হাসিনার ভাষণের সময়ে ভাঙা হচ্ছে মুজিব ভবন, খুলনায় বুলডোজারে ধূলিসাৎ ‘শেখ বাড়ি’
গণ-অভ্যুত্থানের ছয় মাসের মাথায় বাংলাদেশে ফের আক্রান্ত শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতি। ঢাকায় তাঁর ৩২ নম্বর ধানমণ্ডির বাড়ি ভাঙল উন্মত্ত জনতা।
বুধবার বাংলাদেশবাসীর উদ্দেশে ভার্চুয়ালি ভাষণ দেন সে দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর ভাষণ সম্প্রচারের কথা আগেই ঘোষণা করে আওয়ামী লীগ ও ছাত্র লীগ। তা নিয়ে হাসিনা-বিরোধীদের ক্ষোভও পুঞ্জীভূত হচ্ছিল।
বুধবার হাসিনার ভাষণ শুরুর আগেই সেই রোষ গিয়ে পড়ে ৩২ নম্বর ধানমন্ডির বাড়িতে। মুজিবের বাড়িতে প্রথমে তাণ্ডব, ভাঙচুর চালায় জনতা। পরে সেখানে অগ্নিসংযোগ করা হয়। শেষে বেশি রাতের দিকে বুলডোজ়ার নিয়ে আসা হয়। শুরু হয় মুজিবের স্মৃতি জড়ানো ৩২ নম্বর ধানমন্ডির বাড়ি ভাঙা।বাড়ির প্রবেশ মুখে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরালটি আগেই খানিক ভাঙা হয়েছিল।
বুধবার রাতে ফের সেটির উপর শাবল, কুড়ালের ঘা পড়েছে। হাত গুটিয়ে পুলিশ, সেনা। তারা বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেনি। জনতা থেকে থেকে আওয়াজ উঠেছে, ‘নারায়ে তাকবির, আল্লাহু আকবার।’
বাংলাদেশি সংবাদমাধ্যম ‘প্রথম আলো’র প্রতিবেদন অনুযায়ী, বুধবার রাত প্রায় ১১টা নাগাদ ধানমন্ডিতে মুজিবের বাড়ির সামনে একটি ক্রেন এবং একটি এক্সকাভেটর এনে বাড়ি ভাঙা শুরু হয়। রাত সাড়ে ১২টা নাগাদ ভবনের একটি অংশ ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। বাকি অংশও ভেঙে ফেলা হচ্ছে।
এদিকে, খুলনায় বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ‘শেখ বাড়ি’। শেখ হাসিনার এক আপন কাকার বাড়ি পুরসভার বুলডোজার নিয়ে গিয়ে ভাঙছে ‘বিপ্লবী ছাত্র জনতা।’ খুলনার ময়লাপোতা এলাকায় বাড়িটি ‘শেখ বাড়ি’ নামে পরিচিত।
খুলনায় শেখ হাসিনার কাকার বাড়ি পুরসভার বুলডোজার দিয়ে ভেঙে ফেলা হচ্ছে।
বাড়িতে বর্তমানে কেউ থাকেন না। গত বছর ৫ অগাস্ট গণ অভ্যুত্থানের দিন ঢাকায় মুজিবুর রহমানের ৩২ নম্বর ধানমণ্ডির বাড়িটির পাশাপাশি খুলনার শেখ বাডড়িতেও হামলা হয়েছিল। তখনই বাড়ি ছাড়েন শেখ হাসিনার খুড়তুতো ভাই সাবেক সংসদ সদস্য শেখ হেলাল উদ্দিন, শেখ সোহেল উদ্দিনসহ তাঁদের পরিবারের সদস্যরা ওই বাড়ি থেকেই একটা সময় দেশের দক্ষিণ প্রান্তে আওয়ামী লিগের রাজনীতি পরিচালিত হত।
বুধবার রাতে শেখ হাসিনা দলের উদ্দেশে অনলাইনে ভাষণ দেন (sheikh hasina live)। তাঁর ভাষণ শুরুর ঠিক মুখে শুরু হয়ে যায় মুজিবের বাড়ি ভাঙা। ভাষণ চলাকালে তা চলতে থাকে।
ধানমন্ডিতে হাসিনারও বাড়ি রয়েছে। সেখানেও আছড়ে পড়ে জনরোষ। প্রথম আলোর প্রতিবেদন অনুসারে, ধানমন্ডির ৫/এ-তে আওয়ামী লীগ নেত্রী হাসিনার বাসভবন সুধা সদনেও আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা ‘প্রথম আলো’কে জানান, রাতে সাড়ে ১০টার পরে ধানমন্ডিতে হাসিনার বাসভবনে আগুন ধরিয়ে দেন কয়েক জন। বেশি রাতের দিকে স্থানীয় এক দমকল আধিকারিক জানান, রাত সাড়ে ১১টার দিকে তাঁরা আগুনের খবর পেয়েছেন।
ঢাকার বাইরেও ক্রমশ ছড়াতে শুরু করেছে হাসিনা-বিরোধী রোষের আগুন। ‘প্রথম আলো’ জানিয়েছে, খুলনাতেও ভেঙে দেওয়া হচ্ছে ‘শেখ বাড়ি’। এটি হাসিনার কাকার বাড়ি। বুধবার রাত ৯টা নাগাদ বাড়িতে তাণ্ডব শুরু হয়। ‘প্রথম আলো’ অনুসারে, প্রথমে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা ভাঙচুর শুরু করেন। পরে সিটি করপোরেশনের দু’টি বুলডোজার নিয়ে বাড়িটি গুঁড়িয়ে দেওয়া শুরু হয়। কুষ্টিয়াতেও বুলডোজ়ার চলেছে প্রাক্তন সাংসদ মাহবুব উল আলম হানিফের বাড়িতে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও মুজিব এবং হাসিনার ম্যুরাল একদল পড়ুয়া ভেঙে দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠে আসছে।
রাত সাড়ে ১২টা নাগাদ ভোলা সদরের গাজীপুর সড়কে ‘প্রিয় কুটির’ নামে একটি বাড়িতে আগুন ধরানো হয়। এটি আওয়ামী লীগ নেতা তথা প্রাক্তন সাংসদ তোফায়েল আহমেদের বাড়ি। রাত ১টা নাগাদ কুমিল্লার মুন্সেফবাড়ি এলাকায় প্রাক্তন সাংসদ বাহাউদ্দীন বাহারের বাড়িতেও ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে বলে অভিযোগ।
বাংলাদেশে বুধবার বিকেল থেকেই ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িটি গুঁড়িয়ে দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়ে বিভিন্ন পোস্ট ছড়িয়ে পড়ে সমাজমাধ্যমে। সন্ধ্যায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহও সমাজমাধ্যমে একটি পোস্ট করেন। সেখানে তিনি লেখেন, “আজ রাতে বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদের তীর্থভূমি মুক্ত হবে।” বুধবার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমগুলির উদ্দেশেও বার্তা দিয়ে রেখেছেন। তাঁদের বক্তব্য, হাসিনার ভাষণ কোনও সংবাদমাধ্যম প্রচার করলে, সেই গণমাধ্যম হাসিনাকে সহযোগিতা করছে বলে ধরে নেওয়া হবে।
গত বছরের ৫ অগস্ট বাংলাদেশে হাসিনার সরকারের পতন হয়। সেই সময়েও জনরোষ আছড়ে পড়েছিল মুজিবের ধানমন্ডির বাড়িতে। তার পর থেকে বাড়িটি দৃশ্যত পরিত্যক্ত অবস্থাতেই পড়েছিল। বুধবার হাসিনার সরকারের পতনের ছ’মাসের মাথায় আবারও বিক্ষোভকারীদের রোষানলে পুড়ল সেই বাড়ি।
এই বাড়িতেই পাঁচ দশক আগে বাংলাদেশে রক্তাক্ত পালাবদলের সময় গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল শেখ মুজিবুর রহমানের দেহ। মুজিব-কন্যা হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হয়ে ৩২ নম্বর ধানমন্ডির সেই বাড়িটিকে পরিণত করেছিলেন সংগ্রহশালায়।
বুধবার ধানমন্ডিতে মুজিবের বাড়ি ভাঙার প্রসঙ্গ উঠে এসেছিল হাসিনার ভার্চুয়াল ভাষণেও। তিনি বলেন, “ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ি থেকে জাতির পিতা (শেখ মুজিব) স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। ওই ঘটনার পর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাঁকে গ্রেফতার করে নিয়ে গিয়েছিল। তখনও এই বাড়িটিতে তারা লুটপাট করেছিল। কিন্তু আগুন দিয়ে পোড়ায়নি, ভাঙেনি।”
ধানমন্ডির বাড়ির স্মৃতিচারণা করে হাসিনা জানান, শেখ মুজিব কখনও সে দেশের রাষ্ট্রপতি ভবনে বা প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে থাকেননি। এই ছোট বাড়িটিতেই ছিলেন তিনি। আওয়ামী লীগ নেত্রী বলেন, “আমার মা অনেক কষ্ট করে এই বাড়িটির প্রতিটি ইট নিজের হাতে গেঁথেছিলেন।”
বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর কথায়, “অনেক রাষ্ট্রপ্রধান, সরকার প্রধান, বিশ্বের বড় বড় নেতারা এই বাড়িতে এসেছেন। আজ এই বাড়িটি ভেঙে ফেলা হচ্ছে। কেন? বাড়িটির কী অপরাধ? এই বাড়িটিকে কেন এত ভয় পাচ্ছেন?” আওয়ামী লীগের নেত্রীর দাবি, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ এর বিচার করবেন।