও পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। পরবর্তী মাসে অনুরূপ এক দুঃসাহসী কর্মের জন্য তিনি পুলিশের হাতে ধরা পড়েন এবং আদালতে বিচারের সম্মুখীন হন। কিন্তু অল্প বয়সের বিবেচনায় তিনি মুক্তি পান। ১৯০৭ সালে হাটগাছায় ডাকের থলি লুট করা এবং ১৯০৭ সালের ৬ ডিসেম্বর নারায়ণগড় রেল স্টেশনের কাছে বঙ্গের ছোটলাটের বিশেষ রেলগাড়িতে বোমা আক্রমণের ঘটনার সাথে তিনি জড়িত ছিলেন। একই বছরে মেদিনীপুর শহরে অনুষ্ঠিত এক রাজনৈতিক সভায় সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যপন্থি রাজনীতির বিরুদ্ধে তিনি বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন।

বঙ্গভঙ্গ বিরোধী ও স্বদেশী আন্দোলনের কর্মীদের প্রয়োজনভিত্তিক কঠোর সাজা ও দমননীতির কারণে কলকাতার প্রধান প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ড বাঙালিদের অত্যন্ত ঘৃণার পাত্রে পরিণত হয়েছিলেন। যুগান্তর বিপ্লবীদল ১৯০৮ সালে তাঁকে হত্যার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং প্রফুল্ল চাকী ও ক্ষুদিরামের উপর এ দায়িত্ব পড়ে।

কর্তৃপক্ষ কিংসফোর্ডকে কলকাতা থেকে দূরে মুজাফ্ফরপুরে সেশন জাজ হিসেবে বদলি করে দিয়েছিলেন। দুই যুবক ৩০ এপ্রিল স্থানীয় ইউরোপীয় ক্লাবের গেটের কাছে একটি গাছের আড়ালে অতর্কিত আক্রমণের জন্য ওত পেতে থাকেন। কিন্তু অত্যাচারী ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডের গাড়ির মতো অন্য একটি গাড়িতে ভুলবশত বোমা মারলে গাড়ির ভেতরে একজন ইংরেজ মহিলা ও তাঁর মেয়ে মারা যান। এই ঘটনার পর ক্ষুদিরাম ওয়ানি রেলস্টেশনে পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। তিনি বোমা নিক্ষেপের সমস্ত দায়িত্ব নিজের উপর নিয়ে নেন। তখন ক্ষুদিরামের বয়স ছিল ১৮ বছর ৭ মাস ১১ দিন। তিনি কনিষ্ঠতম বিপ্লবী হিসেবে সম্মানিত। অন্যদিকে প্রফুল্ল চাকি গ্রেপ্তারের আগেই আত্মহত্যা করেন। কিন্তু অপর কোনো সহযোগীর পরিচয় দিতে বা কোনো গোপন তথ্য প্রকাশ করতে রাজি হননি।১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ থেকে আন্দোলন ১৯০৮ সাল পর্যন্ত চলমান ছিল। এ আন্দোলন ছিল গান্ধী-পূর্ব আন্দোলনসমূহের মধ্যে সর্বাপেক্ষা সফল। প্রাথমিক পর্যায়ে সংবাদপত্রে বিবৃতি প্রদান, অসংখ্য সভা-সমাবেশ অনুষ্ঠিত ও স্মারকলিপি পেশ করে এবং ১৯০৪ সালের মার্চ ও ১৯০৫ সালের জানুয়ারি মাসে কলকাতা টাউন হলে অনুষ্ঠিত বিশাল সম্মেলন প্রভৃতি নরমপন্থী উপায়ে বঙ্গভঙ্গ পরিকল্পনার বিরোধিতা করা হয়েছিল। এ সকল কৌশলের সার্বিক ব্যর্থতা নতুন ধরনের বিরোধিতা যথা ব্রিটিশ পণ্য বর্জন, রাখি বন্ধন, অরন্ধন ইত্যাদি পন্থা অনুসন্ধানে বঙ্গভঙ্গ বিরোধীদের অনুপ্রাণিত করে।

তাত্ত্বিকভাবে, স্বদেশী আন্দোলনের মধ্যে দুটি মূলধারা শনাক্ত করা যেতে পারে ‘গঠনমূলক স্বদেশী’ এবং ‘রাজনৈতিক চরমপন্থা’। স্বদেশী আন্দোলনকে সফল করার জন্য ‘বর্জননীতি’ ছিল মূল হাতিয়ার। ‘গঠনমূলক স্বদেশী’ ছিল স্বদেশী শিল্পকারখানা, জাতীয় স্কুল, গ্রাম উন্নয়ন ও সংগঠন গড়ার প্রচেষ্টার মাধ্যমে আত্মসংস্থানের ধারা। প্রফুল্ল­চন্দ্র রায় অথবা নীলরতন সরকারের ব্যবসায়িক উদ্যোগ, সতীশচন্দ্র মুখার্জী কর্তৃক প্রবর্তিত জাতীয় শিক্ষা আন্দোলন এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক চিত্রিত ঐতিহ্যবাহী হিন্দু সমাজের পুনর্জাগরণের মাধ্যমে গ্রামসমূহে গঠনমূলক কাজের ভেতর দিয়ে এটা প্রকাশ লাভ করে। পুনর্গঠন প্রচেষ্টায় অশ্বিনীকুমার দত্তের স্বদেশ বান্ধব সমিতিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এরূপ অবস্থাকে রবীন্দ্রনাথ আত্মশক্তির উন্নয়ন বলে অভিহিত করেছেন।

রাজনৈতিক চরমপন্থী আদর্শের প্রতি অধিকতর আকৃষ্ট বাংলার উত্তেজিত শিক্ষিত যুবকদের কাছে এর আবেদন অতি সামান্যই ছিল। গঠনমূলক স্বদেশী প্রচারকদের সঙ্গে তাদের মৌলিক পার্থক্য ছিল পন্থা-পদ্ধতি নিয়ে। ১৯০৭ সালের এপ্রিলে অরবিন্দ ঘোষের পর পর প্রকাশিত কয়েকটি নিবন্ধে এ বিষয়ে বিশদ বিবরণ পাওয়া যায়। পরবর্তীকালে নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ মতবাদ (Doctrine of Passive Resistance) নামে এগুলি পুনর্মুদ্রিত হয়। তিনি ‘সুসংগঠিত ও অব্যাহতভাবে ব্রিটিশ পণ্যের বর্জন, আনুষ্ঠানিক কর্তৃত্বমূলক শিক্ষা, বিচার এবং নির্বাহী প্রশাসন’ সংক্রান্ত কর্মসূচি উপলব্ধি করেন স্বদেশী শিল্প-কারখানা, স্কুল ও সালিশি আদালতের ইতিবাচক উন্নয়ন দ্বারা সমর্থিত। একই সঙ্গে আইন অমান্য আন্দোলন, রাজভক্তদের সামাজিকভাবে বর্জন এবং ব্রিটিশের নিপীড়ন সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেলে সশস্ত্র সংগ্রামের আশ্রয় গ্রহণের অভীপ্সাও তাঁর ছিল।

আধুনিকতাবাদী এবং হিন্দু পুনর্জাগরণবাদী ধারার মধ্যে সাংস্কৃতিক মতাদর্শ নিয়ে আরেকটি বিতর্ক সৃষ্টি হয়। সাধারণভাবে স্বদেশী মনোভাব ধর্মীয় পুনর্জাগরণের সঙ্গে রাজনীতিকে সংশ্লিষ্ট রাখার প্রচেষ্টায় ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত ছিল। সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী দাবি করতেন যে, মন্দিরসমূহে স্বদেশী শপথ পদ্ধতি ব্যবহারকারী তিনিই প্রথম ব্যক্তি। জাতীয় শিক্ষা পরিকল্পনায় প্রায়শ শক্তিশালী পুনর্জাগরণবাদী উপকরণ অন্তর্নিহিত ছিল এবং বর্জনকে কার্যকর করার চেষ্টা করা হয়েছিল ঐহিত্যবাহী বর্ণপ্রথার বিধিনিষেধের মাধ্যমে। বন্দে মাতরম, সন্ধ্যা বা যুগান্তরের পাতায় এরূপ আগ্রাসী হিন্দুবাদ প্রায়ই অচ্ছেদ্যভাবে সংযুক্ত থাকত, অথচ সঞ্জীবনী বা প্রবাসীর মতো ব্রাহ্ম পত্রিকাসমূহে এই মতের সমালোচনা করা হতো।

হিন্দু পুনর্জাগরণবাদী ধারার সঙ্গে নতুন প্রদেশ মুসলমানদের জন্য অধিকতর চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করবে এ ধরনের ব্রিটিশ প্রচারণা যুক্ত হয়ে উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মুসলমানদের স্বদেশী আন্দোলন-বিরোধী করে তুলতে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করে। সাম্প্রদায়িক ঐক্যের জন্য গজনবী, রসুল, দীন মোহাম্মদ, দীদার, লিয়াকত হোসেন প্রমুখ স্বদেশী আন্দোলনে বিশ্বাসী মুসলমানদের একটি সক্রিয় গ্রুপের আবেগঘন আবেদন সত্ত্বেও পূর্ববঙ্গে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হয়েছিল। হিন্দু জমিদার এবং মহাজনদের মধ্যে যারা মূর্তি সংরক্ষণের জন্য ‘ঈশ্বরবৃত্তি’ নামক দস্ত্তরি আরোপ করতে শুরু করেছিল তারাই এই দাঙ্গার লক্ষ্যে পরিণত হয়েছিল। সুতরাং বাংলায় মুসলমান সম্প্রদায়ের এক বিরাট অংশ স্বদেশী আন্দোলন হতে বিরত থাকে এবং মধ্যপন্থী বা চরমপন্থী রাজনীতিতে বিশ্বাসী হিন্দু ভদ্রলোকগণ এ আন্দোলনে অগ্রগামী ভূমিকা গ্রহণ করে।

আন্দোলনটির স্বতঃস্ফূর্ততার এরূপ একটি সীমাবদ্ধতা রবীন্দ্রনাথ এবং অন্যান্য বিদগ্ধজনের চোখে ধরা পড়েছিল। রবীন্দ্রনাথ যদিও কয়েক বছর ধরে পুনর্জাগরণবাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন, কিন্তু সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদের ফলে ১৯০৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে গভীর উপলব্ধি থেকে পরপর প্রকাশিত কয়েকটি নিবন্ধে তিনি উল্লেখ করেন যে, দাঙ্গার জন্যে ব্রিটিশদের শুধু দোষারোপ করা ছিল এক অপর্যাপ্ত প্রতিক্রিয়া।

এ সকল সাংস্কৃতিক সীমাবদ্ধতার সঙ্গে সঙ্গে সাধারণভাবে বুর্জোয়া আকাঙ্ক্ষা সম্বলিত কিন্তু প্রকৃত বুর্জোয়াদের বাস্তব সমর্থন ছাড়া ব্রিটিশপণ্য বর্জন ও স্বদেশী আন্দোলনের ইতিহাস বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা বিস্তারিতভাবে তুলে ধরে। বর্জন নীতি প্রাথমিক পর্যায়ে কিছু সাফল্য অর্জন করে ১৯০৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কলকাতার কাস্টমস্ কালেক্টর ম্যানচেস্টার কাপড়ের বিক্রয়ে কিছু পড়তিভাব লক্ষ্য করেন। এ অবনতি কলকাতার মাড়োয়ারি ব্যবসায়ী এবং ব্রিটিশ উৎপাদকদের মধ্যে বাণিজ্যিক শর্তাদির ক্ষেত্রে বিবাদ সৃষ্টিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। এটিও গুরুত্বপূর্ণ যে, ভারতীয় মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ব্যবহূত সামগ্রীসমূহের মধ্যে জুতা এবং সিগারেটের চাহিদাই সবচেয়ে বেশি হ্রাস পায়।

এরূপ সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও স্বদেশী মতবাদ তাঁত শিল্প, রেশম বয়ন এবং আরও কতিপয় ঐতিহ্যবাহী কারুশিল্পে উল্লেখযোগ্য পুনর্জাগরণ সাধন করতে সক্ষম হয়েছিল। আধুনিক শিল্পের বিকাশ ঘটাতেও বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছিল। এভাবে ১৯০৬ সালের আগস্ট মাসে বঙ্গলক্ষ্মী কটন মিল প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং পোর্সেলিন, ক্রোম, সাবান, ম্যাচ ও সিগারেট-এর ক্ষেত্রেও কয়েকটি সফল উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়।

স্বদেশী বাংলায় জাতীয় শিক্ষা প্রচেষ্টার মধ্যে উল্লেখযোগ্য বৈচিত্র্য দেখা যায়। এ জাতীয় শিক্ষা প্রচেষ্টা মাতৃভাষার মাধ্যমে কারিগরি শিক্ষা

তাঁকে মৃত্যুদন্ড প্রদান করা হয়। প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য অনুসারে মুজফ্ফরপুর কারাগারে ১৯০৮ সালের ১১ আগস্ট ফাঁসিতে তাঁর মৃত্যৃ হয়। “একবার বিদায় দে মা ভারতবাসী “– অশ্রুসিক্ত সেই গান আজও এই সাহসী বীর বাঙালী বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসু নিঃস্বার্থ দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগ চিরসম্মরণীয়।

Previous articleAndaman & Nicobar Islands’কালাপানির লৌহকপাট’,যেখানে মৃত বন্দিদের দেহ ছুড়ে ফেলা হত সমুদ্রে
Next articleR G Kar Hospital Incident খুনের পর পুলিশ ব্যারাকে ঘুমিয়েছিল সঞ্জয়! অন্য কারও উপর সন্দেহ থাকলে পুলিশকে জানান, বললেন পুলিশ কমিশনার

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here