

দীর্ঘদিনের সীমান্ত বিরোধ, জঙ্গি গোষ্ঠীর বাড়বাড়ন্ত আর পারস্পরিক অবিশ্বাস— সবকিছু মিলিয়ে ফের উত্তপ্ত পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সম্পর্ক। সীমান্তে ভয়াবহ সংঘর্ষে বহু মানুষের মৃত্যু হয়েছে। অবশেষে দুই দেশ ৪৮ ঘণ্টার যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করলেও আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে- এটা শান্তির শুরু, নাকি আরও বড় যুদ্ধের আগে সাময়িক বিরতি?

১. ডুরান্ড লাইন: পুরনো সীমান্ত বিতর্ক, পুরনো ক্ষত
১৮৯৩ সালে ব্রিটিশ শাসনের সময় আফগানিস্তান ও ব্রিটিশ ভারতের মধ্যে সীমানা টানা হয়। এই সীমানাকেই বলা হয় ডুরান্ড লাইন । এই লাইনের ফলে পুশতু জাতিগোষ্ঠীর মানুষ দুই দিকে ভাগ হয়ে যায়। পাকিস্তান ১৯৪৭ সালে তৈরি হওয়ার পর থেকেই আফগানিস্তান এই সীমান্ত মানতে অস্বীকার করে আসছে। আবার পাকিস্তান এই সীমান্তকেই আন্তর্জাতিক সীমানা বলে দাবি করে। এই সীমান্ত নিয়েই দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে টানাপোড়েন।

২. পাক-আফগান যুদ্ধের টাইমলাইন (Pakistan Afghanistan war a timeline)
১৮৯৩: ডুরান্ড লাইন চুক্তি
১৯৭৯-৮৯ : সোভিয়েত আফগান যুদ্ধ, মুজাহিদিনদের সমর্থন করে পাকিস্তান
১৯৯৬: তালিবান ক্ষমতায়, তালিবানকে স্বীকৃতি দেয় পাকিস্তান
২০০১: ৯/১১-র পর ক্ষমতাচ্যূত হয় তালিবান
২০০৭: তেহরিক ই তালিবান (Tehrik-i-Taliban Pakistan) তৈরি হয়, পাকিস্তানে জঙ্গি হামলা বাড়ে
২০১১ : কাবুলের পতন, ফের ক্ষমতায় ফেরে তালিবান
২০২৩-২৫: পাকিস্তান ও আফিগানিস্তানের মধ্যে লাগাতার অশান্তি, তালিবানকেই দায়ী করে পাকিস্তান
অক্টোবর ২০২৫: ভয়াবহ সংঘর্ষ, আপাতত ৪৮ ঘণ্টার যুদ্ধবিরতি

৩. কীভাবে ফের যুদ্ধ বাঁধল
২০২১ সালে তালিবান ফের আফগানিস্তানের ক্ষমতায় আসে। পাকিস্তানের আশা ছিল— তালিবান টিটিপি জঙ্গিদের দমন করবে। কিন্তু ঘটল উল্টোটা—
জঙ্গিরা আফগান মাটিতে আশ্রয় নেয়, পাকিস্তানে হামলা বাড়ায়। পাকিস্তান জঙ্গি ঘাঁটিতে বিমান হামলা চালায়। তালিবান পাল্টা হামলা করে সীমান্ত এলাকায়। তোরখাম ও চমন এলাকায় ভয়াবহ গুলিবিনিময় হয়। ফলে বহু সাধারণ মানুষের যেমন মৃত্যু হয়েছে, উদ্বাস্তু সংখ্যা বাড়ছে।

৪. ৪৮ ঘণ্টার যুদ্ধবিরতি: সামান্য বিরতি, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ
১৪ অক্টোবরের পর সংঘর্ষ চরমে উঠতেই পাকিস্তান ও আফগানিস্তান ৪৮ ঘণ্টার যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্ত নেয়। পাকিস্তান দাবি করে, যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব এসেছে আফগানিস্তান থেকেই। পাকিস্তান বলে তারা আফগান ট্যাঙ্ক ও পোস্ট ধ্বংস করেছে। তালিবান উল্টো দাবি করে, কাবুলের দাবি তারা একটি পাকিস্তানি ট্যাঙ্ক দখল করেছে। বোমা হামলায় কমপক্ষে ১২ জন নিহত ও শতাধিক আহত হয়েছে কান্দাহার অঞ্চলে।

৫. কেন এই সংঘর্ষ উদ্বেগজনক
জঙ্গি গোষ্ঠীর সক্রিয়তা: এই সীমান্ত এলাকা জঙ্গিদের নিরাপদ আশ্রয়।
আর্থিক দিক: যুদ্ধ চললে সীমান্ত বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাবে।
শরণার্থী সমস্যা: নতুন করে উদ্বাস্তু সঙ্কট তৈরি হচ্ছে।
আঞ্চলিক রাজনীতি:চিন, ভারত, রাশিয়া ও ইরান এই সংঘর্ষের উপর নজর রাখছে।
৬. মানবিক পরিস্থিতি ভয়াবহ
সীমান্তের বহু গ্রাম ফাঁকা হয়ে গেছে।
খাদ্য ও ওষুধ পৌঁছচ্ছে না।
আহত ও উদ্বাস্তু মানুষের সংখ্যা বাড়ছে।
সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নারী ও শিশুরা।

৭. যুদ্ধবিরতির সামনে বাধা
দুই দেশের মধ্যে গভীর অবিশ্বাস।
যুদ্ধবিরতি রক্ষায় কোনও নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক নেই।
জঙ্গি গোষ্ঠী যুদ্ধবিরতি ভেঙে দিতে পারে।
রাজনৈতিক চাপে যেকোনও সময় অবস্থা বদলে যেতে পারে।
এই সীমান্ত সংঘর্ষ শুধু পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে শতবর্ষের ইতিহাস, জাতিগত সমস্যা, জঙ্গিবাদ আর আন্তর্জাতিক রাজনীতি। ৪৮ ঘণ্টার যুদ্ধবিরতি হয়তো ছোট একটা সুযোগ এনে দিয়েছে— যদি এই সময়ের মধ্যে আলোচনার দরজা খোলে তা ভাল। তা না হলে এই যুদ্ধ দক্ষিণ এশিয়ায় আরও বড় অস্থিরতা ডেকে আনতে পারে বলে মনে করছেন কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞরা।



