আরজি কর-কাণ্ডে ওই হাসপাতালের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষকে একাধিকবার তলব করেছে সিবিআই। তাঁর বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ উঠছে।আরজি কর-কাণ্ডের সময় তিনিই ছিলেন এই মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ।
আরজি করের মহিলা চিকিৎসকের ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনার পর থেকেই তিনি গোটা দেশবাসীর নজরে। পুরো ঘটনায় তাঁর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে বিভিন্ন মহলে। অভিযোগ উঠেছে তাঁর ‘প্রভাবশালী’ হওয়ারও। তিনি সন্দীপ ঘোষ। আর তাতেই ক্ষুব্ধ বনগাঁ হাইস্কুলের প্রাক্তন শিক্ষক থেকে শুরু করে সন্দীপ ঘোষের স্কুলের সিনিয়ররাও।
আরজি করের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপের জীবনযাত্রা শুরু হয়েছিল উত্তর ২৪ পরগনার বনগাঁ শহর থেকে। ১৯৮৯ সালে বনগাঁ হাই স্কুল থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন তিনি। ১৯৮৯ সালের উচ্চ মাধ্যমিকে তিনি ৭৯.৭ শতাংশ নম্বর পেয়ে স্কুলে প্রথম তিন জনের মধ্যে জায়গা করে নেন।
ইতিমধ্যে ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ পদ থেকেও সন্দীপ ঘোষকে সরানোর বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হয়েছে। তিলোত্তমার নাম প্রকাশ্যে বলে দেওয়া থেকে আর্থিক তছরূপের মতো গুরুতর অভিযোগ উঠেছে তাঁর বিরুদ্ধে। এই পরিস্থিতিতে কার্যত ক্ষুব্ধ সন্দীপের এক সময়ের সহপাঠী থেকে শুরু করে স্কুলের প্রাক্তনীরাও। বনগাঁ উচ্চ বিদ্যালয়ের কৃতি ছাত্রদের তালিকার বোর্ড থেকে সন্দীপ ঘোষের নাম মুছে দেওয়ার জন্যে স্কুলের প্রধান শিক্ষকের কাছে লিখিত আবেদন জানিয়েছেন প্রাক্তন ছাত্ররা।
সন্দীপ ঘোষ বনগাঁ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র। ১৯৮৯ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে এখান থেকে। উচ্চমাধ্যমিকে বনগাঁ উচ্চ বিদ্যালয় মধ্যে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করায় স্কুলের কৃতি ছাত্রদের তালিকার বোর্ডে নাম রয়েছে তাঁর। বুধবার বনগাঁ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন এবং বর্তমান ছাত্ররা প্রধান শিক্ষক কুনাল দে-এর কাছে একটি লিখিত আবেদন জমা দেন। তাঁদের দাবি কৃতি ছাত্রদের তালিকার বোর্ড থেকে সন্দীপের নাম মুছে দেওয়া হোক।
স্কুলের প্রাক্তন ছাত্রদের দাবি, বনগাঁ উচ্চ বিদ্যালয় বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্কুল। সন্দীপ ঘোষের নামে তাঁরা চিনতে চান না। তাই ওনার নাম মুছে দেওয়ার জন্য আবেদন জানিয়েছেন। প্রদীপ দে নামে এক প্রাক্তনী বলেন, “আমরা যাঁরা এখানে আছি তাঁরা কোনও না কোনও বছরের প্রাক্তন ছাত্র। এই সন্দীপ ঘোষ কোনও না কোনও ভাবে স্কুলের সঙ্গে যুক্ত। আজ তাকে রাজ্য পুলিশ ডাকছে, সিবিআই তলব করছে। সেই কারণে আমাদের আর্জি স্কুলের কাছে ওঁর নাম কৃতি ছাত্রদের বোর্ডে না থাকে। কোথাও গিয়ে বনগাঁ হাইস্কুলের গৌরব নষ্ট করছে।”
বনগাঁ হাইস্কুলের শিক্ষক চন্দন ঘোষ বলেন, ‘ও অত্যন্ত মেধাবী ছিল। সেই সময় ডাক্তারিতে সুযোগ পাওয়া অত্যন্ত কঠিন ছিল। ওর বিষয়ে অভিযোগগুলো এখন জানতে পারছি। যদি ওর দোষ প্রমাণিত হয় তাহলে শাস্তির দাবি করব।’
আবেদনপত্র জমা নেওয়ার পরে বনগাঁ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কুনাল দে জানিয়েছেন, প্রাক্তন ছাত্ররা একটা আবেদনপত্র জমা দিয়েছে । সন্দীপ ঘোষ যদি দোষী সাব্যস্ত হন তখন স্কুলের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক, প্রাক্তন ছাত্র ও স্কুল পরিচালনা সমিতির সঙ্গে বৈঠক করবার পরে যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার নেওয়া হবে ।
১৯৯৪ সালে এমবিবিএস ডিগ্রি অর্জন করেন সন্দীপ। প্র্যাকটিসও শুরু করেন। সেখান থেকেই উত্থান। কর্মজীবনে চিকিৎসাক্ষেত্রের বিভিন্ন পদে কর্তব্যরত ছিলেন সন্দীপ।
তবে ২০২১ সালে আরজি করের অধ্যক্ষ হিসাবে নিযুক্ত হওয়ার পর থেকে পরিচিতি আরও বাড়ে সন্দীপের। ঘটনাচক্রে যে কলেজ থেকে তিনি ডাক্তারি পড়েন, সেখানকারই অধ্যক্ষ হয়ে যোগ দিয়েছিলেন।
আরজি কর মেডিক্যাল কলেজে যোগ দেওয়ার আগে ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে উপাধ্যক্ষ ছিলেন সন্দীপ। ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ থেকে পদোন্নতির পর আরজি করে আসেন তিনি।
একজন অর্থোপেডিক সার্জন এবং অধ্যাপক হওয়া সত্ত্বেও, পেশাগত বিভিন্ন অনিয়মের কারণে বিশেষ সুখ্যাতি প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি সন্দীপ। আর সে কারণেই আরজি করের অধ্যক্ষ হওয়ার পর বিতর্কের মুখে পড়েন তিনি।
২০২৩ সালের জুনে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে সন্দীপের বিরুদ্ধে। সম্প্রতি ২০২১ সালের জানুয়ারি মাস থেকে আরজি কর মেডিক্যাল কলেজে যে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে, তার তদন্তে একটি সিট গঠনের নির্দেশ দিয়েছে নবান্ন। অধ্যক্ষ থাকাকালীন সন্দীপ ঘোষের বিরুদ্ধে স্বজনপোষণ ছাড়াও সরকারি অর্থ নয়ছয়ের অভিযোগ ওঠে। ল্যাব টেকনিশিয়ান নিয়োগের ক্ষেত্রেও সন্দীপের বিরুদ্ধে উঠেছে স্বজনপোষণের অভিযোগ। অবৈধ ভাবে ইন্টার্ন নিয়োগের অভিযোগও রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। ঘটনাচক্রে, এই তিন বছরের বেশির ভাগ সময়ে কলেজের দায়িত্বে ছিলেন সন্দীপই।
আরজি কর হাসপাতালের ছাত্রাবাসের র্যাগিং বিতর্কে জড়িয়ে বদলিও হয়েছিলেন সন্দীপ। প্রথম বার আরজি কর হাসপাতালের অধ্যক্ষের চেয়ার থেকে সরিয়ে তাঁকে পাঠানো হয় মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজে। সে বার তিনি ফিরে এসেছিলেন মাত্র ৪৮ ঘণ্টার ব্যবধানে। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে আবার বদলি। সে বার মাত্র ২১ দিনের মাথায় তিনি ফিরে আসেন।
সুত্রের খবর,কোভিডের সময় অত্যাধুনিক যন্ত্র কিনেছিল আরজি কর হাসপাতাল। খরচ হয়েছিল ৪ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা। পরে জানা যায়, এই যন্ত্রের বাজারমূল্য ১ লক্ষ ৬০ হাজার টাকা। সন্দীপ ঘোষ নাকি টেন্ডারের ক্ষেত্রেও নিজের প্রভাব খাটিয়েছিলেন।
এবার আরজি করের চিকিৎসক খুনের ঘটনা নিয়ে যখন বড় বিক্ষোভ শুরু হয়, তখন নিজেই পদত্যাগ করেন সন্দীপ। তবে সে দিনই ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্বও পেয়ে যান। এ নিয়েও বিতর্কের জল গড়িয়েছে বহুদূর । যদিও কলকাতা হাই কোর্টের নির্দেশে অনির্দিষ্ট কালের জন্য ছুটিতে যেতে হয়েছে আরজি করের সদ্যপ্রাক্তন অধ্যক্ষকে।
কতটা ক্ষমতাবান হলে পদত্যাগের ৪ ঘণ্টার মধ্যেই তাঁকে আবার নিয়োগ দেওয়া হয়! এটা কী ভাবে সম্ভব? এমনটাই প্রস্ন ছিল আদালতের । প্রধান বিচারপতি টি শিবজ্ঞানম এবং বিচারপতি হিরণ্ময় ভট্টাচার্যের বেঞ্চ স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, সন্দীপ ঘোষকে এখনই ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব দেওয়া যাবে না।
এর পর থেকেই সন্দীপকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই। বৃহস্পতিবার তাঁকে সপ্তমবার সিজিও কমপ্লেক্সে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন তদন্তকারীরা।
আরজি করে ডাক্তার ছাত্রীর খুন ও ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে যেমন নানা প্রশ্ন উঠে এসেছে সেই সঙ্গে হাসপাতালের কর্তাব্যক্তিদের ‘কর্তব্যে গাফিলতি’ এবং তা ‘আড়াল করার চেষ্টা’র অভিযোগ নিয়েও নানা তথ্য প্রকাশ্যে এসেছে। আরজি করের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ যা বলছেন, তার গরমিল খুঁজে বার করতে পলিগ্রাফ পরীক্ষা করানোর কথাও ভাবছে সিবিআই। এমনটাই জানা গিয়েছে সূত্র মারফত।
আরজি করে আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগে সন্দীপের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের অনুমতিও দিয়েছে কলকাতা হাই কোর্ট। আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগে সরকারি নিষ্ক্রিয়তা এবং ইডি তদন্তের দাবিতে কলকাতা হাই কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলেন হাসপাতালেরই এক প্রাক্তন পদাধিকারী। বুধবার বিষয়টিতে কলকাতা হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি টিএস শিবজ্ঞানমের দৃষ্টি আকর্ষণ করে দ্রুত শুনানির আবেদন করা হয়। প্রধান বিচারপতি সেই অনুরোধে সাড়া দিয়েছেন।
এবার সুপ্রিম কোর্টেও উঠে এল আরজি কর হাসপাতালের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষের আর্থিক দুর্নীতির প্রসঙ্গ। সিসিটিভি লাগানোর জন্য ১৪ লক্ষ টাকা দাবি করলেও, সেই সিসিটিভি বসানোই হয়নি হাসপাতালে, এমনটাই অভিযোগ করেন মামলাকারীর আইনজীবী।
তিলোত্তমা হত্যাকাণ্ড নিয়ে স্বতপ্রণোদিত মামলা হয়েছে সুপ্রিম কোর্টে। আজ, সুপ্রিম কোর্টে এই মামলার দ্বিতীয় দিনের শুনানিতে আইনজীবী করুণা নন্দী অভিযোগ করেন, প্রাক্তন অধ্যক্ষ আরজি কর হাসপাতালে ১৪ লক্ষ টাকার সিসিটিভি ইনস্টল করেননি। যদি সিসিটিভি থাকত, তাহলে এই ঘটনা ট্র্যাক করা সম্ভব হত।
আইনজীবী নন্দী সওয়াল করেন, “আমরা পাঁচ চিকিৎসকদের প্রতিনিধি দলকে সামনে এনেছি। যাঁরা সন্দীপ ঘোষের বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ সংক্রান্ত বিষয়ে কিছু তথ্য দেবেন। পাশাপাশি এই খুন ও ধর্ষণের ঘটনা প্রসঙ্গেও কিছু তথ্য দেবেন। এর পিছনে একটা প্রাতিষ্ঠানিক সমঝোতা রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, “এই সন্দীপ ঘোষই হাসপাতালে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানোর ভাড়া বাবদ ১৪ লক্ষ টাকা দাবি করেছিলেন। কিন্তু হাসপাতালে এত সিসিটিভি লাগানোই হয়নি। আমি এই বিষয়টি রাজ্য সরকারের গঠিত সিটেরও ভূমিকার বিষয়েও দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। কারণ সিট এই একই ব্যক্তি সন্দীপ ঘোষের বিরুদ্ধে ওঠা আর্থিক দুর্নীতি অভিযোগের তদন্ত করেছিল।”
প্রসঙ্গত, গত শুনানিতেও আরজি কর হাসপাতালের প্রাক্তন অধ্যক্ষ ডঃ সন্দীপ ঘোষকে নিয়ে একাধিক প্রশ্ন উঠেছিল। বিক্ষোভের মুখে পড়ে আরজি কর হাসপাতালের অধ্যক্ষ পদ থেকে ইস্তফা, বিকেলেই ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে তাঁর পুনর্বহাল নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন প্রধান বিচারপতি। সেই সময় রাজ্য জানিয়েছিল, তাঁকে অনির্দিষ্ট ছুটিতে পাঠানো হয়েছে। গতকাল, বুধবার ন্যাশনাল মেডিক্য়াল কলেজের অধ্যক্ষ পদে নিয়োগও বাতিল করা হয় ডঃ সন্দীপ ঘোষের।
এদিকে আরজি করের ঘটনা নিয়ে আবার মুখ খুললেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। এ বিষয়ে তাঁর ‘নীরবতা’ নিয়ে জল্পনার মধ্যেই বৃহস্পতিবার সকালে সমাজমাধ্যমে একটি পোস্ট করেন অভিষেক। সেখানে তিনি পশ্চিমবঙ্গ-সহ দেশের সমস্ত রাজ্যের সরকারকে অনুরোধ করেছেন ধর্ষণ বিরোধী কঠোর আইন বলবৎ করার বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারকে ‘চাপ’ দিতে। অভিষেক বলেছেন, ‘‘এমন কঠোর ধর্ষণ বিরোধী আইন আনতে হবে, যা ঘটনার ৫০ দিনের মধ্যে অপরাধীকে চিহ্নিত করে দোষী সাব্যস্ত করা নিশ্চিত করবে এবং তাতে দোষীকে কঠোরতম সাজা দেওয়ার নিদান থাকবে।’’
আরজি করের ঘটনার পর এই নিয়ে দ্বিতীয় বার মুখ খুললেন অভিষেক। গত ৯ অগস্ট ভোরে আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ এবং হাসপাতালে এক মহিলা চিকিৎসককে ধর্ষণ করে খুনের অভিযোগ ওঠে। সেই ঘটনার পাঁচ দিন পরে ১৪ অগস্ট মাঝরাতে অভিষেক প্রথম ওই বিষয়ে মন্তব্য করেন। তার সাত দিন পরে আবার বৃহস্পতিবার সকালে অভিষেক লিখলেন। তবে এ বার আরজি করের ঘটনার থেকেও বেশি তিনি জোর দিয়েছেন গোটা দেশে নিরন্তর ঘটে চলা ধর্ষণের ঘটনা নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে।