অর্পিতা বনিক : “ বনগাঁয় কিছু ফাঁক যাবার নয়; রথের দিন যশোর রোড লোকারণ্য হয়ে উঠ্লো, ছোট ছোট ছেলেরা বার্নিসকরা জুতো ও সেপাইপেড়ে ঢাকাই ধুতি পরে, কোমরে রুমাল বেঁধে, চুল ফিরিয়ে, দাদু,দিদা,মা -মাসিদের হাত ধরে, যশোর রোডের ওপর বাটার মোড়ে , কেউ বা ত্রিকোণ পার্কে,কেউ আবার অভিযান সংঘের মোড়ে, অনেকেই মতিগঞ্জের মোড়ে রথ দেখতে দাঁড়িয়েছে ।…মাটির জগন্নাথ, কাঁঠাল, তালপাতার ভেঁপু, পাখা ও সোলার পাখি বেধড়ক বিক্রি হচ্চে…।” সে যুগে রথযাত্রা প্রসঙ্গে এমনটাই লিখতেন সে সময়ের বহু সাংবাদিক ৷ দেখুন ভিডিও
দিন বদলেছে , আধুনিক হয়েছে শহর বনগাঁ ৷ এখন রথ আছে। মেলাও আছে। কিন্তু বদলেছে মেলার চরিত্র। বিদায় নিয়েছে তালপাতার ভেঁপু, শোলার পাখি, হাতপাখা। নেই কাঠের নাগোরদোলা, তালপাতার সেপাই, কাগজের কুমির, কাচের পাখি । পাঁপড় ভাজা মেলে অতি কষ্টে। সব মিলিয়ে পাল্টেছে পরিচিত ছবি।
সীমান্ত শহর বনগাঁয় যশোর রোডের ওপর রথের মেলা ছিল অন্যতম। কিন্তু করোনার কারণে গত দু’বছর বড় করে উদযাপন করা হয়নি। এবার তাই মহাসমারোহে ধুমধাম করে রথযাত্রা পালন হচ্ছে দেশের অন্যান্য গ্রাম-শহরের মত এই শহরেও। শুক্রবার এসেছিলেন বহু মানুষ। পরিচিত জিনিসগুলি না পেয়ে ফিরেও যান।
যেমন,এক স্থানীয় বাসিন্দা বললেন, “এসেছিলাম ধামা ও ঝুড়ি কিনতে। পেলাম না।” দেদার বিকোচ্ছে সস্তার প্লাস্টিকের সরঞ্জাম থেকে শুরু করে চিনে তৈরি কাপ-ডিশ, বাসনপত্র। আর আছে নকল গয়না থেকে সস্তা খেলনার দোকান।
ভারতবর্ষকে বলা হয় বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের দেশ। সর্ব ধর্মের মানুষ এখানে খুব ভালো বন্ধু, ভাই হিসেবে থাকে। এ কথার প্রমাণ আগে বহুবার পাওয়া গেছে। সেই প্রমাণ আরো একবার পাওয়া গেল খাস বনগাঁয়। বিখ্যাত বনগাঁর চিন্তার মায়ের রথযাত্রা। সীমান্তের বিভিন্ন গ্রাম থেকে বহু ভক্ত ভিড় করেছেন ৷ বনগাঁর মূল আকর্ষণ চিন্তারমার রথ।
বনগাঁ দুনম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শিখা ঘোষ বলেন, সর্বধর্মের মানুষ এই রথে যোগদান করেন৷ এখানে কোন ভেদাভেদ নেই ৷
কৃষ্ণনগরের মাটির পুতুল এবং অতি পরিচিত মাটির জগন্নাথের জায়গা নিয়েছে চিনে তৈরি রবারের দেব-দেবীর মূর্তি। দত্তপুকুর থেকে আসা এক পুতুল ব্যবসায়ী বললেন, “এখন মাটির পুতুলের চেয়ে এগুলির চাহিদাই বেশি।” গত ১৫ বছর ধরে এই মেলায় আসছেন লোহার জিনিসের ব্যবসায়ী লালু কর্মকার। তিনি বলেন, “ভাল জিনিস আনলেও দাম বেশি বলে বিক্রি হয় না। ভাল বঁটির দাম পড়ে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। ক্রেতারা ৫০ টাকার বেশি উঠতে চান না।”
রাস্তার দু’ধারে রঙিন মাছ ও পাখির দোকানে কচিকাঁচাদের ভিড় থাকলেও, ব্যবসায়ীরা জানান আগের মতো বেচাকেনা হয় না। পাঁপড় ভাজার দোকান ও হাতে গোনা মাত্র কয়েকটি। একটি দোকানের মালিক জানান, বিক্রি অনেক কমেছে।
স্থানীয় বাসিন্দা পরিতোষ বিশ্বাস বলেন,হারিয়ে যাচ্ছে মাটির পুতুলও। মিলবে প্লাস্টিকের খেলনা, চিনে তৈরি বাসনপত্র। পাঁপড় ভাজার পরিবর্তে এখন ছোটদের হাতে দেখা যায় চিপ্সের প্যাকেট। কোথায় গেল ময়রাদের তৈরি হলুদ দেওয়া ফুলুরি! রথের মেলার সেই আনন্দই আজ নেই।”