দেশের সময় : সম্প্রতি একটি সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দাবি করেছিলেন, ‘আমি কখনও হিন্দু-মুসলিম করি না। আমার অনেক মুসলিম বন্ধু ছিলেন গুজরাটে, তাঁদের সঙ্গে আমি ঈদ-ও উদ্যাপন করতাম!’ তার পর দিনই আর এক জায়গায় বলেছিলেন, মনমোহন সরকার মুসিলমদের জন্য আলাদা বাজেট করতে গিয়েছিল। বিজেপির বাধায় তা নাকি হয়নি!
শুক্রবার সে সব কিছুও ছাপিয়ে গেল। উত্তরপ্রদেশের বরাবাঁকির সভায় ধর্মনিরপেক্ষ দেশের প্রধানমন্ত্রী বললেন, ‘কংগ্রেস ও সমাজবাদী পার্টি অর্থাৎ ইন্ডিয়া জোট যদি কোনও ভাবে ক্ষমতায় এসে পড়ে তা হলে তারা অযোধ্যার রামলালার মন্দিরের উপর দিয়ে বুলডোজ়ার চালাতে দু’বার ভাববে না। তাঁর আবার আশ্রয় হবে তাঁবুতে। কাজেই ভোট দেওয়ার আগে ভেবে দেখুন!’ কংগ্রেসকে তীব্র আক্রমণ করে তাঁর সংযোজন, ‘ওরা ক্ষমতায় এলে সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া রামaaমন্দির-রায় পাল্টে দিতে পারে, তাই সাবধান।’ এর পরেই উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের (যাঁকে স্থানীয়রা আবার ‘বুলডোজ়ার বাবা’ বলেও সম্বোধন করেন) ভূয়সী প্রশংসা করে বলেন, ‘ওঁর থেকে বিরোধীদের শেখা উচিত বুলডোজ়ার কোথায় কখন চালাতে হবে। ওটা মন্দিরের উপর চালানোর কথা নয়। সেটা কি ওঁরা (রাহুল গান্ধী-অখিলেশ যাদব) বুঝবেন?’
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করছেন, মোদী যে পর্যায়ে ধর্মীয় মেরুকরণকে নিয়ে গেছেন, তা ২০১৪ বা ২০১৯-এর ভোটে প্রয়োজন হয়নি। তাঁদের মতে, রামমন্দির গড়ে ও তা এ বছরের গোড়ায় উদ্বোধন করে দিয়ে হিন্দু ভোট ঝুলিতে টানা যতটা সহজ হবে বলে গেরুয়া শিবির ভেবেছিল, প্রথম চারটি পর্যায়ের ভোটে বোধহয় সেই লক্ষ্যপূরণ হয়নি। ফলে মোদী পুরোপুরি এখন মরিয়া হয়ে ভোট চাইছেন।’
তাঁদের ব্যাখ্যা, লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে প্রথম দফার ভোটের পর থেকেই বিজেপির ন্যারেটিভ বদলে যায়। ‘৪০০ পার’ বা ‘মোদী কি গ্যারান্টির’ জায়গায় বেশি গুরুত্ব পেতে থাকে ধর্ম, সংরক্ষণ ও কিছু ক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদ! আর তার সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন খোদ মোদী।
আবার ক্ষেত্র বিশেষে এমন কথাও বলছেন, যাতে মুসলিমরাও তাঁকে বা তাঁর দলকে ভোট দেন! বিশ্লেষকরা তাই এক রকম নিশ্চিত, শুধু হিন্দু ভোটে আর আস্থা রাখতে পারছেন না তিনি। তাই সিচুয়েশন ও অঞ্চলের ডেমোগ্র্যাফি বুঝে তিনি ধর্মীয় তাস খেলছেন।
যেমন একটি সাক্ষাৎকারে মোদী এ দিন বলেছেন, ‘রমজান মাস চলছিল। আমার বিশেষ দূতকে (কারও নাম বলেননি, তবে মার্চে ইজ়রায়েলে গিয়েছিলেন ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল) ইজ়রায়েলে পাঠিয়েছিলাম। বলেছিলাম যে, ইজ়রায়েলের প্রধানমন্ত্রী, প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করে ওঁদের বোঝান যে অন্তত রমজান মাসে যেন গাজ়ায় হামলা চালানো বন্ধ রাখা হয়। ইজ়রায়েল সেটা যতটা সম্ভব চেষ্টা করেছে। দু’তিন দিন কিছুটা আক্রমণ চলেছিল… তবে খুব বেশি নয়।’ একই সঙ্গে মোদী দাবি করেন, প্যালেস্তাইনের সঙ্গে তাঁর আত্মিক যোগ আছে। এই সবের পরেও ভারতীয় মুসলিমদের নিয়ে তাঁকে নিশানা করা হয় বলে কিছুটা আক্ষেপ প্রকাশ করেন মোদী।
এ দিন যোগীরাজ্যের হামিরপুরেও ছিল মোদীর সভা। এই কেন্দ্রে প্রধান লড়াই বিজেপির কুঁয়ার পুষ্পেন্দ্র সিংয়ের সঙ্গে সমাজবাদী পার্টির অজেন্দ্র সিং লোধির সঙ্গে। সেখানে ফের মুসলিম জুজু দেখিয়ে বলেন, ‘কংগ্রেস এবং সমাজবাদী পার্টি সরকার গড়লে জনতার অর্থ তুলে দেবে তাঁদের হাতে যাঁরা ওদের জন্য ‘ভোট জিহাদ’ চালান!’ তিনি দাবি করেন, ‘কংগ্রেস বলছে সকলের সম্পত্তির সমীক্ষা হবে। আসলে সেটা ওদের জিহাদিদের হাতে সম্পত্তি তুলে দেওয়ার ফন্দি। আপনারা সতর্ক হোন।’
কংগ্রেসের ইস্তেহার প্রকাশের পর থেকেই মোদী ওই দলকে লাগাতার আক্রমণ করে চলেছেন। এমনকী অনেক ক্ষেত্রে এমনও দেখা গিয়েছে যে, যে কথা কংগ্রেস ম্যানিফেস্টোতে উল্লেখও নেই, যেমন সকলের সম্পত্তি কেড়ে নিয়ে এমনকি মা-বোনদের মঙ্গলসূত্র কেড়ে নিয়ে মুসলিমদের হাতে তুলে দেবে সনিয়া-রাহুলের দল, তেমন দাবিও করেছেন!
সোমবার, ২০ তারিখ, পঞ্চম দফায় ভোট রয়েছে উত্তরপ্রদেশের ১৪টি আসনে। এই রাজ্যেই মোট ৮০টি আসন রয়েছে লোকসভার। সাধারণত বলা হয়ে থাকে, ‘ইউপি যার, কেন্দ্র তার।’ অর্থাৎ যে দল ওখানে বেশি সংখ্যক আসন পাবে, সেই দলের কেন্দ্রে সরকার গড়া প্রায় নিশ্চিত। ২০১৪ ও ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে এখান থেকে বিরাট সংখ্যক আসন পেয়ে কেন্দ্রে সরকার গঠন নিশ্চিত করেছিলেন নরেন্দ্র মোদী।
এ বারের ভোটে যোগীরাজ্যে কংগ্রেস এবং সমাজবাদী পার্টি লড়ছে একসঙ্গে। পর্যবেক্ষকদের বড় অংশ মনে করছেন, মায়াবতীর বিএসপি বিজেপির দিকে ঝুঁকে রয়েছে। ফলে সেই ভোট এ বার তাঁর না পাওয়ার আশঙ্কা প্রবল। বিভিন্ন কারণে বিজেপিরও সে ভোট নিজেদের দিকে টানা কঠিন হবে বলে মনে করছেন তাঁরা। ফলে সরাসরি ‘হিন্দু-মুসলিম’ তাস ছাড়া মোদী প্রায় নিরুপায়।
তবে, শুধু ধর্ম নয়, নির্বাচনে কংগ্রেস ও সপা-র ভরাডুবি হবে বলে মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রীর কটাক্ষ, ‘আমি তো শুনেছি শাহজ়াদা ও অখিলেশ বিদেশ যাওয়ার টিকিট কেটে রেখেছেন। ৪ জুন নির্বাচনের ফল বেরনোর পরেই তাঁরা বিদেশে চলে গিয়ে মুখ লুকোবেন।’ তার আগে বরাবাঙ্কির সভায় দাবি করেন, ‘অখিলেশ এখন নতুন পিসির কাছে আশ্রয় পেয়েছেন। তিনি আবার বাংলার। যিনি সম্প্রতি বলেছেন, ইন্ডিয়া জোটকে বাইরে থেকে সমর্থনের কথা।’ বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বারবারই নিশানা করছেন মোদী। এ দিনও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
মোদীর এমন প্রচারের বিরোধিতা আগেও করেছে কংগ্রেস-সহ একাধিক বিরোধী দল। কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে বলেছেন, ‘আসলে জাত-ভিত্তিক এবং আর্থ-সামাজিক সমীক্ষা আটকে দিতে চাইছেন মোদী। কংগ্রেস এবং ‘ইন্ডিয়া’ মঞ্চ এই সমীক্ষা করার ঘোষণা করেছে। কারও সম্পত্তি কেড়ে নিয়ে কাউকে দেওয়ার প্রশ্নই নেই। বঞ্চিতদের চিহ্নিত করে এগিয়ে আনার লক্ষ্য রয়েছে। মোদীর আসল আপত্তি সেখানেই।’