দেশের সময় : লক্ষ্মীপুজোর আগেই দক্ষিণবঙ্গ জুড়ে বেলাগাম বৃষ্টির মধ্যেই ফল, শাকসব্জির বাজারদর আগুন। তার ছ্যাঁকায় নাজেহাল গৃহস্থেরা অল্পস্বল্প বাজার সেরেই সন্তুষ্ট থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। গৃহস্থের মতোই স্বস্তিতে নেই দোকানি থেকে প্রতিমাশিল্পীরা। অসময়ের বৃষ্টিতে তাঁদের মাথায় হাত। লক্ষ্মীপুজোর আগের মুহুর্তে বিক্রিবাটা সে ভাবে এখনও জমেনি ! ব্যাপক ভাবে অর্থনৈতিক ভাবে ক্ষতির আশঙ্কায় বিক্রেতারা।
দক্ষিণবঙ্গের একাধিক জেলায় মঙ্গলবার সকাল থেকেই বৃষ্টির মধ্যেই বাজারে বেরিয়েছেন ক্রেতারা। তবে উত্তর ২৪ পরগনা, হুগলি, পূর্ব বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ বা পশ্চিম মেদিনীপুর—ফল, শাকসব্জি থেকে লক্ষ্মীপ্রতিমার দর শুনে আঁতকে উঠেছেন তাঁরা।
করোনার আবহে গত বছর পুজোর বাজার তেমন জমেনি। চলতি বছর আশায় বুক বেঁধেছেন দোকানিরা। তবে নিম্নচাপের বৃষ্টি তাতেও জল ঢেলে দিয়েছে। উত্তর২৪ পরগনার বনগাঁর বাজারে গত বছরের তুলনায় এ বার লক্ষ্মীপ্রতিমার দাম বেশ বেড়েছে। ছোট মূর্তিই ১৫০ টাকার আশপাশে। বড় আকারের সাজের প্রতিমার দাম ৬০০-৮০০। খড়ের মূর্তির দর আরও বেশি।
তবে ফলের দর তেমন বাড়েনি বলে দোকানিদের দাবি। তাতেও স্বস্তি নেই ক্রেতাদের। আপেল বা নাসপাতি ৮০ থেকে ১০০ টাকা। কলা ৪০ থেকে ৫০ টাকা প্রতি ডজন। শাঁকালু প্রতি কেজি ১০০ টাকা। শশা এবং খেজুর কেজি প্রতি যথাক্রমে ৫০-৬০ ও ১২০ টাকা। মঙ্গলবার ফল-আনাজপাতির দর শুনে নামমাত্র বাজার সেরেছেন স্থানীয় বাসিন্দা অলীক ব্যানার্জী। তিনি বলেন, ‘‘লক্ষ্মীপুজো বলে কথা চড়া দামের জন্য অল্প করে বাজার সারতে হল ’’ ৷ তবে দাম বেশি হলেও শেষ মুহুর্তে এ বার ক্রেতা পাওয়া যাবে বলে আশা প্রতিমাবিক্রেতা গৌতম পালের। তিনি বলেন, ‘‘বৃষ্টিতে কেনাকাটা কম। তবে বৃষ্টি ধরলেই ক্রেতারা বাজারে আসছেন।’’
বৃষ্টির জেরে প্রভাব পড়েছে দক্ষিণবঙ্গের প্রায় সব বাজারেই। মঙ্গলবার সারা দিন ধরেই ভেসেছে জেলা শহর। ব্যান্ডেল, রবীন্দ্রনগর, খরুয়াবাজার, হুগলি, চুঁচুড়া স্টেশন রোড, চন্দননগর হাসপাতাল মোড় বা জ্যোতির মোড় ঘুরে দেখা গিয়েছে বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচাতে পলিথিন মুড়ে রাখা হয়েছে লক্ষ্মীপ্রতিমা। প্রতিমা বিক্রেতা রবীন ঘোষ বলেন, ‘‘পুজোর আগের মুহুর্তে বিক্রিবাটা ভাল হয়। তবে যা বৃষ্টি হচ্ছে, তাতে লোকজন বাজারে আসতে পারছে না। আবহাওয়ার উন্নতি না হলে বড়সড় লোকসানে পড়ব এবছর।’’
এ বাজারেও ফলমূল বা সব্জির আকাশছোঁয়া দর। কুমড়ো, বেগুন, কচু, পটল বা বরবটি— সবেরই দাম বেড়েছে কেজি প্রতি ১০ থেকে ২০ টাকা। পাল্লা দিয়ে বেড়েছে আপেল, কলা, শশা, নাসপাতি, কমলালেবু, আখ, পানিফল, পেয়ারার দামও। ব্যান্ডেল বাজারে লক্ষ্মীপুজোর জিনিসপত্র কিনতে আসা আরতী চক্রবর্তী বলেন, ‘‘প্রতি বারই লক্ষ্মীপুজোর আগে ফল, শাকসব্জির দাম বাড়ে। পরিমাণে কম কেনাকাটা করেছি। কী করব? পুজো টা তো করতে হবে!’’
একই ছবি অন্যান্য জেলাতেও । উত্তর ২৪ পরগনার হাবরার বাসিন্দা সোমেন সরকার বলেন, ‘‘যে ভাবে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে, তাতে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকাই মুশকিল হয়ে পড়ছে।’’ বিক্রেতাদের দাবি, ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক না হওয়ায় পণ্য পরিবহণের খরচ বেড়েছে। অন্য দিকে, পেট্রল-ডিজেলের দাম বৃদ্ধিতেও লাগামছাড়া হচ্ছে পরিবহণ খরচ। যার প্রভাব পড়ছে জিনিসপত্রের দরে।
বনগাঁর বাসিন্দা রাইমা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন,আর কতক্ষণ অপেক্ষা করব ! ছাতা মাথায় বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে পুজোর বাজার করতে এসেছি প্রতিমা থেকে ফলমূল বা সব্জির আকাশছোঁয়া দাম এবছর লক্ষীদেবীর আরাধনায় ফাঁকা হচ্ছে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার!
একদিকে ঊর্ধ্বমুখী পেট্রল-ডিজ়েলের দাম। অন্য দিকে এখনও জলমগ্ন একাধিক জেলার বড় অংশ। এর উপর শুরু হয়েছে টানা বৃষ্টি। সব মিলিয়ে মহালয়ার পর থেকেই ঊর্ধ্বমুখী বাজার দর! খুচরো বাজারে বেড়েছে ইলিশ-সহ সব মাছ ও মাংসের দাম। গত দিন সাতেকে শাক-সবজির দাম বেড়েছে অন্তত ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ। লক্ষ্মীপুজোর আগের মুহুর্ত পর্যন্ত তা কার্যত আকাশছোঁয়া।
টোম্যাটোর কেজি ১০০ টাকা শুনে এক বেক্তি বাজারের প্যাকেট হাতে নিয়ে প্রায় ভিরমি খাওয়ার জোগাড়। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘কত দাম বললে? কবে থেকে? এত দাম কেন?’ বনগাঁ ‘ট’ বাজারের আনাজ বিক্রেতা তখন বোঝালেন, ‘ঠিকই শুনেছেন। ১০০ টাকা। কিছু করার নেই। এমনই দাম। সব্জি আসছে না। বৃষ্টিতে সব নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।’
ঠিক তার আগে ওই ব্যক্তি পাশের দোকানে ফুলকপিতে হাত দিয়ে ছ্যাঁকা খেয়েছেন, যখন শুনেছেন প্রতি পিসের দাম ৭০ টাকা। জোড়া নিলে অবশ্য ১২০ টাকা মানে পিস প্রতি ৬০ টাকা পড়বে বলে দোকানদার জানিয়েছেন। এ দিন ওই বাজারে পটল বিকিয়েছে ১০০ টাকা কেজিতে, বেগুন ৮০ টাকায়, ঝিঙে ৭০ টাকায়, ঢ্যাঁড়স ৯০ টাকায়। ডাঁটা শাকের মাত্র চারটে ডাঁটার দাম সকালে ছিল ৩০ টাকা, বেলার দিকে ২০ টাকা। মটরশুঁটির দাম ছিল কেজি প্রতি ৩০০ টাকা। মোটের উপর এই ছিল এদিন সকালে শহর ও শহরতলির বাজারে শাক-সব্জির দাম।
এখানেই শেষ নয় পটল প্রতি কিলো বিক্রি হয়েছে ৫০-৬০ টাকায়। বেগুন ৮০-১২০ টাকা কিলো, ঝিঙে ৫০-৬০ টাকা কিলো, কাঁকরোল ৫০ টাকা কিলো। বরবটি ৮০ টাকা কিলো, সজনে ডাঁটা ১০০ টাকা কিলোয় বিক্রি হয়েছে বিভিন্ন বাজারে। গাঁটি কচু ৪০ টাকা কিলো, ধনেপাতা ২০০ টাকা কিলো, শসা ৪০ টাকা কিলো, চিচিঙ্গা ৪০ টাকা প্রতি কিলো। ফলে ধনদেবীর আরাধনায় লাবড়া করতেই হাতে ছেঁকা জনতার।
এ দিন জ্যোতি আলু বিক্রি হয়েছে ১২-১৫ টাকা প্রতি কিলোয়। পাইকারি বাজারে দর ছিল প্রতি কিলো ৮-১০ টাকা। চন্দ্রমুখী আলু বিক্রি বয়েছে ১৮-২০ টাকা কিলো দরে। পাইকারি বাজারদর ছিল প্রতি কিলো ১৫-১৮ টাকা। পেঁয়াজ প্রতি কিলো ৪৫-৫০ টাকা। পাইকারি বাজারদর ছিল প্রতি কিলো ৩৫-৪০ টাকা। আদা প্রতি কিলো ১২০-১৫০ টাকা। কাঁচালঙ্কা প্রতি কিলো ১০০ টাকা। উচ্ছে প্রতি কিলো ৬০ টাকা। কুমড়ো প্রতি কিলো ২৫ টাকা। লাউ প্রতি কিলো ৪০ টাকা। পেঁপে ২৫-৩০ টাকা কিলো। গাজর প্রতি কিলো ৩০ টাকা। টোম্যাটো প্রতি কিলো ৮০ টাকা। ঢ্যাঁড়স প্রতি কিলো ৫০ টাকা।
অন্যদিকে খিচুরির জন্য প্রয়োজনীয় সোনা মুগ ডাল ১৫০-১৮০ টাকা কেজি। গোবিন্দভোগ চালের দাম বেড়ে ১০০ থেকে ১২০ টাকা কেজি। খিচুড়ি অথবা ফ্রায়েড রাইস, পোলাওতেও তাই ঘাম ঝরছে বাঙালির। ফুল, ফলের দামও চড়েছে। এমনিতেই দুই ২৪ পরগনা, নদিয়া, হাওড়া, হুগলি-সহ নানা এলাকা জলমগ্ন হয়ে পড়ায় ফুল ও সব্জি নষ্ট হয়েছে। এর ফলে বেড়েছে ফলের দাম। পেয়ারা ৬০ টাকা কেজি, আপেল ১২০ থেকে ২০০ টাকা কেজি, কলা জোড়া ১৫ থেকে ২০ টাকা, লেবু ২০-২৫ টাকা পিস। দুধ ও ছানার সরবরাহ ঠিক থাকলেও গাড়ির খরচ অনেকটা বাড়ায় মিষ্টির দামও আগের তুলনায় অনেকটাই বেড়েছে।
এক কথায় ধনসম্পদের দেবীর কাছে যেন বাঙালির প্রার্থনা, কৃপাদৃষ্টি দাও মা! ছবি তুলেছেন রাজু মন্ডল ৷