
পার্থ সারথি নন্দী ,দেশের সময় :এলাকায় সুখ, শান্তি, সমৃদ্ধি ও সাংস্কৃতিক কৃষ্টি ধরে রাখতে সেই কবে থেকে যে, মুড়িঘাটা গঙ্গা পুজোর মেলা বসছে তার দিনক্ষণ সঠিক করে বলা খুব মুশকিল। কিন্তু নানা ধর্মের মানুষের মধ্যে পরস্পরের উত্তম বোঝাপড়া ও সম্প্রীতির প্রতীক হিসেবে আজও উত্তর ২৪ পরগনা জেলায় বনগাঁর মুড়িঘাটা গ্রামের জনপ্রিয় প্রাচীন এই মেলা। প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী, মাঘী পূর্ণিমা তিথিতে রীতি মেনে পূজার্চনা করেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

আদিবাসী অধ্যুষিত মুড়িঘাটা গ্রাম। এলাকাটি বনগাঁ থানার গাঁড়াপোতা পঞ্চায়েতের অধীন। বেশির ভাগ মানুষের পেশা বলতে খেতমজুরি, দিনমজুরি। কারও নিজস্ব জমি প্রায় নেই বললেই চলে। দারিদ্রসীমার নীচে বসবাস। আর্থিক অনটনের কারণে বাড়ির পুরুষদের পাশাপাশি মহিলারাও খেতমজুরির কাজ করেন। গ্রামের বহু বাড়ি আজও কাঁচা। অনুন্নয়ের ছাপ স্পষ্ট।

পুজো শেষে, ওই এলাকায় ইছামতী নদীর তীরে সাত দিনের মেলা বসে। সেই মেলাকে ঘিরে নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরু হয়। সাত দিনের এই মেলাকে ঘিরে মুড়িঘাটা এলাকায় দূর-দূরান্ত থেকে আত্মীয় পরিজনদের আনাগোনা হয়। এক অর্থে তাই এ মেলা এলাকার পুনর্মিলনও উৎসবও।

মুড়িঘাটার মেলাকে নিয়ে একসময় প্রচলিত ছিল একটি ছড়া, ‘মুড়ুইয়ের মেলা, হাঁড়ি আর হোলা’। কেন না, মাটির হাঁড়ি, থালা-বাসন হরেকরকমের মাটির জিনিষ পাওয়া যেত একসময়। তবে এখনও মেলায় মাটির তৈরী বহু রকমের জিনিস চোখে পড়ে ।

পেশায় লেখক স্থানীয় বাসিন্দা মুক্তি সর্দার নদীর তীরে মন্দির লাগোয়া এলাকা দেখিয়ে বলেন, “সেই কবে থেকে এই মেলা বসছে, তার কোনও লিখিত ইতিহাস নেই , তবে বাপ ঠাকুরদার কাছে শুনে জেনেছি এই মেলা অন্তত ২৫০ বছর ধরে হচ্ছে । সব ধর্মের মানুষ মেলায় মেতে ওঠেন।”

কথিত আছে হরিচরণ সর্দার , কেউটে পাড়ার মহঃ গোপাল মন্ডলরা প্রচার করতেন স্থানীয় বাসিন্দা নিত্য অধিকারী এক দিন স্বপ্ন দেখেন নদীর তীরে দেবী গঙ্গা রূপে আবির্ভাব হয়েছেন । তারপর স্থানীয় পুরোহিত উপেন্দ্র নাথ ভট্টাচার্য্য প্রথম পুজো শুরু করেন ।

মাঘী পূর্ণিমায় গঙ্গা স্নান যাত্রা তিথি থেকে শুরু হয় গঙ্গা পুজো ও মেলা । সেই থেকে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে, এই পুজো এবং মেলাকে ঘিরে মানুষের নানা চাওয়া-পাওয়া গড়ে উঠেছে। সেই কারণেই মুড়িঘাটার পুজোর পর আজও এই মেলায় শরিক হন ওই গ্রামের অসংখ্য মানুষ।

এলাকার হিন্দু এবং মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সমান সমাদৃত এই মেলাকে ঘিরে সম্প্রীতির কথা শোনালেন স্থানীয় বাসিন্দা শফিউল্লা শাহ। তিনি বলেন, “হিন্দু ও মুসলমান সমান ভাবে মিলিত হয়ে এখনও মেলায় অংশ গ্রহণ করেন । জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে প্রায় ২৫০ বছরের প্রাচীন এই সাত দিনের এই মেলা সম্প্রীতির এই অনন্য নজির বয়ে চলেছে এখানে।”

ওই গ্রামের অশীতিপর বৃদ্ধ কালীচরণ বিশ্বাস, বাসুদেব মুখোপাধ্যায়রা বলেন, “ সাত দিনের মেলাকে ঘিরে এলাকায় এলাহি ব্যাপার চলে। একসময় আশেপাশের সাহিত্য, সংস্কৃতির এক রকমের মেল বন্ধনের জায়গা ছিল। ‘লেটোগান’ প্রতিযোগিতার জন্য আলাদা করে খ্যাতি ছিল , তবে এখনও বর্তমান প্রজন্মের তরুণ – তরুণীরা সাত দিন ধরে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে চলেছেন।”

মুড়িঘাটার মেলাকে ঘিরে নয়, কথিত আছে গঙ্গা দেবীকে নিয়ে এলাকার সকলের মনে গেঁথে রয়েছে নানা বিশ্বাস। স্থানীয় মানুষদের কথায়, এখানে মা গঙ্গা খুব জাগ্রত। মন্দিরের দেবীর কৃপায় এই গ্রামের উন্নতির কাহিনি আজও মানুষের মুখে মুখে ঘোরে।” রইল মেলার ছবি ~














