“শেষ হয়েও শেষ না হয়ে যায়” ….প্রিয় সঙ্গী অশোকের ছত্রছায়ায় আমাদের পরমপূজ্য ও প্রিয় শিক্ষক তারাপদ ব্যানার্জির শেষ লেখা এই বইটি ছাত্র-ছাত্রীরা শ্রীযুক্ত অশোক মজুমদারের হাতে তুলে দিলাম। নিবেদন রুনা ও গোপা।
বিশিষ্ট চিত্র সাংবাদিক তারাপদ ব্যানার্জির বাৎসরিক কাজ ও স্মরণসভায় তাঁর ছাত্র-ছাত্রীরা দেজ থেকে প্রকাশিত ছায়াসঙ্গী বইটি আমার হাতে তুলে দিয়ে ওপরের কথাগুলো লিখে দিয়েছিল। এই বইটা তারাদা নিজেও দেখে যেতে পারেননি। কিন্তু তার প্রিয় ছাত্রছাত্রী সুপ্রিয়, সুবল, নিতাই, ডা.নীল, শুভ,অর্চিতা, গোপা, রুমা, শেলী সহ অনেকের উদ্যোগে তারাদার প্রথম বছর প্রয়াণ দিবসে বইটি প্রকাশিত করলো।
ঠিক এক বছর আগে ( ৬ মার্চ ) আজকের দিনে বিশিষ্ট চিত্র সাংবাদিক তারাপদ ব্যানার্জি (টর্পেডো) আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। এমন নয় যে এই দিনটাকে আমি মনে রেখেছি বা এমনও নয় যে তারাদার সঙ্গে কাজের সূত্রে আমার খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। বরং উল্টোটা আনন্দবাজার কাজের সূত্রে আমার আমাদের ঝামেলা লেগেই থাকতো। তবে এটা বলতে দ্বিধা নেই যে শুধু আমি কেন ৭০..৮০..৯০..২০০০ এর দশক পর্যন্ত যতদিন তারাদা কাজ করেছেন আর আমরা যারা এই মুহূর্তে শেষ ইনিংসে কাজ করছি সেই সব চিত্র সাংবাদিকরা ওনার কাছে বহু কিছু শিখেছি।
প্রেস ফটোগ্রাফিতে তারাদার নামের সঙ্গে আর একজনের নাম অঙ্গাঙ্গীভাবে চলে আসে সে হল আলোক মিত্র। তিনিও আমাদের মধ্যে আজ আর নেই। ফটোগ্রাফি শুরু করার প্রথম দিকে বহু চিত্র সাংবাদিক আমরা ব্যক্তিগতভাবে তারাদা ও আলোকদাকে পছন্দ না করলেও তাদের তোলা ছবিকে আমরা ফলো করতাম।
ওয়াইড অ্যাঙ্গেল লেন্স, ফ্ল্যাশগান ব্যবহার না করা, ছবির মুহুর্ত, ছবির অ্যাঙ্গেল আমরা তারাদার ছবি দেখে শেখার চেষ্টা করেছি। কিন্তু এটাও ঠিক ওনাদের দুর্ব্যবহার, অপমান, ভুল রাস্তা দেখানো, কথা না বলা, ঔদ্ধত্য আমরা কেউই পছন্দ করতাম না। ঝামেলা লেগেই থাকতো আমাদের সাথে।
কিন্তু যতদিন গেছে কাজ করতে করতে বুঝেছি ফটোগ্রাফি এমন একটা আর্ট যেটা খুব ইন্ডিভিজুয়াল স্কিল…. একান্তই নিজের মেধা। সেখানে অন্য কাগজের ফটোগ্রাফার নিয়ে গ্রুপ করে ছবি তোলা কাউকে সাহায্য করা, খবর দেওয়া কথা বলার জায়গা নেই। কয়ার গ্রুপের মতো গান হতে পারে কিন্তু ছবির মুহুর্ত বিশেষ করে প্রেস ফটোগ্রাফারদের কম্পিটিশনে একাই কাজ করতে হয়। কিছুটা নিজেকেই নিজের ছাপিয়ে যাওয়ার নিরন্তর চর্চা বলা যায়।
সাংবাদ ফটোগ্রাফিতে সোর্স খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর সেটা তৈরি করতে হয়। যা এতটাই ব্যক্তিগত হয় যে দীর্ঘদিন কাজ করার অভিজ্ঞতা আমি অন্য কাগজের ফটোগ্রাফারদের দেবো কেন ? কাজের জায়গায় সে তো আমার এনিমি। প্রতিদ্বন্দ্বী !! জানি, এ নিয়ে বিতর্ক চলতেই থাকবে। কিন্তু এটা বাস্তব যে, তারাদা ও আলোকদার ব্যবহার আমাদের নিজের পায়ে দাঁড়াতে সাহায্য করেছে। ওনাদের স্কিলকে উপেক্ষা করবো এমন বোকামির কথা ভাবাই যেত না। হয়তো আজ যেটুকু করেকর্মে খাচ্ছি তার ভিতটা কিন্তু এদের জন্যই পোক্ত হয়েছিলো।
যাইহোক এত গেল কাজের কথা। আজ উনি নেই। কিন্তু তারাদার অবর্তমানে একজন অনুজ ফটোগ্রাফার হিসাবে কিছু বিষয় যা আমাকে অভিভূত করেছে সেটাই বলতে চাই….
ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি থেকে তারাদার বেশ কিছু ছাত্র-ছাত্রীদের অনুরোধ আসছিল, “অশোকদা ২৩ শে ফেব্রুয়ারি তারাদার বাড়িতে একটু আসবে। আমরা ওই দিন স্যারের বাৎসরিক কাজ ও স্মরণসভার আয়োজন করেছি। আপনি এলে ভালো লাগবে।”
“তারাদা তো মার্চের প্রথম দিকে মারা গেছেন।”….ওদের বললাম।
“হ্যাঁ ঠিকই বলেছেন স্যার ৬ই মার্চ চলে যান কিন্তু তিথি মেনে ২৩ শে ফেব্রুয়ারি ওনার বাৎসরিক কাজ পরেছে। তাই ওইদিনই স্মরণসভা করবো।”
খুব অবাক হয়ে গেলাম। এরা তো কেউ তারাদার রক্তের সম্পর্কের নয়। কিন্তু তাও এত শ্রদ্ধা ভালোবাসা যে তিথি মেনে বাৎসরিক কাজ ও স্মরণসভা করবে!! বর্তমানে এমন একটা সময়ের ভিতরে আমরা চলেছি নিজেদের ছেলেমেয়েরাও এতটা করবে কিনা সন্দেহ!!
অবাক হয়ে ভাবছি আর নিজেকে কত ছোটো মনে হচ্ছে যে তারাপদ ব্যানার্জিকে আমরা পছন্দই করতাম না….একটা সময় ছিলো তারাদার ছাত্র-ছাত্রী নিয়ে আমরা অসংখ্য নিন্দা কটুক্তি হাসাহাসি করেছি। জুনিয়র সিনিয়র কেউ বাদ যায়নি। ছাত্রী হলে তো কথাই নেই। যদিও তারাদা কোনোদিন এই বিষয়ে আমাদের পাত্তাই দেইনি। সেই ছাত্রী সেই ছাত্ররা ওনার স্মরণসভা ও বাৎসরিক কাজ করছে!! প্রতি মুহূর্তে এরা তারাদার উপস্থিতি আমাকে টের পাইয়ে দিচ্ছে।
রবিবার সকালে হাজির হলাম সেই বাড়ি। তারাদা অসুস্থ থাকার সময় অনেকবার এবাড়িতে এসেছি। তারাদার ভাগ্নী রুনা, শেলী আমায় ঘরে নিয়ে গেল। দেখি একটা ছেলে পূজারীর মত মন্ত্র উচ্চারণ করছে। রুনা বললো, “অশোকদা আমার ছেলে স্নেহাশিস।”….লজ্জা লাগছে আমি আমার বন্ধুরা কি জুনিয়র কি সিনিয়র এই ভাগ্নীর নামেও সন্দেহ প্রকাশ করে কত কুকথা বলেছি। আসলে আমরা যখন কাওকে ছাপিয়ে যেতে পারিনা তখনই কি কুপমুন্ডকতা চলে আসে মনের কোণে ? কি জানি!!
পাশের ঘরে তারাদার ছবি ধূপধুনো, মালা দিয়ে সাজানো। এখানে বসে বসে ভাবছিলাম তারাদার একটিই ছেলে সাত্যকি ব্যাঙ্গালোরে আইটি সেক্টরের এক কোম্পানিতে বড়ো চাকরি করে। সে আজ কি করছে বলতে পারবো না। নিশ্চই করবে তার মত। কিন্তু তারাদার ছাত্র-ছাত্রীরা যে ভাবে তিথি মেনে কাজ করছে তাতে সম্পর্কের এই স্বার্থপর সময়ে দাঁড়িয়ে আমি থমকে গেলাম।
ঘর জুড়ে অসংখ্য ছবি। নানান বই। একটা দেওয়ালে তারাদার তোলা কলকাতার টানা রিক্সার ফ্লেক্স। ঠিক তার সামনে তারাদার সুন্দর একটা ছবি। ছবিতে সাদা মালা। টেবিলের উপর প্রায় তারাদার লেখা প্রায় ১৪ টা বই। তিনটে ফটোগ্রাফি বই ছাড়া ১১ টা গল্পের বই। জীবনের সত্যি অভিজ্ঞতা থেকে লেখা। তারাদা এত বই বের করেছে এটা আমার জানাই ছিলো না। আমি দু একটা বইয়ের কথা জানতাম। এত বই তারাদা কখন লিখলো ? এই গুনও ছিলো মানুষটার ?
আজ স্বীকার করছি মানুষকে আমরা বাইরে থেকে যা দেখি বুঝি তার ভিতরেও একটা কিছু থাকে বুঝলাম। বইগুলো হাতে নিয়ে এইসব নানান কিছু ভাবছি। আর তারাদার ছাত্রীছাত্রীরা ভাবছে ওনার নামে একটা মূর্তি বা রাস্তার নাম। তারা সেই বিষয়ে মন্ত্রী সুজিত বসুকে বলবে। সুজিত নিজেও তারাদাকে ভালোবাসতেন শেষ দিকে অনেক কিছু করেছেন।
“তোমরা মেয়রকে এই পাড়া থেকে চিঠি দাও। প্রাথমিক ভাবে কি ভাবে করতে হবে সব জানালাম। আমি রইলাম তোমাদের প্রস্তাবের সাথে।”….বললাম ওদের। হয়তো এটা সম্ভব নয়। ফোটোগ্রাফারের নামে মূর্তি বা রাস্তা কবেই বা হয়েছে !! তবুও ওদের চেষ্টায় পাশে থাকবো সর্বত।
তারাদা আজ ৬ই মার্চ তোমায় নিয়ে দু-চার কথা লিখে ফেললাম। তুমি যেসব ছেলেমেয়েদের কাজ শিখিয়েছো তারা তোমাকে ঘিরে বেঁচে আছে…এই শিক্ষাটাও তুমি মরণের পরে তুমি দিয়ে গেলে!!
জানি, এগিয়ে চলার নিত্যতায় তোমাকে ভুলে যাবো। একটা সময়ের অনেক সিনিয়র লিজেন্ড চিত্র সাংবাদিকদের এখন কোনো ঘটনা ছাড়া মনেই পরে না। কারণ আমাদের ভুলতেই হয়। এটাই জীবনের ধর্ম। কিন্তু তোমার মত মানুষরা থেকে যাবে ছবি বই আর তোমার ছাত্রছাত্রীদের মাঝে…তোমার ছাত্র ছাত্রীদের অনেক শুভেচ্ছা ভালোবাসা রইলো।
ধন্য তুমি তারাদা!! এই ভাগ্য কজনের হয় ? পরজন্মে বিশ্বাস করিনা তাই ভালো থেকো বলতে পারলাম না শুধু শ্রদ্ধা জেনো….প্রণাম নিও।
অশোক মজুমদার।
০৬.০৩.২৫