আমচাষ থেকে বেশি লাভ পেতে গেলে এবং আয় বৃদ্ধি করতে গেলে যে নানান পদ্ধতি অবলম্বন করা যায়, তার অন্যতম উপায় হচ্ছে ‘ডাবল হেজ-রো’ (Double Hedge-row) বা দ্বি-বেড়া সারিতে ঘন করে আমগাছ রোপণ। পাঁচ মিটার x পাঁচ মিটার দূরত্বে বর্গাকারে দু’টি সারির পর ১০ মিটারের ‘খাই’ বা ‘ছাড়’ দিয়ে পুনরায় পাঁচ মিটার এবং পাঁচ মিটার বর্গাকারে আরও দুটি সারি লাগাতে হবে। এইভাবে ক্রমান্বয়ে গাছের সারি রাখার পদ্ধতির নাম ‘ডাবল হেজ রো সিস্টেম’।
এই পদ্ধতিতে ১৩-১৪ বছর বয়সের হিমসাগর জাত লাগিয়ে হেক্টরে ৮.৫২ টন ফলন পাওয়া সম্ভব। তাতে লাভ:খরচের অনুপাত হয় ২.৬২; অর্থাৎ আম চাষ করে প্রতি বছর এক টাকা খরচের মাধ্যমে ২ টাকা ৬২ পয়সা লাভ করা যায়। স্বাভাবিক (১০ মিটার x ১০ মিটার) দূরত্বে গাছ লাগিয়ে সেখানে হেক্টরে ৫.২৭ টন ফলন পাওয়া যেত এবং লাভ:খরচের অনুপাত থাকত ১.৯৫ টাকা (এক টাকা খরচ করে উপরি আয় ১ টাকা ৯৫ পয়সা)। এখানে সেই উৎপাদন বেশি, লাভের অঙ্কও বেশি। পশ্চিমবঙ্গের উপযোগী হিমসাগর, ল্যাংড়া, বোম্বাই, ফজলি প্রভৃতি জাত ঘন করে রোপণ করা লাভজনক বলে বিবেচিত হয়েছে। তবে বেঁটে জাতে এই দূরত্ব আরও কমিয়ে দেওয়া যায়।
বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফল গবেষণা কেন্দ্রের অন্তর্গত গয়েশপুর ফার্মে নানান উপায়ে ঘনভাবে আমগাছ রোপণ করে, সেই বাগিচায় দীর্ঘদিন গবেষণা চালিয়েছেন উদ্যানবিদ ড. কল্যাণ চক্রবর্তী। ICAR-AICRP on Fruits অর্থাৎ ভারতীয় কৃষি গবেষণা অনুসন্ধান পরিষদের অর্থানুকূল্যে সর্বভারতীয় ফল গবেষণা প্রকল্পের কাজ সেখানে সম্পন্ন হয়েছে৷ নতুন বাগিচা যারা করবেন এজন্য জুন-জুলাই মাসে গাছের চারা লাগাতে হবে৷ স্বাস্থ্যবান, রোগমুক্ত জোড়কলমের চারা ভালো প্রতিষ্ঠান থেকে সংগ্রহ করতে হবে। একটা বাগান তৈরি হয়ে যাওয়ার ৭-৮ বছরের পর থেকে অর্থকরী ফল দান করতে পারে এইরকম বাগিচা এবং এইরকম তাৎপর্যপূর্ণ ফলন। তার আগে প্রথম দুই -এক বছরের জন্য ফুলের মুকুল ভেঙে দিলে গাছের পত্রল বৃদ্ধি ভালো হয় বলে দেখা গেছে। প্রথম ৫ বছরে আমগাছে যথার্থ কায়াদান (Training) এবং ডালপালা ছাঁটার দ্বারা (Pruning) গাছের একটি কাঙ্ক্ষিত আকার দান করতে হয়। গাছের বেড়ে ওঠার নানান পর্যায়ে আগাছা দমন, সেচের বন্দোবস্ত, সার প্রয়োগ, উদ্ভিদ রক্ষার ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করতে হবে৷ ট্রেনিং-প্রুনিং অর্থাৎ গাছের কায়াদান ও ডালপালা ছাঁটার পর সঠিকভাবে বোর্দো মিশ্রণের লেই বা পেস্ট তৈরি করে কাটা জায়গায় প্রলেপ দিতে হবে।
প্রতিটি গাছের গোড়ায় বেসিন করে শুখা মরশুমে সেচ দেওয়ার সময় মনে রাখতে হবে শীতকালে সেচ নয়। অবশ্য ছোটো চারায় অফলা গাছে শীতকালেও জীবনদায়ী সেচের জল দিতে হবে৷ গাছে সার প্রয়োগ কীভাবে করা হবে তা এইরকম — ১ থেকে ৫ বছর বয়সে হেক্টরে ৬-৫ টন খামার পচা সার দরকার হবে, ৫ থেকে ৭ বছর বয়সের গাছে এই পরিমাণটি হবে ৮.৫ টন এবং ৮ থেকে অধিক বছর বয়সী বাগিচায় হেক্টরে ১১ থেকে ১২ টন পরিমাণ খামারপচা জৈবসার লাগবে। জুন-জুলাই মাসে এবং পরে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে হেক্টরে ইউরিয়া সার দিতে হবে যথাক্রমে ১২০, ১৮০ এবং ২৪০ কেজি; সিঙ্গেল সুপার ফসফেট যথাক্রমে ১৯০, ১৯০ এবং ৩৮২ কেজি আর মিউরিয়েট অফ পটাশ যথাক্রমে ৫০, ৫০ এবং ৯৫ কেজি৷
জমিতে পাওয়ার টিলার দিয়ে বা সাথীফসল চাষ করে বিশেষত বরবটি, মুগডাল বুনে আগাছার চাপ কমানো যায়, পাশাপাশি মাটিতে নাইট্রোজেনের মাত্রাও বাড়িয়ে ফেলা যায়৷ মাটিতে রাউণ্ডআপের মতো হার্বিসাইড প্রয়োগ করেও আগাছার চাপ কমানো যায়।
গাছের অ্যান্থ্রাকনোজ বা কালো পচা দাগ রোগের আক্রমণ প্রতিহত করতে বর্ষাকালে স্টিকার বা আঠাসহ ২/৩ বার ৪.৫ লিটার প্রোপিকোনাজল ৪৫০০ লিটার জলে গুলিয়ে ১৫ দিন অন্তর প্রয়োগ করা যেতে পারে। ফোলিয়ার ব্লাইট বা ডগা ধ্বসা রোগের প্রতিকারে ২/৩ বার ট্রাইফ্লক্সিস্ট্রোবিন অথবা হেক্সাকোনাজোল আঠা দিয়ে ১৫ দিন অন্তর স্প্রে করা যেতে পারে৷ এক হেক্টর আমবাগানে একটি স্প্রে-র জন্য ৪.৫ লিটার ছত্রাকনাশক এবং ৪৫০০ লিটার জল লাগবে৷ পাউডারি মিলডিউ রোগ দমনের জন্য প্রথম স্প্রে দিতে হবে ভিজে যায় এমন গন্ধক বা ওয়েটেবেল সালফার ৪৫০০ লিটার জলে ৬ কেজি পরিমাণ মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। এই কাজটি ফুল ফোটার আগেই সেরে ফেলতে হবে যখন মুকুলের আকৃতি ৩-৪ ইঞ্চি মাপের হয়৷ দ্বিতীয় দফায় আরও ১০ দিন পর ৪.৫ লিটার ট্রাইডেমেফন ৪৫০০ লিটার জলে গুলিয়ে স্প্রে করে প্রয়োগ করতে হবে। ফল চয়ন করার পর ফলগুলি গরম জলে (৫০ থেকে ৫২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়) তিরিশ মিনিটের মতো সময় ডুবিয়ে রাখলে ফসলোত্তর পচনের সম্ভাবনা কমে যায়, সংরক্ষিত অবস্থায় রোগের প্রাদুর্ভাবও কমে।
মনে রাখতে হবে আমের শোষক পোকা আমচাষে বিশেষ সমস্যা। এর দমন প্রক্রিয়ায় তিনটি স্প্রে বাঞ্ছনীয়৷ প্রথম দফায় মুকুল নির্গত হবার পর ৪৫০০ লিটার জলে ১৮ মিলিলিটার স্পিনোস্যাড ৪৫ এসএল গুলে ছেটাতে হবে। দ্বিতীয় দফায় ২১ দিন পর থায়ামিথোক্সাম ২৫ ডবলিউজি কেমিক্যালটি ৩৬ মিলিলিটার পরিমাণ নিয়ে ৪৫০০ লিটার জলে গুলিয়ে ছেটাতে হবে৷ তৃতীয় দফায় যদি প্রয়োজন হয়, তবেই ৪৫০০ লিটার জলে ৬ লিটার নিমাজল গুলে এক হেক্টর বাগানের জন্য স্প্রে করতে হবে। আমের ক্ষেত্রে ফলের মাছি বা ফ্রুটফ্লাই দমনও অত্যাবশ্যকীয়। এরজন্য বোতলের ফাঁদ (Bottle trap) ব্যবহার করতে হয়। তাতে মিথাইল ইউজিনল নামক রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করে হেক্টরে ৮-১০ টি ট্র্যাপ বাঁধা হয়। সুলিপোকা বা ফ্রুট বোরার দমন করতে আক্রান্ত ও পতিত ফল কুড়িয়ে বিনষ্ট করা উপযুক্ত কাজ। থায়ামিথোক্সাম ২৫ ডবলিউজি কেমিক্যালের ৩৬ মিলিলিটার পরিমাণ মেপে ৪৫০০ লিটার জলে গুলিয়ে ছেটাতে হবে যখন ফলের আকৃতি মার্বেলের মতো হবে। এছাড়াও ১৫ দিন অন্তর দু’বারের জন্য ডেল্টামেথ্রিন ৪৫০০ লিটার জলে ২ লিটার পরিমাণ মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
মনে রাখতে হবে বর্গাকার পদ্ধতিতে ১০x১০ মিটার দূরত্বে হিমসাগর জাতের গাছ লাগিয়ে হেক্টরে ৯০ হাজার টাকা প্রফিট করা যায়, সেখানে এই পদ্ধতিতে চারা লাগিয়ে ১.২০ লক্ষ টাকা লাভ করা সম্ভব হয়েছে বলে গবেষণায় জানা গেছে। প্রকল্প আধিকারিক অধ্যাপক দিলীপ কুমার মিশ্র এই প্রযুক্তি কৃষকের মধ্যে ছড়িয়ে দেবার জন্য বিজ্ঞানীদের পুরো টীম নিয়ে কাজ করছেন এবং প্রশিক্ষণরত কৃষকদের পরিবেশন করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্রের মাধ্যমে এবং মাঠে নিয়মিত প্রযুক্তি সম্প্রসারণের মাধ্যমে তা ছড়িয়ে পড়ছে।