- অশোক মজুমদার:
গতকাল সকাল থেকেই মনটা কেমন উদাস উদাস ছিলো। শুধু গ্রামের বাড়ি, রামযাত্রা, মায়ের নানান কথা মনে ভীড় করে আসছিলো। দুপুরের পরই বেরিয়ে গেলাম। গৌতমদা ভীষন খুঁতখুঁতে মানুষ। গিয়ে দেখি সকলেই সময় বুঝে পৌঁছে গেছে সল্টলেক EZCC তে। সন্ধ্যে সাতটায় শো। হাতে অনেকটা সময়। সবাই যে যার মতো শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। আমি একটু দূরে সরে আছি।
প্রথমবার গৌতমদার অনুরোধে রক্তকরবীর সঙ্গে আমার জার্নি শুরু হয়েছিলো ষোলো সালে। সত্যি বলতে তখন ওতো গভীর ভাবনায় ডুবে নাটকটি বুঝিনি। কিন্তু এবারে পরিকল্পনা শুরুর দিন থেকেই যত শোয়ের দিন এগিয়েছে কেমন যেন প্রতিটা মুহূর্ত নিজের জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে যাচ্ছি।
কিছুক্ষন পর মেকআপের ডাক পরলো। মেকআপ আর্টিস্ট বিধাত্রীর কথা তো বলেছি আগে। বর্তমান সময়ে থিয়েটার জগতে ওকে চেনে না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। নামীদামী প্রোডাকশনে বিধাত্রী কাজ করে। রক্তকরবীতে রূপসজ্জার দায়িত্ব নিয়েছে গৌতমদার পরিচালনা বলেই।
একসময় গায়ে তোয়ালে জড়িয়ে আমিও বসে পরলাম মেকআপ করতে। আয়নায় দেখছি বিধাত্রী নিপুণ হাতে অধ্যাপককে ফুটিয়ে তুলছে। তুলিতে কাজল নিয়ে চোখে টান দিতেই মায়ের মুখটা ভেসে উঠলো পরিষ্কার। যেন মা বলছে, “চোখে কাজল পরলে চোখ ভালো থাকে।”
মা মনে আছে ? তুমি বলতে একথা!! আবছা হয়ে আসা স্মৃতিতে এখনও দেখো মনে আছে সেই কোন ছোটবেলায় তোমার বলা কথাটা!! প্রতিদিন নিয়ম করে বিকেলবেলায় তুমি মুখে হাতে পায়ে সর্ষের তেল মাখিয়ে দিতে। চক চক করতো মুখ। তারপর একটা মাছের মত দেখতে কাজললতা খুলে ডানহাতের তর্জনীর ডগায় কাজলের কালি লাগিয়ে আমার চোখে টেনে দিতে। চোখদুটো একটু জ্বালা করতো। হাত দিয়ে চোখ মুছতে গেলেই তুমি ধরে নিতে হাতদুটো। তোমার কাপড়ের আঁচল দিয়ে চোখে বুলিয়ে দিতে। আমি লাফাতে লাফাতে খেলতে চলে যেতাম।
ষোলোসালে তুমি ছিলে। খোঁজ নিতে কবে কোথায় শো করছি। জীবনে কোনদিন কোনো কাজে বাধা দাওনি। নামমাত্র স্কুলে গিয়েও তুমি যে দেশের ওতো খবর কোথা থেকে রাখতে জানি না। রক্তকরবীর নন্দিনীর মতোই তুমি ভীষণ সহজ ছিলে। কত অভাব, কত অনটন, কত দুঃখের মাঝেও তুমি ভেঙে পরোনি কখনও। তোমার ভিতরেও একবুক আশার আলো ছিলো তাই হয়ত আমরা তিন ভাই গ্রাম ছাড়িয়ে আজ কলকাতা শহরের বাসিন্দা হতে পেরেছি। মায়েরা কি এমনই হয়….চারিদিকে উৎপীড়নের মধ্যেও যে অবিচল থাকতে পারে!!
তুমি তো জানো মা, নাটক থিয়েটার মাঝেমধ্যেই আমি করেছি। কিন্তু তাতে মনের ভাবনা তেমন মেশাতে পারিনি। কিন্তু এবারের রক্তকরবীর কাহিনী, চরিত্র ও তাদের কথা আমাকে সবসময় আত্মভাবনার মধ্যে দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। দেওয়ালের ফাটল বেয়ে আলোর বিস্ময়ই তো আসলে আলোকবর্ষ আশা। যা লালিত করেই তো আমরা বেঁচে আছি প্রতিনিয়ত। রক্তকরবীতেও রবীন্দ্রনাথ সেই আশাতেই জল সিঞ্চন করেছেন।
রক্তকরবীর সঙ্গে এবারের পথচলায় আমি উপলব্ধি করেছি বহু মুহূর্তের দর্শন। যা আগে কখনো ভাবায় নি আমায়। বোহেমিয়ান একটা মন পুশে রাখতাম তো সর্বদা। তাই হয়তো জীবনকে তুড়ি দিয়ে চলেছি। কিন্তু এখন এই বার্ধক্যের আঙিনায় দাঁড়িয়ে জানিনা কেন খুঁজতে ইচ্ছে করে জীবনটাকে। রক্তকরবী আমাকে সেই খোঁজার পথ সন্ধান দিয়েছে। এই কারণে গৌতম হালদারের কাছে আমি ভীষণভাবে কৃতজ্ঞ যে উনি দ্বিতীয়বার আমাকে সুযোগ না দিলে আমি এই মনস্তত্ত্ব বুঝতে হয়তো কোনোদিনই পারতাম না।
যাইহোক মা, এভাবেই চলে যাচ্ছে দিন। তুমিও অনেকদিন চলে গেছো। এখন আর কাজের চাপে রোজ মনেও পরে না তোমার কথা। কিন্তু দেখো তুমি এতটাই চিরন্তন যে আজ রক্তকরবী নাটকের গ্রীনরুমে ঢুকে পড়লে। আশা করি এনআরএস মেডিক্যাল কলেজের এনাটমি বিভাগে তুমি তোমার মতই আছো। আমি তোমার খোঁজ নিইনা তো কি হয়েছে আমার মতো কত ডাক্তার পড়ুয়া তোমার চারপাশে। কাজল চোখে আজও একটু জল আসছে। তুমি তো নেই যে আঁচল দিয়ে মুছে নেবো। মঞ্চের থার্ড বেল পরে গেছে মা….এবার অধ্যাপককে যক্ষপুরীতে যেতে হবে!!
আজকের ছবিওয়ালার গল্প এখানেই শেষ করলাম। জানি এই গল্প কোনো ছবির নয়। কিন্তু জীবনের তো বটে। রক্তকরবীর পরপর শোয়ের খবর আপনাদের আগামীতেও দিতে থাকবো। এই নাটকের সঙ্গে যুক্ত সকল মানুষকে আমার ভালোবাসা, স্নেহ, কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। দর্শকদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি। গতকালের মত ভবিষ্যতেও আমাদের পাশে থাকুন। নাটকের পাশে থাকুন।