হাওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে ‘ছেলেধরা’র খবর। হাওয়া বইছে উত্তর ২৪পরগনার নানা প্রান্তে। মহিলা-পুরুষ নির্বিশেষে ছেলেধরা গুজবে প্রতিদিন আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে।বারাসতের কাজীপাড়া, ব্যারাকপুর, বনগাঁ, অশোকনগর, গাইঘাটা, দেগঙ্গা। এক সপ্তাহের মধ্যেই একটা ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতে আরেকটি ঘটনা। জনরোষের শিকার হচ্ছেন ভবঘুরে থেকে মানসিক ভারসাম্যহীন মহিলা, যাঁরা অনেকেই এলাকায় পরিচিত মুখ নন, তবে কি এটুকুই কারণ?
নাকি সমাজমাধ্যমের গুজবেই অস্থিরতা উঠছে প্রশ্ন!
দেশের সময় ,বনগাঁ : ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনির ঘটনায় যেন কিছুতেই রাশ টানা যাচ্ছে না। পুলিশ-প্রশাসন লাগাতার প্রচার চালালেও স্রেফ সন্দেহের বশে গণপিটুনির ঘটনা যেন বেড়েই চলেছে। বারাসাত, অশোকনগর, ব্যারাকপুরের মোহনপুরের পর এ বার এই তালিকায় যুক্ত হলো বনগাঁ এবং গাইঘাটার নাম৷ বনগাঁর ঘটনায় পুলিশ ইতিমধ্যেই ছ’জনকে গ্রেপ্তার করেছে। অন্য দিকে, গাইঘাটার ঘটনায় অভিযুক্তদের শনাক্তকরণের চেষ্টা চালাচ্ছে পুলিশ।
শনিবার রাতে প্রথম গুজবটি ছড়ায় বনগাঁ পুরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ঠাকুরপল্লিতে। এক ভবঘুরেকে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনি দেয় স্থানীয় জনতা। আক্রান্ত যুবক ঠাকুরপল্লি এলাকায় রাতে ঘোরাঘুরি করছিলেন। তাতে সন্দেহ হয় কয়েক জনের। কেউ কেউ তাঁকে ছেলেধরা ভেবে সন্দেহ করতে শুরু করেন। মুখে মুখে তা ছড়িয়ে পড়তেই ছেলেধরা গুজব রটে যায়। জড়ো হয়ে যান এলাকার লোকজন।
স্রেফ সন্দেহের বশে এরপর ওই ভবঘুরে যুবককে বেধড়ক মারধর করা হয়। এতটাই মারা হয় যে, উঠে বসার শক্তিটুকুও ছিল না আক্রান্ত যুবকের। খবর পেয়ে তড়িঘড়ি বনগাঁ থানার পুলিশ গিয়ে ওই যুবককে উদ্ধার করে বনগাঁ মহকুমা হাসপাতালে ভর্তি করে। ভবঘুরেকে মারধরের সেই ছবি ইতিমধ্যেই ভাইরাল হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। একদিকে সন্দেহের বশে মারধর করা এবং অন্যদিকে মারধরের সেই ছবি ভাইরালের অভিযোগে ছ’জনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে।
বনগাঁ ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলার বন্দনা দাস কীর্তনীয়া বলেন, ‘আমি রাতে বিষয়টি জানা মাত্র পুলিশকে খবর দিয়েছিলাম। পুলিশ ভবঘুরে ওই যুবককে উদ্ধার করে বনগাঁ মহকুমা হাসপাতালে ভর্তি করেছে। যারা মারধর করেছে ঠিক করেনি। সাধারণ মানুষকে বলব গুজবে কান না দিতে।’ সন্দেহভাজন কাউকে দেখলে পুলিশ-প্রশাসনকে জানানোর আবেদন জানিয়েছেন কাউন্সিলার।
বনগাঁ উত্তরের বিজেপি বিধায়ক অশোক কীর্তনিয়া বলেন, ‘ঘটনাটি অনভিপ্রেত। মারধর করা উচিত হয়নি। পুলিশের আরও আগে থেকে এই গুজব নিয়ে প্রচারে নামা উচিত ছিল। আমি আমার মতো করে অবশ্য সচেতনতা প্রচার চালাচ্ছি।’
গণধোলাইয়ের ঘটনা ঘটেছে গাইঘাটায় বেড়ি গোপালপুরেও। এখানেও ছেলেধরা সন্দেহে মানসিক ভারসাম্যহীন ভবঘুরে এক যুবককে মারধর করে আটকে রাখেন গ্রামবাসীরা। খবর পেয়ে গাইঘাটা থানার পুলিশ গিয়ে ওই যুবককে উদ্ধার করে। স্থানীয়দের অভিযোগ, গত দু-তিন দিন ধরে এলাকায় ঘোরাঘুরি করছিলেন ওই যুবক। এদিন বেড়ি মোড়ে একটি বাড়ির সামনে ঘুরঘুর করছিলেন ওই যুবক।
অভিযোগ, ইশারায় নাকি বাড়ির ভিতর থেকে একটি বাচ্চাকে ডাকছিলেন। তাতেই ছেলেধরা সন্দেহে প্রথমে চিৎকার-চেঁচামেচি, পরে ওই যুবককে বেদম মারধর করা হয়।
জেলা জুড়ে পর পর এমন ঘটনায় প্রশ্ন উঠছে, পুলিশ প্রশাসনের মাইকিং, লিফলেট বিলি, সচেতনতা শিবিরের পরেও বিভিন্ন জায়গায় স্ফুলিঙ্গের মতো ‘ছেলেধরা’র গুজব ও তাকে ঘিরে মারধরের ঘটনা কেন বাড়ছে? শিশু পাচার নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরে কাজ করা ব্যারাকপুর কমিশনারেটের আধিকারিকেরা মূলত দায়ী করছেন সমাজমাধ্যমকেই।
পুলিশের বক্তব্য, সন্দেহের বশেই ভবঘুরে ওই যুবককে মারধর করেছে এলাকার কিছু অতি উৎসাহী লোকজন। যারা মারধর করেছে তাদের শনাক্তকরণের কাজে নেমেছে পুলিশ। সেইসঙ্গে এলাকায় মাইকে প্রচারও শুরু হয়েছে।
শুক্রবারের ঘটনাতেও প্রশান্ত দাস নামে এক ব্যক্তিকে মারধরের ছবি-সহ এই ঘটনায় উল্লাস প্রকাশ করে সমাজমাধ্যমে পোস্ট করতে দেখা গিয়েছে। তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, গত কয়েক দিনে অন্তত সাতটি নাবালিকার ছবি দিয়ে নিখোঁজের পোস্ট দেখা গিয়েছে সমাজমাধ্যমে। অথচ পুলিশের কাছে সেই বিষয়ে একটিও নিখোঁজের ডায়েরি হয়নি!
অনেকেই বলছেন, ‘ছেলেধরা’ এলাকায় রয়েছে, এটা এখন হাওয়ায় ভাসছে। সমাজমাধ্যমেই পাল্টা জবাব দিতে হবে সকলকে, সন্দেহ হলে সঙ্গে সঙ্গে পুলিশকে জানানোর কথা বলতে হবে।
বনগাঁয় মহকুমায় জোড়া গণপিটুনি নিয়ে সাংবাদিক সম্মেলন করেন এসডিপিও অর্ক পাজা। তিনি বলেন, ‘বনগাঁর ঘটনায় এখনও পর্যন্ত ছ’জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং গাইঘাটা ঘটনায় দোষীদের চিহ্নিত করার কাজ চলছে। যারা গুজব ছড়াচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
বনগাঁর পুর প্রধান গোপাল শেঠ বলেন, ‘‘এই সবের পিছনে অন্য কারণ আছে কি না, দেখা হচ্ছে। মানুষকে আমরা বার বার বোঝাচ্ছি, গুজবে কান না দিয়ে সন্দেহ হলে পুলিশকে জানান। সমাজমাধ্যমে যারা গুজব ছড়াচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধেও কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’’
উল্টো ছবি দেখা গেল দেগঙ্গায়। নন্দীপাড়া গ্রামের মুদিপাড়ায় এদিন বসিরহাটের বাসিন্দা মমতাজ বিবি নামে এক মহিলাকে ছেলেধরা সন্দেহে আটকে রেখে বাসিন্দারা পুলিশে খবর দেন। কেউ আইন নিজের হাতে তুলে নেননি। পুলিশ গিয়ে ওই মহিলাকে উদ্ধার করে। পুলিশ জানিয়েছে, ওই মহিলা মানসিক ভারসাম্যহীন।