দেশের সময় : মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পোড় খাওয়া রাজনীতিক। তিনি মানুষের চোখ দেখে নাড়ির গতি বুঝতেই পারেন, তার মধ্যে বিষ্ময়ের কিছু নেই। কিন্তু সাধারণ পর্যবেক্ষকদের অনেকেরই সেই ধারণা ছিল না। এক্সিট পোলের মতো গেরুয়া ঝড়ের পূর্বানুমান আন্দাজ না করলেও, কেউ কেউ ভেবেছিলেন বিজেপি অন্তত আগের লোকসভা ভোটের মতো ফল করবে।
শনিবার শেষ দফার ভোটের পর বুথ ফেরত সমীক্ষা প্রকাশ করেছিল তামাম সংবাদমাধ্যম। পরদিন তীব্র অসন্তোষের সঙ্গে সেই সমীক্ষার পূর্বানুমান খারিজ করতে চেয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে কথা বলেছিলেন, তা এই ভোটের পর হয়তো ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখবে তৃণমূল। দিদি বলেছিলেন, আমি টানা দু’মাস প্রচার করেছি। মানুষের চোখ দেখেছি। এত খারাপ ফল কখনওই হবে না।
হলও তাই । বাংলায় ধরাশায়ী হল বিজেপি। আর উত্তর থেকে দক্ষিণ গোটা রাজ্যে স্যুইপ করল তৃণমূল। এখন কৌতূহলের বিষয় হল, কি ভাবে এমন বিষ্ময়কর ফল করল তৃণমূল।
উনিশ ও একুশের ভোটের পর এবার বাংলায় যে টার্গেট নিয়েছিল বঙ্গ বিজেপি, তার থেকে অনেকটা পিছনেই থমকে গেছে পদ্ম শিবির।
বাংলায় শাসক দলের শীর্ষ নেতাদের মতে, তার অবশ্যই একটা বড় কারণ হল লক্ষ্ণীর ভাণ্ডার প্রকল্প সহ তৃণমূল সরকারের জনমুখী প্রকল্পের বাস্তবায়ণ। বিপুল সংখ্যক মহিলা এবারও তৃণমূল তথা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পক্ষেই তাঁদের মত দিয়েছেন। সন্দেশখালি বিতর্ক তাদের উপর তেমন প্রভাব ফেলেনি।
দুই, এই ভোটে বিজেপি গোটা বিতর্ককেই তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার বিষয়আশয়ের দিকে ঘোরাতে চেয়েছিল। দশ বছর ধরে কেন্দ্রে মোদী সরকার কী করেছে, কত মানুষের রোজগার দিয়েছে, দেশের কী উন্নয়ন হয়েছে, তার উত্তর দেয়নি। উল্টে নরেন্দ্র মোদী বার বার বাংলায় প্রচারে এসে স্রেফ হিন্দু-মুসলমান করে গেছেন। এই নেতিবাচক রাজনীতি মানুষ নেয়নি।
শাসক দলের নেতাদের মতে, সর্বোপরি এই জয়ের নেপথ্যে রয়েছে তৃণমূলের সাংগঠনিক তাকত। উনিশের ভোটে বালাকোট পরবর্তী অধ্যায়ের যে উগ্র জাতীয়তাবাদের হাওয়া উঠেছিল, সেই শাক দিয়ে মাছ ঢেকেছিলেন মোদী।
বাংলায় বিজেপির সংগঠন না থাকলেও শুধু সেই তরঙ্গে জিতে গেছিল বিজেপি। এবার বিজেপি বা মোদীর পক্ষে তেমন কোনও স্রোত ছিল না। বরং বিজেপি কেন্দ্রীয় বাহিনী আর কেন্দ্রীয় এজেন্সি দিয়ে জনাদেশকে প্রভাবিত করে ভোটে জেতার যে চেষ্টা করেছিল, তা ভেস্তে দিয়েছে তৃণমূলের সংগঠন।
বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী অবশ্য দাবি করেছেন, তৃণমূল গ্রামে গঞ্জে ভয় দেখিয়েছে। পুলিশকে দিয়ে চমকানো হয়েছে। গ্রামের মহিলাদের বোঝানো হয়েছে, তৃণমূল হেরে গেলে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার ও সরকারি সুবিধা বন্ধ করে দেবে। এই কাজটা সাগরদিঘির ভোটের পরও করেছিল। তাতেই মানুষ ভয় পেয়েছে। আর তৃণমূলকে ভোট দিয়েছে।
তৃণমূল সরকারের মন্ত্রী শশী পাঁজার কথায়, মোদীর মিথ্যাচার, স্বৈরাচারী শাসকের ভয়ঙ্কর চেহারা দেখে মানুষ ভয় পেয়েছিল। বুঝেছিল, এরা ক্ষমতায় ফিরলে দেশ ও সমাজের আরও ক্ষতি হবে।
বিজেপি বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলিকে এক ছাতার তলায় এনে ইন্ডিয়া জোট গঠনের ক্ষেত্রে অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই। ইন্ডিয়া জোটের নামকরণও তাঁরই করা। আর এবার বিরোধীদের আঞ্চলিক দলগুলির মধ্যেও অন্যতম সেরা পারফর্ম্যান্স মমতার দলেরই। এখনও পর্যন্ত যা হিসেব ইন্ডিয়া জোটের মধ্যে তৃতীয় সর্ববৃহৎ আসন-শক্তি তৃণমূলেরই। প্রথম অবশ্যই কংগ্রেস। এরপর উত্তর প্রদেশে অখিলেশদের সমাজবাদী পার্টি। তারপরই সবথেকে বেশি আসন মমতার তৃণমূলের দখলে।
আঞ্চলিক দলের নেতাদের মধ্যে নির্বাচনের আগে অরবিন্দ কেজরীবালকেও নিয়েও যথেষ্ট চর্চা হয়েছে। দিল্লি ও পঞ্জাব – দুই জায়গায় সরকার রয়েছে আম আদমি পার্টির। কিন্তু কেজরীর গ্রেফতারির পর ‘সহানুভূতি-ভোট’ মোটেই টানতে পারেনি আপ। দিল্লিতে হোয়াইট ওয়াশ হয়ে গিয়েছে বিজেপির কাছে। আর পঞ্জাবে ১৩টি আসনের মধ্যে মাত্র তিনটি আসন জিতেছে কেজরীর দল।
লোকসভা ভোটে কেজরীর দল একপ্রকার মুখ থুবড়ে পড়েছে। আর অন্যদিকে বাংলার ফলাফল, যেখানে তৃণমূলের ধারে কাছে ঘেঁষতে পারল না বিজেপি। বিজেপি বিরোধী লড়াইয়ে এই লোকসভা ভোটের ফলাফল তৃণমূলের তথা দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে জাতীয় রাজনীতিতে বাড়তি অক্সিজেন জোগাল বলেই মনে করছে রাজনৈতিক মহল।