দেশের সময়: নিজের রাজ্য গুজরাতে সিএএ-কে সামনে রেখে ভোটের দামামা বাজিয়ে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। গুজরাতের দুই জেলায় বসবাসকারী পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান থেকে আসা অমুসলিমদের নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা ঘোষণা করা হয়েছে। এনিয়ে জেলাশাসকদের দ্রুত প্রক্রিয়া শুরু করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের তরফে। গুজরাতে সিএএ নিয়ে প্রক্রিয়া শুরু হতেই বিজেপি নেতারা বলতে শুরু করেছেন, এবার বাংলাতেও সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন চালু হবে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, বাংলায় কোনওমতেই সিএএ চালু করতে দেওয়া হবে না। চেন্নাই সফরে যাওয়ার আগে তিনি বলেন, গুজরাতে ভোট রয়েছে, তাই এমন সিদ্ধান্ত। কিন্তু গুজরাত মডেল বাংলায় চালু করতে দেব না।
এদিকে, সামনেই পঞ্চায়েত ভোট রয়েছে বাংলায়। অন্যান্য ভোটের মতো পঞ্চায়েত ভোটেও এ রাজ্যের বেশ কয়েকটি জেলায় মতুয়ারাই অন্যতম নির্ণায়ক শক্তি, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। সিএএ ইস্যুতে সেই মতুয়া ভোটব্যাঙ্ক কাদের দিকে থাকবে, তা নিয়েই এখন রাজনৈতিক মহলে চর্চা তুঙ্গে। পুজোর মরশুম শেষ হতেই পঞ্চায়েত ভোটকে পাখির চোখ করে ময়দানে নামছে রাজনৈতিক দলগুলি। কারণ, হাতে আর বেশি সময় নেই। সেক্ষেত্রে উত্তর ২৪ পরগনায় বিশেষ করে বনগাঁ মহকুমার গ্রামীণ এলাকায় মতুয়া ভোটব্যাঙ্ক নিজেদের দিকে ধরে রাখতে মরিয়া তৃণমূল ও বিজেপি। সিএএ ইস্যুতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তথা বিজেপির বনগাঁর সাংসদ শান্তনু ঠাকুরের মন্তব্য অবশ্য খানিকটা জল্পনা উস্কে দিয়েছে।
রাজ্যে দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে মতুয়া প্রতিনিধি না থাকা নিয়ে অনেক দিন ধরেই বিজেপির রাজ্য নেতৃত্বের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়েছে শান্তনু ঠাকুরের। প্রকাশ্যে একথা স্বীকার না করলেও হাবেভাবে তা বারবার স্পষ্ট করেছেন তিনি। আরও একবার তাঁর মন্তব্য কেমন যেন বেসুরো শুনিয়েছে সিএএ ইস্যুতে। বিজেপির রাজ্য নেতৃত্বের সঙ্গে শান্তনু ঠাকুরের এই ঠাণ্ডা লড়াই পঞ্চায়েত ভোটে মতুয়া ভোটব্যাঙ্কে প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল। দিন কয়েক আগে সংবাদ মাধ্যমের এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, পঞ্চায়েত ভোটে মতুয়া ভোটব্যাঙ্ক কোন দিকে থাকবে, তা দলের রাজ্য নেতৃত্বই ভাল বলতে পারবে। তিনি এ ব্যাপারে কিছুই জানেন না। তাঁর ওই মন্তব্য নিয়ে তুমুল আলোড়ন ছড়ায়।
গত রবিবার মতুয়া মহাসঙ্ঘের ঠাকুরবাড়িতে রাস উৎসব নিয়ে বৈঠক ছিল। সেই বৈঠকে যোগ দিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। বৈঠকের পর সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন তিনি। সেখানেই তাঁকে প্রশ্ন করা হয়, পঞ্চায়েত ভোটে মতুয়ারা বিজেপির পাশেই থাকবেন। এর জবাবে শান্তনু বলেন, বিজেপির রাজ্য নেতৃত্বই এর ভাল উত্তর দিতে পারবে। তাঁদের জিজ্ঞাসা করুন। তাঁরাই বলতে পারবেন। তাঁর এহেন মন্তব্য ঘিরে তুমুল জল্পনা তৈরি হয় বিজেপির ঘরে-বাইরে। কেন এমন মন্তব্য করলেন শান্তনু ঠাকুর। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ মহলের বক্তব্য, চলতি বছরের গোড়ায় দলের পদাধিকারী মণ্ডলী এবং জেলা সভাপতিদের তালিকা নিয়ে বিজেপির অন্দরে কোন্দল শুরু হয়।
সেসময় দলের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ ছেড়েছিলেন পাঁচ মতুয়া বিধায়ক। শান্তনুকেও দেখা গিয়েছিল দলের কয়েকজন শীর্ষ নেতৃত্বের প্রতি ক্ষোভ উগরে দিতে। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সঙ্গে দেখা করে নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে দলের রাজ্য পদাধিকারমণ্ডলীতে মতুয়া প্রতিনিধি আনার দাবি জানিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁর দাবি মানা হয়নি। এনিয়েই তাঁর মধ্যে ক্ষোভ রয়ে গিয়েছে। সেই ক্ষোভের জেরেই বিভিন্ন সময় দলের কর্মসূচিতে গরহাজির থেকেছেন শান্তনু। এমনকী দলের চিন্তন শিবিরেও দেখা যায়নি তাঁকে। যদিও এসব নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি প্রকাশ্যে কোনও মন্তব্য করতে চাননি।
বিজেপি সূত্রের খবর, শান্তনুর গোঁসা কিছুটা কমানোর চেষ্টায় সম্প্রতি রাজ্য বিজেপিতে যে ২৪ জনের কোর কমিটি তৈরি হয়েছে, তাতে রাখা হয়েছে বনগাঁর সাংসদকে। কিন্তু তাতেও যে শান্তনুর অভিমান ঘোচেনি, তা তাঁর সাম্প্রতিক মন্তব্যে আরও একবার প্রকট হয়েছে। ঘনিষ্ঠ মহল সূত্রে খবর, বাংলায় সিএএ কার্যকর না হওয়ায় ক্ষুব্ধ শান্তনু ঠাকুর। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেছিলেন, করোনাকালে দেশে সিএএ কার্যকর করা যাবে না। কিন্তু মহামারী থিতু হওয়ার পরও এনিয়ে কেন্দ্র কোনও উদ্যোগ না নেওয়ায় শান্তনুর ক্ষোভ দিনদিন বাড়ছে। যদিও প্রকাশ্যে সিএএ নিয়ে বনগাঁর বিজেপি সাংসদ বলেছেন, সিএএ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে বিরোধীদের দায়ের করা মামলার শুনানি চলছে। এর নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত সিএএ কার্যকর করা সম্ভব নয়।
এদিকে বনগাঁর প্রাক্তন তৃণমূল সাংসদ মমতাবালা ঠাকুরের দাবি, মতুয়ারা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গেই আছেন। তিনি বলেন, গত লোকসভা নির্বাচনে মতুয়া ভোটব্যাঙ্ক কিছুটা তৃণমূল থেকে সরে গিয়েছিল, এটা সত্যি। কিন্তু বিধানসভা ভোটে তা আবার অনেকটাই ফিরে এসেছে। পঞ্চায়েত ভোটেও দেখা যাবে, মতুয়া তৃণমূলের সঙ্গেই আছেন। তাঁর দাবি, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলার মানুষের জন্য যে উন্নয়ন উপহার দিয়েছেন, তার সুফল পাচ্ছেন মতুয়ারাও। আর বিজেপি গত ২০১৪ সাল থেকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে চলেছে, তার একটিও কার্যকর করতে পারেনি। মানুষ এখন জিএসটির চাপে জর্জরিত। সামান্য বিস্কুট, মুড়িতেও জিএসটি দিতে হচ্ছে। এটা কখনও ভাবাই যায়নি। সিএএ নিয়ে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার একএকবার এক একরকম কথা বলছে।
কখনও বলা হচ্ছে, পূর্ববঙ্গ থেকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে যেসব হিন্দু এদেশে এসেছে, তাঁদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। আবার বলা হচ্ছে, ওপার থেকে যাঁরা অত্যাচারিত হয়ে এসেছে, তাঁরা নাগরিকত্ব পাবে। এসব নাগরিকত্ব না দেওয়ার বাহানা। একজন মানুষ বাংলাদেশ থেকে অত্যাচারিত হয়ে এসেছে কি না তা কীভাবে প্রমাণ হবে। সেই মানুষটির বয়ানের ভিত্তিতে ভারত সরকার বাংলাদেশ সরকারের কাছে জানতে চাইবে। তারপর সেই সরকার কী রিপোর্ট দেবে, তার উপর নির্ভর করবে নাগরিকত্ব? আমাদের বক্তব্য, ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রীর যে পরিচয়পত্র রয়েছে, আমাদেরও সেই পরিচয়পত্র আছে। ফলে প্রধানমন্ত্রী যদি ভারতের নাগরিক হয়ে থাকেন, তাহলে আমরাও ভারতের নাগরিক। তাহলে আলাদা করে আর সিএএ-র প্রয়োজন কী। আর যদি নাগরিকত্ব দিতেই হয়, তা হলে নিশর্তভাবে দেওয়া হোক।
পঞ্চায়েত ভোটে মতুয়া ভোটব্যাঙ্ক বিজেপির দিকেই থাকবে বলে দাবি দলের বনগাঁ সাংগঠনিক জেলার সাধারণ সম্পাদক দেবদাস মণ্ডলের। তিনি বলেন, শান্তনু ঠাকুর মতুয়াদের ধর্মগুরু। তিনি যা বলবেন, সেটাই করবেন মতুয়ারা। আর শান্তনু ঠাকুর বিজেপির মন্ত্রী। দলের সাংসদ। ফলে মতুয়ারা বিজেপির প্রতীকেই ভোট দেবেন, এটাই স্বাভাবিক। এনিয়ে অযথা জলঘোলা করার চেষ্টা করছে কেউ কেউ। দেবদাসবাবুর বক্তব্য, পঞ্চায়েত ভোটে আগে তৃণমূল নিজেদের গোষ্ঠীকোন্দল সামাল দিক। টিকিট বিলি নিয়ে লাখ লাখ টাকার খেলা চলবে। কারণ, ওরা জানে একবার পঞ্চায়েতে জিততে পারলে চুরি করে বাড়ি, গাড়ি সবটাই হয়ে যাবে। আমাদের দল পঞ্চায়েতে যাঁকে টিকিট দেবে, তাঁকেই প্রার্থী মেনে নিয়ে কাজ করবেন কর্মীরা।
বিজেপি যতই লাফাক না কেন, বাংলায় সিএএ হবে না বলে জানিয়ে দিয়েছেন বনগাঁ পুরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর তথা পুরসভার দলনেতা প্রসেনজিৎ বিশ্বাস। তিনি বলেন, সামনে পঞ্চায়েত ভোট। সেকারণে আবার সিএএ নিয়ে এ রাজ্যের বিজেপির নেতারা নানা কথা বলতে শুরু করেছেন। আমাদের বক্তব্য, যদি নাগরিকত্ব দিতেই হয়, তাহলে নিশর্ত নাগরিকত্ব দিতে হবে। আমরা কোনও আবেদন করব না। এনিয়ে আমাদের আন্দোলন চলছে, চলবেও। প্রসেনজিতের দাবি, লক্ষ্মীর ভাণ্ডার থেকে খাদ্যসাথী, স্বাস্থ্যসাথী, কন্যাশ্রী সব প্রকল্পই মতুয়ারা পাচ্ছেন। তাহলে কেন তাঁরা বিজেপির সঙ্গে থাকবেন। মতুয়ারা জোট বেঁধে রয়েছেন। শুধু ভোটের অপেক্ষা।
এরাজ্যে যে কোনও নির্বাচনে মতুয়া ভোটব্যাঙ্ক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এসসি ভোটের মোট ১৭.৪ শতাংশ ভোট রয়েছে মতুয়াদের। রাজবংশীদের পরেই মতুয়া ভোট ব্যাঙ্ক। গোটা রাজ্যে হিন্দু জনসংখ্যার ১.৮ কোটি এসসি। বাংলার মোট ১০টি আসন রয়েছে এসসিদের জন্য। এর মধ্যে ২০১৯ সালের নির্বাচনে বিজেপি পেয়েছে ৪টি সিট, কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, বিষ্ণুপুর ও বনগাঁ। এছাড়া মোর্চার সমর্থন নিয়ে দার্জিলিংয়েও জিতেছেন বিজেপির প্রার্থী। এই ভোটব্যাঙ্ক ধরে রাখার জন্য মরিয়া বিজেপি। উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনায় বেশ কিছু বিধানসভায় মতুয়াদের বেশ ভাল প্রভাব রয়েছে। এছাড়া হুগলি, হাওড়া, নদীয়াতেও রয়েছেন মতুয়ারা। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূলকে বড়সড় ধাক্কা দেয় বিজেপি। বনগাঁ কেন্দ্রে তৃণমূলের মমতাবালা ঠাকুরকে হারিয়ে জিতে যান বিজেপির শান্তনু ঠাকুর। বিধানসভাতেও বিজেপি তাদের আধিপত্য ধরে রেখেছে এখানে। এবার পঞ্চায়েত ভোটে মতুয়া ভোটব্যাঙ্ক কতটা ধরে রাখতে পারে গেরুয়া শিবির, সেটাই দেখার।