কলকাতা :আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে তরুণী ডাক্তারের ধর্ষণ ও খুন নিয়ে কড়া প্রতিক্রিয়া দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই ঘটনা ন্যক্কারজনক বলে দাবি করে তিনি বলেন, তিনি অপরাধীর ফাঁসির দাবি করছেন!
মুখ্যমন্ত্রী এদিন বলেন, ‘আমি মামলাটি ফাস্ট ট্র্যাক আদালতে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছি। যদিও আমি মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে নই, তবে এক্ষেত্রে প্রয়োজনে অভিযুক্তদের ফাঁসি দেওয়া হবে। তাদের কঠোরতম শাস্তি পাওয়া উচিত।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের যেমন দায়িত্ব আছে, তেমনি হাসপাতালের সুপারেরও দায়িত্ব আছে। কোনও দিক থেকে তাঁর গাফিলতি আছে কিনা, তাও খতিয়ে দেখব আমরা।’
পাশাপাশি তিনি বলেন, ‘সিবিআই তদন্ত হোক বা যে কোনও তদন্ত হোক, আমাদের কোনও আপত্তি নেই। কারণ রাজ্য সরকারের কিছু লুকোনোর নেই। আমি স্পষ্টভাবে বলছি, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।’
এই ঘটনায় ইতিমধ্যেই তোলপাড় সারা দেশের চিকিৎসক সংগঠনে। ঘটনার তীব্র নিন্দা করে অবিলম্বে সারা দেশের প্রতিটি মেডিক্যাল কলেজে কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা আইন লাগু করার দাবি তুলেছে ন্যাশনাল মেডিক্য়াল অর্গানাইজেশন।
মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, ‘প্রথমত, ঘটনাটি দুর্ভাগ্যজনক এবং চরম ঘৃণ্য। এটা আমার কাছে ব্যক্তিগত ক্ষতির মতো। এই পরিস্থিতিতে চিকিৎসকদের ক্ষোভ ও দাবি ন্যায্য। আমি তাঁদের প্রতিবাদ সমর্থন করি। পুলিশও তাঁদের দাবি মেনে নিয়েছে। ইতিমধ্যে একজন অভিযুক্তকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আমরা নিশ্চিত করছি, যে প্রতিবাদকারী চিকিৎসকদের যেন কোনও ধরনের সমস্যা না হয়।’
গতকালই আরজিকরে কতর্ব্যরত ডাক্তারি পড়ুয়াকে নৃশংসভাবে খুনের ঘটনার খবর পেয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ফোন করে কথা বলেছিলেন মৃত ছাত্রীর বাবার সঙ্গে। তদন্তের আশ্বাস তখনই দিয়েছিলেন তিনি। ওই ছাত্রীর বাবা জানান, এদিন মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে ফোন করে বলেন, কী কারণে তাঁর মেয়ের মৃত্যু হয়েছে তা খতিয়ে দেখা হবে। তদন্তে কেউ দোষী হলে, তাকে ছাড়া হবে না।
শনিবার একাধিক চিকিৎসক সংগঠনের তরফে এব্যাপারে দেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখে এই দাবির কথা জানানো হয়েছে। চিকিৎসকদের অপর আরেকটি সংগঠন রেসিডেন্ট ডক্টর্স অ্যাসোসিয়েশনের তরফে মহিলা চিকিৎসকদের শুধু দিনে ডিউটি দেওয়ার দাবি জানানো হয়েছে। অন্যদিকে আরজিকরের ঘটনায় সিবিআই তদন্তের দাবি জানিয়েছে PGIMER এর চণ্ডীগড়ের চিকিৎসকরা।
প্রসঙ্গত, ময়নাতদন্তের রিপোর্ট এখনও প্রকাশ্যে না এলেও পুলিশের একটি সূত্রের দাবি, মৃত ডাক্তারি ছাত্রীর যৌনাঙ্গ-সহ দেহের বিভিন্ন অংশে অন্তত ১০টি আঘাতের চিহ্ন রয়েছে বলে প্রাথমিক রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। ছাত্রীর বাবার লিখিত অভিযোগের ভিত্তিতে শুক্রবার রাতেই খুন ও ধর্ষণের মামলা রুজু করা হয়েছে। গ্রেফতারও করা হয়েছে এক অভিযুক্তকে।
কিন্তু চিকিৎসক সংগঠনগুলির অভিযোগ, এ ঘটনা রাতারাতি ঘটেনি। দীর্ঘদিন ধরেই নিরাপত্তায় গলদ ছিল। পুলিশ অবশ্য জানিয়েছে, তদন্তে সম্ভাব্য সবদিকই খতিয়ে দেখা হচ্ছে। আরজিকরের তরফে অবশ্য কোনও প্রতিক্রিয়া জানা যায়নি। এদিকে ঘটনার প্রতিবাদে দোষীদের কঠোর শাস্তি ও নিরাপত্তা চেয়ে কলকাতা মেডিক্যাল, ন্যাশানাল মেডিক্যাল, সাগর দত্ত মেডিক্যাল কলেজ, শিশুমঙ্গল-সহ রাজ্যের একাধিক মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে কর্মবিরতি শুরু করেছেন ডাক্তারি পড়ুয়া ও জুনিয়র চিকিৎসদের একাংশ।
সরকারি হাসপাতালে বহিরাগতদের দাপট নিয়ে আগেও একাধিকবার সরব হয়েছেন জুনিয়র ডাক্তাররা। নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন। কিন্তু লাভ হয়নি কোনও। এবার আরজিকর হাসপাতাল চত্বরে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ছাত্রীর অর্ধনগ্ন দেহ উদ্ধারের পর ফের সামনে আসে সেই অভিযোগ। শুক্রবার দিনভর তদন্তের পরে একাধিক সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে যাকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে পরে দেখা গেল সেও বহিরাগতই। যদিও একটা সূত্রের দাবি ধৃত সঞ্জয় সিভিক ভলান্টিয়ার। পড়ুয়ারা জানান, ধৃত সঞ্জয় রায় হাসপাতালের কেউ না হলেও আরজিকর মেডিক্যালের জরুরি বিভাগ থেকে চারতলা, সর্বত্রই ছিল তার অবাধ যাতাযাত। শনিবার ভয়ানক এই ঘটনা সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া দিতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রীও বললেন, “আমি বুঝতে পারছি না এত বড় সাহস পায় কোথা থেকে। আরজিকর হাসপাতালে নিয়মিত যাতায়াত ছিল অভিযুক্তের।”
এদিন অভিযুক্তের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিও চেয়েছেন তিনি। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, “আমি ফাঁসির পক্ষে নই। কিন্তু কিছুক্ষেত্রে ফাঁসি দিতে হবে। কঠোরতম শাস্তি পাওয়া উচিত।”
ধৃত সঞ্জয় রায়ের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যেই খুন, ধর্ষণ সহ ভারতীয় ন্যায় সংহিতার একাধিক ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে। শনিবার ধৃতকে আদালতে হাজির করিয়ে নিজেদের হেফাজতে নিতে চাইবেন তদন্তকারীরা। পুলিশ সূত্রে জানা যাচ্ছে, আরজিকরের চারতলার সেমিনার হলে ওই ডাক্তারি ছাত্রীর দেহের পাশেই পড়েছিল একটি ছেঁড়া তার। তদন্তে নেমে পুলিশ কর্তারা বুঝতে পারেন, ওটি একটি ব্লু টুথ হেডফোনের ছেঁড়া তারের অংশ। সেই সূত্রেই বৃহস্পতিবার রাতে যারা ডিউটিতে ছিলেন তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয়। সামনে আসে সঞ্জয় রায়ের নাম। পুলিশসূত্রে খবর সিসিটিভি ফুটেজ ঘেটে তাঁরা দেখতে পান রাত তিনটের সময় গলায় হেডফোন জড়ানো ছিল ওই যুবকের। চারটের সময় তা আর ছিল না। তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতেই এরপর তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
পুলিশের দাবি, জেরায় অভিযুক্ত নিজের অভিযোগ স্বীকার করেছে। ঘটনায় আরও কেউ জড়িত থাকতে পারে বলে পুলিশের একাংশের অনুমান। পুলিশ কর্তারা জানান, সমস্ত দিকই খতিয়ে দেখা হচ্ছে।