দেশের সময় : রাজ্যের মেডিকেল কলেজগুলিতে ডাক্তারি পড়ুয়ারা তাঁদের নামে উঠতেন, বসতেন। পান থেকে চুন খসলেই আসত ফোন। কখনও সেই ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে শোনা যেত, ‘‘আমি অভীক দে বলছি। নাম শুনেছিস? না শুনলে রুমমেটদের কাছ থেকে শুনে নিস। বড্ড বাড়াবাড়ি করছিস তুই। সাবধান হয়ে যা। না হলে একেবারে ঠাণ্ডা করে দেব। রেজিস্ট্রেশন হাতে পাবি না। যেদিন ক্যাম্পাসে ঢুকব, সেদিন টের পাবি।’’ কখনও আবার ফোনের অন্যপ্রান্ত থেকে মেডিকেল কলেজের ক্যাম্পাসে শাসানি আসত, ‘‘আমার নাম ভাল করে শুনে রাখ। আমি বিরূপাক্ষ বিশ্বাস। তোদের যম। ঠিক যা যা বলব, তাই করবি। বেশি বাড়াবাড়ি করলে হাতেনাতে ফল পাবি।’’ আরজিকরে অভয়া কাণ্ডের পর রাজ্যজুড়ে মেডিকেল কলেজগুলিতে চলা থ্রেট কালচার সামনে আসতেই যে দুই ‘পাণ্ডা’র নাম উঠে আসে, তাঁরা হলেন অভীক দে ও বিরূপাক্ষ বিশ্বাস।
তাঁদের সম্পর্কে ইতিমধ্যেই ভাইরাল হয়েছে একাধিক অডিও। যদিও সেই অডিওর সত্যতা যাচাই করেনি ‘দেশের সময়’। সামনে এসেছে ভূরি ভূরি অভিযোগ। দু’জনকেই শনিবার সিজিওতে তলব করে সিবিআই।
আলাদাভাবে জিজ্ঞাসাবাদের পাশাপাশি দু’জনকে মুখোমুখি বসিয়েও জেরা করা হয়। আর এতেই একটি প্রশ্ন সামনে এসেছে, কার নাম বললেন থ্রেট কালচারের এই দুই ‘পাণ্ডা’? যদিও থ্রেট কালচার নিয়ে তাঁদের বিরুদ্ধে ওঠা যাবতীয় অভিযোগ আগেই উড়িয়ে দিয়েছেন অভীক দে ও বিরূপাক্ষ বিশ্বাস।
শুধুই কি সন্দীপ ঘোষ? নাকি আরও অন্য কেউ? কারণ, অভীক ও বিরূপাক্ষ দু’জনেই ‘উত্তরবঙ্গ লবি’র বলে পরিচিত। তাই যদি হবে, তাহলে উত্তরবঙ্গ লবি’র মাথা কে? তা নিয়েই উঠছে প্রশ্ন। সামনে আসছে জলপাইগুড়ির চক্ষু চিকিৎসক সুশান্ত রায়ের নাম। অভিযোগ, সুশান্তবাবুর সঙ্গে অভীক ও বিরূপাক্ষের যথেষ্ট সুসম্পর্ক।
অভীক সুশান্ত রায়কে জেঠু বলে ডাকেন। আর সুশান্তবাবু কম প্রভাবশালী নন। তাঁর ইশারাতেই নাকি স্বাস্থ্য প্রশাসনে ছড়ি ঘোরাত উত্তরবঙ্গ লবি? তিনি রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিলের সহ সভাপতি। স্বাস্থ্য দফতরের উত্তরবঙ্গের প্রাক্তন ওএসডি। একটা সময় ছিল, উত্তরবঙ্গে হাসপাতালগুলিতে তাঁর নামে বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল খেত। সুশান্তবাবু অবশ্য তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা যাবতীয় অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, ‘‘উত্তরবঙ্গ লবি বলে কিছু নেই। আমার সম্পর্কে যা রটানো হচ্ছে, তা মোটেই ঠিক নয়। অভীক আমার পরিচিত। যোগাযোগও আছে। কিন্তু আমি কোনও অসৎ কাজের সঙ্গে যুক্ত নই।’’
তবে সুশান্তবাবু যাই বলুন না কেন, অভীক ও বিরূপাক্ষদের ‘মেন্টর’ হিসেবে তাঁকে চিহ্নিত করেছে চিকিৎসকদের সংগঠন আইএমএ’র বঙ্গীয় শাখা। সুশান্ত রায়কে সাসপেন্ড করেছে তারা। আইএমএ’র জলপাইগুড়ি শাখার সম্পাদক ছিলেন সুশান্তবাবু। সেখান থেকেও তাঁকে সরানোর প্রস্তাব নিয়েছেন সংগঠনের সদস্যরা। এমনকী সুশান্ত রায়ের বিরুদ্ধে ইডি’র কাছে অভিযোগ জমা পড়েছে।
সুশান্তবাবু চক্ষু চিকিৎসকদের যে সংগঠনের সদস্য, তারাও চিঠি ধরিয়েছে জলপাইগুড়ির এই চিকিৎসককে। তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা সমস্ত অভিযোগ নিয়ে উত্তর চেয়ে সময় দেওয়া হয়েছে ১৫ দিন। এই সময়ের মধ্যে সুশান্ত রায় সংগঠনের কোনও কাজে যুক্ত থাকতে পারবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছে অপথালমোলজিক্যাল সোসাইটি অফ ওয়েস্টবেঙ্গল।
এই পরিস্থিতিতে জল্পনা বাড়ছে, তাহলে সিবিআইয়ের জেরার মুখে কার বা কাদের নাম বললেন অভীক, বিরূপাক্ষ। থ্রেট কালচারের যে মাথার খোঁজ চালাচ্ছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা, সেক্ষেত্রে এবার কার হাজিরার পালা? আরজিকর কাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে আন্দোলনকারী জুনিয়র চিকিৎসকদের যে দাবিগুলি ছিল, তার মধ্যে অন্যতম মেডিকেল কলেজগুলিতে চলা থ্রেট কালচার। হুমকি, ধমকি বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি তুলেছেন জুনিয়র চিকিৎসকরা। অভীক ও বিরূপাক্ষর বিরুদ্ধে ইতিমধ্যেই অবশ্য ব্যবস্থা নিয়েছে রাজ্য সরকার।
এদিকে, গত তিনদিন ধরে জলপাইগুড়ির পাহাড়পুরের বাড়িতে নেই চিকিৎসক সুশান্ত রায়। বাড়িতে তিনি একটি চেম্বার করেন। কিন্তু বাড়ির গেটে নোটিশ ঝুলছে, তাতে লেখা ২২ তারিখ পর্যন্ত তিনি থাকবেন না। এতে প্রশ্ন উঠেছে, আচমকা কোথায় গেলেন সুশান্তবাবু? তিনি কি তদন্তের মুখে পড়ার আশঙ্কায় কোথাও আত্মগোপন করলেন? তবে সুশান্ত রায় সংবাদ মাধ্যমের কাছে দাবি করেছেন, সপরিবারে বেড়াতে গিয়েছেন তিনি। বলেছেন, ‘‘তদন্তকারী সংস্থা আমাকে ডাকবে কেন? আমি কি করেছি। আমার বিরুদ্ধে কিছু আজেবাজে কথা রটানো হচ্ছে। সব কথার উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করছি না।’’
সুশান্তবাবু যতই এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করুন না কেন, আরজিকর কাণ্ডে ঘটনার পরম্পরা পিছু ছাড়ছে না তাঁর। এর আগে ডাঃ সুশান্ত রায় নিজে স্বীকার করে নিয়েছেন, তরুণী চিকিৎসককে ধর্ষণ-খুনের ঘটনার পর আরজিকরে গিয়েছিলেন তিনি। এখানেই প্রশ্ন উঠেছে, উত্তরবঙ্গের চিকিৎসক তিনি। বাড়ি জলপাইগুড়িতে। হঠাৎ করে কেন তিনি আরজিকরে গেলেন? তাহলে কি কোনও তথ্যপ্রমাণ লোপাট করার ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল?
সুশান্তবাবু অবশ্য দাবি করেছেন, ঘটনার দিন তিনি সকালে কামারহাটিতে সাগর দত্ত মেডিকেল কলেজের প্রতিষ্ঠা দিবসের অনুষ্ঠানে যোগ দেন। সেখান থেকে রাজ্য মেডিকেল কাউন্সিলের অফিসে আসেন। সেখানে বৈঠক করেন। বৈঠক চলাকালীন তিনি আরজিকরের ঘটনা শোনেন। ওই তরুণী চিকিৎসক যেহেতু মেডিকেল কাউন্সিলের একজন সদস্য, সেজন্য তিনি আরও কয়েকজনকে নিয়ে বিকেল চারটে নাগাদ আরজিকরে পৌঁছন। তখন কর্ডন করা ছিল। তিনি একেবারে পিছনে দাঁড়িয়েছিলেন।
তবে শুধু সুশান্ত রায় নন। আরজিকর কাণ্ডের পর নানা বিতর্কে নাম জড়িয়েছে তাঁর চিকিৎসক পুত্র সৌত্রিক রায়েরও। তাঁকেও জলপাইগুড়ি আইএমএ থেকে সাসপেন্ড করার প্রস্তাব নেওয়া হয়েছে। সুশান্তবাবুর পাশাপাশি তাঁর ছেলেও প্রকাশ্যে আসছেন না। প্রশ্ন উঠেছে, সুশান্ত রায়ের ছেলের ডাক্তারি পরীক্ষায় গোল্ড মেডেল পাওয়া নিয়েও। অভিযোগ, সুশান্তবাবুর প্রভাবেই ওই গোল্ড মেডেল এসেছে। যদিও এই অভিযোগ উড়িয়ে সুশান্তবাবু সংবাদ মাধ্যমকে আগেই জানিয়েছেন, ‘‘আমার ছেলের সঙ্গে আরও দু’জন গোল্ড মেডেল পেয়েছিলেন। তাহলে কেন শুধু আমার ছেলেকে নিয়ে কথা হচ্ছে?’’
অভীকের থ্রেট চলত উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজে। তার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ওই মেডিকেলের তিন চিকিৎসক। এনিয়ে শুক্রবারই তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গড়ে দিয়েছে স্বাস্থ্য দফতর। তদন্ত কমিটির চেয়ারম্যান নিযুক্ত হয়েছেন কোচবিহার এমজেএন মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ নির্মলকুমার মণ্ডল। সাতদিনের মধ্যে রিপোর্ট জমা দিতে বলা হয়েছে।
সূত্রের খবর, উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করেন অভীক। সেখানে পুরোমাত্রায় বজায় ছিল তাঁর ‘দাদাগিরি’। একইভাবে বর্ধমান মেডিকেল কলেজে দাদাগিরি চালাতেন বিরূপাক্ষ বিশ্বাস।