দেশের সময়: গ্রামের মানুষ তৃণমূলকে উজাড় করে ভোট দিয়েছেন। কিন্তু শহরের বেশিরভাগ জায়গাতেই ভোটাররা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে দিয়েছেন। পুর এলাকায় ভোটের ঝুলি ভরেছে বিজেপির। এই ছবিটা সামনে আসতেই বেজায় চটেছেন তৃণমূল সুপ্রিমো তথা বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কেন এমনটা হল সে বিষয়ে রীতিমতো কৈফিয়ৎ তলব করেছেন তিনি।
সোমবার ডাকা হয়েছে রাজ্যের সমস্ত পুরসভার প্রতিনিধিদের। ওই বৈঠকে কার্যত তুলোধোনা করতে পারেন মুখ্যমন্ত্রী। কারণ, ইতিমধ্যেই তিনি চরম অসন্তোষ প্রকাশ করে জানিয়েছেন, পুর এলাকা থেকে জল নিকাশি ব্যবস্থা, বর্জ্য অপসারণ, রাস্তাঘাট বেহালের মতো ভূরি ভূরি অভিযোগ তাঁর কাছে এসেছে।
কেন এত অভিযোগ?তাহলে পুর প্রতিনিধিরা কি করছেন, এসব প্রশ্নে মমতা কার্যত ক্ষুব্ধ। সেই ক্ষোভ তিনি চেপে রাখেননি। পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম সহ কয়েকজন শীর্ষ আমলার সামনেই তা উগরে দিয়েছেন। এবার পুরসভার চেয়ারম্যানদের ডেকে এ ব্যাপারে তাঁদের বক্তব্য জানতে চাইছেন মমতা। স্বাভাবিকভাবেই এটা স্পষ্ট, যে সমস্ত পুর এলাকায় লোকসভায় তৃণমূলের ফল খারাপ হয়েছে, সেখানকার পুর চেয়ারম্যানদের মুখ্যমন্ত্রীর তোপের মুখে পড়তে হচ্ছে।
ঘনিষ্ঠ মহল সূত্রের খবর, মমতা পুরসভার পারফরমেন্সের জন্য সময় বেঁধে দিতে চান। সেই সময়ের মধ্যে পুর পরিসেবায় যদি উন্নতি না হয়, তাহলে তিনি সংশ্লিষ্ট পুরসভার চেয়ারম্যানও বদল করতে পারেন। এই খবর চাউর হতেই তৃণমূল পরিচালিত পুরসভার চেয়ারম্যানদের মধ্যে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা শুরু হয়েছে। তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য কয়েকদিন আগেই স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, কাজ করতে না পারলে পদ আঁকড়ে থাকা যাবে না, সে তিনি যেই হোন না কেন। তাঁর বক্তব্য ছিল, যদি কোনও জনপ্রতিনিধির এলাকায় গ্রহণযোগ্যতা কমে আসে, তাহলে বুঝতে হবে, মানুষ তাঁকে আর চাইছেন না। ফলে শুধু শুধু পদ আঁকড়ে থাকতে পারবেন না তিনি। পদ ছাড়তে হবে তাঁকে।
অভিষেকের পর পুরসভা এলাকা নিয়ে মমতার কড়া অবস্থানে স্পষ্ট, ২০২৬ সালের বিধানসভা ভোটের দিকে তাকিয়ে এখন থেকেই শক্ত হাতে হাল ধরতে চাইছেন তৃণমূল সুপ্রিমো। কারণ, এবারের লোকসভা ভোটের ফল বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, বিজেপি এ রাজ্যে বারোটি আসনে থমকে গেলেও রাজ্যে প্রায় ৯০ টির মতো বিধানসভা এলাকায় এগিয়ে রয়েছে তারা। শুধু তাই নয়, তৃণমূল পরিচালিত বনগাঁ পুরসভা হোক কিংবা উত্তরবঙ্গের শিলিগুড়ি বা ইংলিশবাজার সর্বত্রই দেখা যাচ্ছে তৃণমূল কাউন্সিলরদের ওয়ার্ডে লোকসভায় পিছিয়ে পড়েছে জোড়াফুল।
কয়েকদিন আগে দমদম লোকসভা কেন্দ্রের সাংসদ সৌগত রায় প্রকাশ্যে স্বীকার করেছেন, গ্রামের মানুষ তৃণমূলকে ঢালাও ভোট দিলেও শহরে যারা বহুতল আবাসনে বাস করেন, তাদের একাংশ তৃণমূলকে ভোট দেননি।
এখানেই মমতার প্রশ্ন, কেন এমনটা হল? ওয়াকিবহাল মহলের বক্তব্য, রাজ্যের যে সমস্ত জনমুখী প্রকল্পগুলি চালু আছে তা যেমন গ্রামেও চলছে, তেমনি শহরেও চলছে। তাহলে গ্রামের মানুষ যদি সেসব প্রকল্পের সুবিধা পেয়ে তৃণমূলকে উজাড় করে ভোট দিতে পারে, তাহলে শহরের মানুষ কেন মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে, এর পিছনে রয়েছে পুর এলাকায় সিন্ডিকেটরাজ, প্রমোটাররাজ, ফুটপাত দখল, জল নিকাশি ব্যবস্থা বেহাল, রাস্তাঘাট খারাপ, নেতাদের দাদাগিরি, অটো টোটো থেকে জোর করে টাকা আদায়, কর্মসংস্থান না হওয়া, সবমিলিয়ে শহরের মানুষ অসন্তুষ্ট। আর তারই প্রভাব পড়ছে ভোটের ফলে। সে কারণেই মমতা চাইছেন, পুর পরিষেবার উন্নয়ন ঘটিয়ে শহরের মানুষের মনে জমা অসন্তোষ দূর করতে।
গত বৃহস্পতিবার নবান্নে প্রতিটি দপ্তর এবং জেলা প্রশাসনের শীর্ষ আধিকারিকদের নিয়ে পর্যালোচনা বৈঠক করেন মুখ্যমন্ত্রী। সেখানে হাওড়া পুরসভার বেহাল পরিস্থিতির কথা বলতে গিয়েই জল, জঞ্জালের প্রশ্ন তোলেন তিনি। দৃশ্যত ক্ষুব্ধ মমতা জানতে চান, কেন এমন পরিস্থিতি? মানুষ পুর পরিষেবা পাচ্ছেন না কেন?
প্রসঙ্গত হাওড়া ও বালি পুরসভায় প্রায় ছয় বছর ভোট হয়নি। ফলে কোনও ওয়ার্ডেই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি নেই। ওই দুই পুরসভার তরফে জানানো হয়েছে, ওয়ার্ডে কাউন্সিলর না থাকার কারণে পরিষেবা দিতে অসুবিধা হচ্ছে। এ কথা শোনার পরই মমতা পাল্টা প্রশ্ন করেন, তাহলে বাকি পুরসভাগুলির এই হাল কেন? কেন সেখান থেকে মানুষের এত অভিযোগ আসছে?
জেলাশাসক, অতিরিক্ত জেলাশাসকরা কেন এ ব্যাপারে নজর দিচ্ছেন না? মানুষকে সমস্যায় ফেলে কার লাভ? ওই বৈঠকে ছিলেন পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম, বিদ্যুৎ মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস, দমকলমন্ত্রী সুজিত বসু সহ বেশ কয়েকজন মন্ত্রী। তাঁদের সামনেই মমতা প্রশ্ন করেন, বর্ষা এসে যাচ্ছে। কীভাবে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হবে, তার রোডম্যাপ তৈরি আছে তো? নাকি জল যন্ত্রণায় ভুগে মানুষ তাদের ক্ষোভ উগরে দেবে?
এখানেই শেষ করেননি মমতা। বিভিন্ন দপ্তর যেভাবে বিদ্যুৎ অপচয় করছে তা নিয়েও সরব হয়েছেন তিনি। বলেছেন, অনেক অফিসে কর্মীরা বাড়ি চলে যাওয়ার সময় লাইট, ফ্যান চালিয়ে চলে যাচ্ছেন। এটা ঠিক নয়। রাস্তা তৈরির পর পাঁচ বছর তা রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নির্মাণকারী সংস্থার। তাহলে সেই রাস্তা কিছুদিনের মধ্যেই খারাপ হয়ে যাচ্ছে কেন? এর পিছনে কী রয়েছে!
শুধু পুর পরিসেবা নয়, বিভিন্ন শহর এলাকায় যেভাবে সরকারি জমি দখল হয়ে যাচ্ছে তা নিয়েও এবার কড়া অবস্থান নিতে চলেছেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, যারা সরকারি জমি দখল করছে, তাদের কোনওভাবেই রেয়াত করা হবে না। শহরের পাশাপাশি গ্রামাঞ্চলেও যাতে পরিষেবা নির্বিঘ্নভাবে পৌঁছয়, সেটাও নিশ্চিত করতে চাইছেন মমতা। এজন্য পঞ্চায়েত সমিতি, জেলা পরিষদ এবং গ্রাম পঞ্চায়েতগুলিকেও স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজ করতে নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। লোকসভা ভোটের ফলপ্রকাশের পর থেকেই মুখ্যমন্ত্রী এবার যথেষ্ট কড়া হাতে প্রশাসন পরিচালনা করতে চাইছেন।
কয়েকদিন আগেই তিনি অভিযোগ করেন, নবান্ন থেকে খবর বাইরে পাচার হচ্ছে। পুলিশের একাংশ ট্রাক থেকে তোলা তুলে তা কাঁথিতে পাচার করছে। আর এবার মমতা জানিয়ে দিয়েছেন, আমলাদের কাজকর্মের উপরেও যে রিপোর্ট তৈরি হয় তা তিনি নিজেই তদারকি করবেন। অর্থাৎ কোন আমলা সারা বছর ধরে কী কাজ করছেন তা দেখে তিনি নিজে তাঁদের নম্বর দেবেন। সেই মতো তাঁদের পরবর্তী পোস্টিং হবে। এতদিন আমলাদের কাজের যে বার্ষিক মূল্যায়ন হতো অর্থাৎ যে কনফিডেন্সিয়াল রিপোর্ট তৈরি হতো, সেই রিপোর্টে আমলারা সারা বছর কী কাজ করেছেন, কোনটা পারেননি, তার ভিত্তিতে তৈরি হওয়া রিপোর্ট পৌঁছতো মুখ্যসচিবের কাছে। সেই মতো নম্বর দেওয়া হতো। এবার মুখ্যমন্ত্রী সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, নম্বর দেওয়ার আগে যেন তাঁর সঙ্গে কথা বলে নেওয়া হয়।