
কদিন আগে রেড রোডে ইদের নমাজে গিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার পর সেই ছবি নিয়ে সমাজমাধ্যমে কী ধরনের সমালোচনা হয়েছিল, তা অনেকেরই জানা। সোমবার কালীঘাটে স্কাইওয়াকের উদ্বোধন করতে গিয়ে রেড রোডের অনুষ্ঠানের কথা সরাসরি মুখে আনলেন না মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে স্পষ্ট ইঙ্গিত করে প্রশ্ন তুললেন, এত অসহিষ্ণুতা কেন? তাঁর কথায়, “আমি অন্য কোনও প্রোগ্রামে গেলেই আমার বিরুদ্ধে লেখা হয়। আমার টাইটেলও বদলে দেওয়া হয়। অথচ আমি বরাবরই বলি ধর্ম যার যার, উৎসব সবার”।
বাংলায় বিক্ষিপ্ত কিছু এলাকায় গত কয়েকদিন ধরে গোষ্ঠী সংঘর্ষের পরিস্থিতি চলছে। সোমবার নতুন করে আগুন জ্বলেছে ভাঙরে। এহেন অবস্থায় অনেকেই মনে করছিলেন, সোমবার কালীঘাটে স্কাইওয়াকের উদ্বোধন মঞ্চ থেকে মুখ্যমন্ত্রী থেকে সরাসরি বা ইঙ্গিতপূর্ণভাবে কিছু কথা বলবেন। এদিন সেটাই করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

স্কাইওয়াক তৈরির নেপথ্য কাহিনী তিনি বর্ণনা করার পর সরাসরি চলে এসেছেন ধর্মীয় সহিষ্ণুতার প্রসঙ্গে। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “ধর্ম মানে তো শ্রদ্ধা, ধর্ম মানে ভালবাসা, ধর্ম মানে শান্তি, ধর্ম মানে স্বস্তি, সংস্কৃতি, সম্প্রীতি”। তাঁর কথায়, “আমরা জন্মের সময়ে একা আসি। একাই চলে যাই। তাই কীসের ধর্ম, কীসের দাঙ্গা। মানুষকে ভালবাসার থেকে বড় ধর্ম আর কিছু হতে পারে না”।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “আমি আগেও বলেছি, কারও উপর যদি আঘাত আসে তা সে সে বঞ্চিত হোক, নির্যাতিত হোক, পিছিয়ে পড়া হোক—আমরা বরদাস্ত করব না। শান্তিপূর্ণভাবে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অধিকার সবার রয়েছে। অবশ্যই পুলিশের অনুমতি নিতে হবে। কিন্তু কেউ আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না। কেউ কেউ প্ররোচনা দেবে, তার ফাঁদে পা দেবেন না। তাহলে যারা প্ররোচনা দিচ্ছে তাদেরই জয় হবে”।
কিসের অশান্তি? মনে রাখবেন মানুষকে ভালবাসলে সবকিছু জয় করা যায়। কিন্তু নিজেকে আলাদা করে রাখলে, বিচ্ছিন্ন করে রাখলে কাউকে জয় করা যায় না।’’
মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “বাংলার মাটি সোনার চেয়েও খাঁটি। তাই বাংলার ঘরে ঘরে বিজয় পতাকা উড়িয়ে দাও সবার উপরে। এই মাটিটাকে ভালবাসো”।

আইন হাতে তুলে নেওয়া প্রসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘‘শান্তিপূর্ণ ভাবে গণতান্ত্রিক আন্দোলন করার অধিকার সকলের আছে। অবশ্যই অনুমতি নিয়ে। কিন্তু দয়া করে, সে যে-ই হোক এ, বি, সি, ডি, ই, এফ, জি, এইচ— আইন কখনও হাতে তুলে নেবেন না। আইনের জন্য তো আইনের রক্ষক আছে। আইনের ভক্ষক তো দরকার নেই।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘আপনাদের অনুরোধ করব, কেউ কেউ প্ররোচনা দেবে, কিন্তু প্ররোচিত হবেন না। প্ররোচনার সময় যে মাথা ঠান্ডা রাখে সেই তো আসল জয় করে। তখনই তো আসল জয় হয়।’’
বস্তুত মুর্শিদাবাদ ও ভাঙরের ঘটনা নিয়ে বাংলার রাজনীতি এখন উত্তপ্ত। মুর্শিদাবাদে গোষ্ঠী সংঘর্ষের ঘটনা নিয়ে সরাসরি সরকারকেই দায়ী করেছে বিজেপি। শুভেন্দু অধিকারী-সুকান্ত মজুমদারদের অভিযোগ, এ হল সরকার ও শাসক দলের মদতপুষ্ট সংঘর্ষ। যে সংঘাতে ঘর ছাড়া হচ্ছেন সংখ্যাগুরু হিন্দুরা। বাংলার ঘটনা নিয়ে বিশেষ তদন্তকারী দল গঠনের দাবিতে সুপ্রিম কোর্টে মামলাও দায়ের হয়েছে।
তবে সেই চাপানউতোরে মুখ্যমন্ত্রী যাননি। তিনি বলেন, কাল থেকে নতুন বছর শুরু হচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রী বোঝাতে চান, বাংলায় শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থানই সকলের লক্ষ্য হওয়া উচিত। তাঁর কথায়, “বাংলা বরাবরই সবাইকে আপন করে নিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয়—সবারে করি আহ্বাণ, এসো উৎসুকচিত্ত, এসো আনন্দিত প্রাণ॥ হৃদয় দেহো পাতি, হেথাকার দিবা রাতি, করুক নবজীবনদান”।

নিজের বক্তৃতার শেষের দিকে মমতা প্রশ্ন তোলেন, ‘‘ধর্ম বলতে আমরা বুঝি ভক্তি, স্নেহ, মানবতা, শান্তি, সৌহার্দ্য, সংস্কৃতি, সাদৃশ্য এবং ঐক্য। মানুষের প্রতি ভালবাসা যে কোনও ধর্মের অন্যতম সর্বোচ্চ প্রকাশ। আমরা একা জন্মাই এবং একা মারা যাই, তা হলে কেন লড়াই? কেন দাঙ্গা, যুদ্ধ বা অশান্তি?’’
