দেশের সময়: পান্তাভাত। গরিব কৃষকের গামছায় বাঁধা এক মামুলি জলসিক্ত খাবার। তারই প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন বাংলার প্রথম গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস। সময়টা ১৭৫৬ সালের মে মাস। মুর্শিদাবাদের মসনদে সিরাজ উদ দৌলা। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাড়বাড়ন্ত তাঁর চক্ষুশুল। মেজাজ ক্ষিপ্ত হতেই সৈন্য পাঠিয়ে বন্দি করে মুর্শিদাবাদে নিয়ে এলেন হেস্টিংস সহ কয়েকজন ইংরেজ ব্যবসায়ীকে। মধ্যস্থতাকারী বাঙালি ব্যবসায়ী কৃষ্ণকান্ত নন্দীর সাহায্যে হেস্টিংস কোনওমতে ছাড়া পেয়ে আশ্রয় নিলেন তাঁর বাড়িতে।
কৃষ্ণকান্তর পরিবার বর্ধমানের সিজনা গ্রাম থেকে এসে বসবাস করছিল কাশিমবাজারের কাছে শ্রীপুরে। সেসময় কাশিমবাজার ছিল অন্যতম প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্র। নন্দী পরিবার মুদি ব্যবসা দিয়ে শুরু করলেও পরে তুলো, লবণ ও রেশনের ব্যবসায় বেশ নামডাক করেছিল। হেস্টিংস তাঁর বাড়িতে এসে আশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু কৃষ্ণকান্তর ঘরে সেদিন সাহেবি খানার বন্দোবস্ত ছিল না। তাহলে কী খেতে দেবেন হেস্টিংসকে? চিন্তায় পড়ে গেলেন তিনি। একদিকে প্রখর দাবদাহ, অন্যদিকে হেস্টিংস ক্লান্ত ক্ষুধার্ত।
অবশেষে হেস্টিংসকে কলাপাতায় করে খেতে দেওয়া হল পান্তাভাত। সঙ্গে কুচো চিংড়ি আর কাঁচা পেঁয়াজ। খেয়ে যেন প্রাণ জুড়ালো হেস্টিংসের। আর সেই সঙ্গে ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নিল কৃষ্ণকান্তর ইংরেজ সেবার মেনু।
কিশওয়ার চৌধুরীকে মনে আছে? অস্ট্রেলিয়ার জনপ্রিয় রিয়েলিটি শো মাস্টারশেফে পান্তাভাত আর আলু ভর্তা বেঁধে যিনি মাত করে দিয়েছিলেন।
বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কিশওয়ার সার্ডিন মাছ ভাজার সঙ্গে পান্তাভাতের ডিশ তুলে ধরে গর্বের সঙ্গে বিচারকদের বলেছিলেন, এই খাবারটা একবার চেখে দেখুন। রেস্টুরেন্টে পাওয়া যায় না, কিন্তু বাঙালির কাছে অতি পরিচিত। অস্ট্রেলিয়ার আন্তর্জাতিক রান্না প্রতিযোগিতার মঞ্চে দাঁড়িয়ে যখন এ কথা বলছেন কিশওয়ার, বিচারকদের নম্বর দেওয়ার আগেই তখন গোটা বিশ্বের লাখো লাখো বাঙালির মন জয় করে ফেলেছেন তিনি। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয় তাঁর রেসিপি।
পান্তাভাত নিয়ে গবেষণা হয়েছে অসম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। নেতৃত্ব দিয়েছেন অধ্যাপক ডক্টর মধুমিতা বড়ুয়া। গবেষণার মূল বিষয়বস্তু ছিল পান্তাভাতে কী রয়েছে এবং তা শরীরের জন্য কতটা উপকারী। গবেষণার ফল প্রকাশিত হয়েছে এশিয়ান জার্নাল অব কেমিস্ট্রিতে।
গবেষকরা বলছেন, ফার্মেন্টেশনের জন্য রেজিস্ট্যান্স স্টার্চ তৈরি হয় পান্তাভাতে। ফলে কার্বোহাইড্রেটের মাত্রা কমে যায় অনেকটাই। যা ডায়াবেটিস ও ডিসলিপিডমিয়া নিয়ন্ত্রণে বিশেষ উপযোগী। এছাড়াও পান্তাভাতের পিএইচ ব্যালেন্স গ্যাস্ট্রিক আলসার রোগীদের জন্য সহায়ক।
পান্তাভাত শরীরে কোলাজেন তৈরিতে সাহায্য করে, যা ত্বকের ইলাস্টিসিটি বাড়িয়ে, যা জেলা ফেরাতে কার্যকরী। তবে সাধারণ ভাতের তুলনায় পান্তাভাতে পটাশিয়ামের পরিমাণ বেশি। তাই কিডনির সমস্যা থাকলে একটু এড়িয়ে চলুন। তবে ফার্মেন্টেশনের জন্য পান্তাভাতে সোডিয়ামের পরিমাণ অনেকটাই কমে যায়, ফলে যাদের হাই ব্লাড প্রেসার রয়েছে, তারাও খান নির্ভয়ে। সবচেয়ে বড় কথা, এক রাত ভাত ভিজিয়ে রাখার ফলে তাতে আয়রনের পরিমাণ বেড়ে যায় অনেকটাই। ফলে যারা রক্তাল্পতায় ভুগছেন, অবশ্যই ডায়েটে রাখুন পান্তাভাত। নানারকম খনিজে ভরপুর পান্তাভাত। এরমধ্যে রয়েছে ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, পটাশিয়াম, জিংক ফসফরাস, ভিটামিন বি, ভিটামিন সি ও ভিটামিন বি টুয়েলভ। পান্তাভাতে ভিটামিন বি কমপ্লেক্স প্রধানত বি টুয়েলভের পরিমাণ বেড়ে যায় অনেকটাই, যা মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সাহায্য করে, বলছেন পুষ্টিবিদরা। এছাড়াও পান্তাভাত অনিদ্রাতেও ভালো কাজ দেয়, কমায় কোস্টকাঠিন্য।
পান্তাভাতে আয়রন
অবাক করা কয়েকটি তথ্য দিই। আমরা যে ভাত খাই, ১০০ গ্রাম সেই ভাতে আয়রন থাকে মাত্র ৩.৪ মিলিগ্রাম। অথচ একই পরিমাণ পান্তাভাতে আয়রন পাওয়া যায় ৭৩.৯১ মিলিগ্রাম। আয়রন যে আমাদের শরীরে কতটা প্রয়োজন তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। শুধু আয়রন কেন, সাধারণ ভাতের তুলনায় পান্তাভাতে ক্যালশিয়াম ও পটাশিয়ামের মাত্রা ও বেড়ে যায় অনেকটাই।
১০০ গ্রাম গরম ভাতে ক্যালশিয়াম থাকে ২১ মিলিগ্রাম। অথচ ওই একই পরিমাণ পান্তাভাতে ৮৫০ মিলিগ্রাম ক্যালশিয়াম পাওয়া যায়। পান্তাভাতে থাকে প্রচুর পরিমাণে বিটা সিটোস্টেরল কেম্পেস্টরলের মত মেটাবলাইট, যা শরীরকে প্রদাহ থেকে উপশম দেয়। কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য কর।
পান্তাভাতে রয়েছে আইসোরহ্যামনেটিন সেভেন গ্লুকোসাইড ফ্লাভোনয়েডের মতো মেটাবলাইটস, যা ক্যান্সার প্রতিরোধে সক্ষম বলে দাবি করছেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ। দইয়ের মধ্যে যে ল্যাকটিক অ্যাসিড পাওয়া যায়, তা থাকে পান্তাতেও। তবে সারারাত ভাত ভিজিয়ে রেখে দেওয়াই তার ভিতর তৈরি হয় অ্যালকোহলের উপাদান। ফলে পান্তাভাত খেলে অনেক সময় গা ম্যাজম্যাজ করতে পারে। আসতে পারে ঝিমুনি ভাব। সুতরাং পান্তা খেয়ে অফিসে গিয়ে ঢুলে পড়তে পারেন ঘুমে। এটুকুই যা বিপত্তি!