দেশের সময়: তা হলে বাংলা নিয়ে কি সত্যিই চাপে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব? না হলে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের অঙ্কে এমন বিভ্রাট কেন! বারবার কেন বদল হচ্ছে টার্গেট? এই প্রশ্ন কিন্তু উঠছেই।
এখনও ভোট ঘোষণা হয়নি। অথচ গত দু’সপ্তাহের মধ্যে বাংলায় চারটি সভা করে ফেলেছেন প্রধানমন্ত্রী। ত্রিপুরার বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী মানিক সাহা চলে এসেছেন। নিজে দেওয়াল লিখছেন। গেরুয়া শিবিরের দিল্লির নেতারাও ‘ডেইলি প্যাসেঞ্জারি’ শুরু করে দিয়েছেন। কিন্তু এসবের মধ্যেই বঙ্গ বিজেপিতে বিদ্রোহের আঁচ। আর এই আবহে গুলিয়ে যাচ্ছে বিজেপির ভোট-অঙ্ক। অনেক আগেই অমিত শাহ বলে দিয়েছিলেন, এবার বাংলা থেকে ৩৫ আসন চান তিনি।
সেইমতো ময়দানে গা ঘামাতে শুরু করেন বঙ্গ বিজেপির নেতারা। কিন্তু তাল কাটে দিন কয়েক আগে। কৃষ্ণনগরের সভা থেকে মোদি দলের কর্মীদের উদ্দেশে নির্দেশ দেন, বাংলায় ৪২টি আসনের সবক’টিতেই পদ্ম ফোটাতে হবে। অর্থাৎ, ৪২-এ ৪২ চায় তাঁর। প্রধানমন্ত্রীর এই বার্তার পরই রীতিমতো চাপে পড়ে যায় বাংলার বিজেপি নেতৃত্ব। আড়ালে আবডালে গেরুয়া শিবিরের নেতারা বলতে শুরু করেন, কীভাবে সম্ভব! এই পরিস্থিতিতে বঙ্গ বিজেপির অবস্থা বুঝে কার্যত ত্রাতা হয়ে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন অমিত শাহ।
তাঁর আগের অবস্থান থেকে সরে এসে দলের সেকেন্ড ইন কমান্ড একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, বাংলায় এবার বিজেপি ২৫টি আসন পাবেই। তাঁর এই মন্তব্যের পরই কানাঘুঁষো শুরু হয়ে গিয়েছে দলের অন্দরে ও বাইরে। ৩৫ থেকে একধাক্কায় কেন ২৫-এ নেমে এলেন শাহ? তা হলে কি তিনি বঙ্গ বিজেপির হাল যে খারাপ, এমন আভাস পেয়েছেন?
নাকি মোদির দেওয়া টার্গেট যে বাংলায় পূরণ করা সম্ভব নয়, সেটা বুঝেই সংখ্যাটা কার্যত অর্ধেক করে দিয়েছেন। আর এটাও যদি না হয়, সেক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠছে, বাংলায় দলের হাল নিয়ে মোদি ও অমিত শাহের কাছে কি আলাদা আলাদা রিপোর্ট যাচ্ছে? সেকারণেই কি তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে তাঁদের ভোট-অঙ্কে?
উত্তর যাই হোক না কেন, বাংলায় দলের অবস্থা যে ২০১৯-এর চেয়ে ঢের খারাপ, তা মানছেন বিজেপির অনেক নেতাই। তাঁদের বক্তব্য, প্রথম দফার প্রার্থী তালিকা ঘোষণা হয়েছে সবে। তাতেই যা বিদ্রোহের আঁচ দলে, পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ হওয়ার পর অবস্থা কী দাঁড়াবে, সেটাই ভেবে পাচ্ছেন না তাঁরা।
উত্তর থেকে দক্ষিণবঙ্গ, বিদ্রোহ সর্বত্রই। সঙ্গে চলছে দলত্যাগ। ইতিমধ্যেই বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন রানাঘাট দক্ষিণের বিধায়ক মুকুটমণি অধিকারী। বিজেপি ছেড়েছেন ঝাড়গ্রামের সাংসদ কুনার হেমব্রম। ঝাড়গ্রাম পদ্মের শক্ত ঘাঁটি হয়ে উঠেছিল। কিন্তু ভোটের মুখে খোদ এমপি দল ছাড়ায় উদ্বিগ্ন গেরুয়া শিবির। বিজেপি সূত্রে খবর, দল ছাড়ব ছাড়ব করছেন আরও অন্তত তিনজন পদ্ম-বিধায়ক। তৃণমূলের দিকে ঝুঁকে রয়েছেন টিকিট না পেয়ে বিদ্রোহী হয়ে ওঠা আলিপুরদুয়ারের সাংসদ তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জন বারলা।
রায়গঞ্জের সাংসদ তথা প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী দেবশ্রী চৌধুরীরও নাম নেই প্রথম দফার প্রার্থী তালিকায়। গোঁসা করে তিনি বাক্স-প্যাঁটরা গুছিয়ে চলে এসেছেন কলকাতায়। জলপাইগুড়ির বিজেপি সাংসদ ডাঃ জয়ন্ত রায়েরও নাম নেই প্রথম দফার প্রার্থী তালিকায়। এমনকী শনিবার শিলিগুড়িতে মোদির মঞ্চে বসার সুযোগ পাননি তিনি। জয়ন্তবাবু নিজেই বলেছেন, প্রার্থী তালিকায় নাম না থাকায় যথেষ্টই বিব্রত হতে হচ্ছে তাঁকে। কর্মীরা সারাদিন ধরে ফোন করে জানতে চাইছেন, কী হল!
তাঁদের প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে অস্বস্তিতে পড়ছেন তিনি। দার্জিলিংয়ের বিজেপি সাংসদ রাজু বিস্তারও নাম নেই প্রথম দফার প্রার্থী তালিকায়। এই আসনে মোদি ঘনিষ্ট প্রাক্তন আমলা হর্ষবর্ধন শ্রিংলার নাম নিয়ে জোর চর্চা চলছে।
এনিয়ে বেজায় চটে আছেন বিস্তা। নাম না করে তোপ দেগেছেন শ্রিংলাকে। বলেছেন, রিটায়ার করে পাহাড়ে এসে নিজেকে ভূমিপুত্র বলে দাবি করা যায় না। একইসঙ্গে তাঁর দাবি, পাহাড়ে পাঁচ বছর অন্তর বিজেপির প্রার্থী বদল করার যে ট্র্যাডিশন তা এবার ভাঙবে। এবার প্রার্থী বদল হবে না। অর্থাৎ তিনিই যে পাহাড়ে প্রার্থী হচ্ছেন, এ নিয়ে আত্মবিশ্বাস ফুটে উঠেছে তাঁর বক্তব্যে। যদিও বিজেপির একটি অংশের দাবি, দার্জিলিং কেন্দ্রে এবার প্রার্থী করা হচ্ছে না বিস্তাকে। শ্রিংলাই প্রার্থী হবেন।
বনগাঁ লোকসভা আসনে বিজেপি প্রার্থী করেছে বর্তমান সাংসদ তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শান্তনু ঠাকুরকে। এই আসনে শান্তনুকে পরিবারের কোনও সদস্যের সঙ্গেই লড়তে হবে। তৃণমূল সূত্রে খবর এমনটাই। ইতিমধ্যেই মমতাবালা ঠাকুরকে রাজ্যসভার সাংসদ করেছে তৃণমূল। তা হলে শান্তনুর বিরুদ্ধে ঠাকুরবাড়ি থেকে কাকে প্রার্থী করার কথা ভাবছে তৃণমূল? জল্পনা তুঙ্গে।
একইভাবে কোচবিহারে বিজেপি প্রার্থী তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নিশীথ অধিকারীকে কি লড়তে হবে দলেরই কোনও প্রাক্তন কর্মকর্তার সঙ্গে? এনিয়েও জোর চর্চা। বিজেপিতে অস্বস্তি বাড়িয়েছেন দলের রাজ্যসভার সাংসদ অনন্ত মহারাজও। নিশীথকে প্রার্থী করা নিয়ে দলীয় নেতৃত্ব তাঁর সঙ্গে কোনও আলোচনা করেননি বলে ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন তিনি। একইসঙ্গে বলেছেন, কোচ-রাজবংশীদের দাবি পূরণে তাঁকে যে আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল, তা নিয়ে কোনও উচ্চবাচ্য দেখছেন না তিনি।
তাহলে কি অনন্ত মহারাজেরও মোহভঙ্গ হতে চলেছে গেরুয়া শিবিরের প্রতি। আলিপুরদুয়ারে টিকিট না পেয়ে তো জন বারলা খুল্লামখুল্লা। সরাসরি তোপ দেগে বলেছেন, তাঁকে প্রার্থী হতে না দেওয়ার পিছনে কলকাঠি নেড়েছেন মনোজ টিগ্গা।
প্রসঙ্গত, মনোজকেই এবার আলিপুরদুয়ারে প্রার্থী করেছে বিজেপি। মনোজ বর্তমানে মাদারিহাটের বিজেপি বিধায়ক। প্রার্থী হয়ে তিনি প্রচারে নেমেছেন। কিন্তু বারলার অনুগামীরা তাঁকে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, চা বাগানে প্রচারে যেতে দেবেন না মনোজকে। বারলার সঙ্গে সন্ধি-স্থাপনে তাঁর বাড়িতেও গিয়েছিলেন মনোজ। কিন্তু বারলা দেখা করেননি তাঁর সঙ্গে। বলেছেন, যে আমার ক্ষতি করেছে, তার সঙ্গে দেখা করার প্রশ্নই ওঠে না।
রানাঘাট দক্ষিণের বিধায়ক মুকুটমণি বিজেপি ছাড়ার কারণ হিসেবে বলেছেন, গেরুয়া শিবির জগন্নাথ সরকারকে প্রার্থী করে উপেক্ষা করেছে জনমতকে। যাঁর বিরুদ্ধে হাজারো অভিযোগ, দুর্নীতির গন্ধ, তাঁকেই প্রার্থী করেছে বিজেপি। তাঁর তোপ, বঙ্গ বিজেপি আদর্শচ্যুত। তাহলে কি জগন্নাথের বিরুদ্ধে তিনিই তৃণমূলের প্রতীকে লোকসভায় প্রার্থী হচ্ছেন? সরাসরি না বললেও জানিয়েছেন, জগন্নাথকে হারাতেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলে যোগ দিয়েছেন তিনি। মুকুটমণির হাতে মতুয়া ভোট ব্যাঙ্কের অনেকটাই রাশ রয়েছে।
তিনি মতুয়া মহাসঙ্ঘের সভাপতি ছিলেন। তা হলে কি মতুয়া ভোট টানতে তাঁকেই প্রার্থী করবে তৃণমূল? সেক্ষেত্রে বিগত কয়েকটা নির্বাচনে তৃণমূলের মতুয়া ভোটব্যাঙ্কে যে ফাটল দেখা দিয়েছিল, এবার কি তা ফিরে আসবে?
এদিকে, বিজেপির প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষকে নিয়ে জল্পনা বাড়ছে। তাঁকে এখনও প্রার্থী করেনি পদ্ম শিবির। মোদির সভামঞ্চেও দেখা যাচ্ছে না তাঁকে। দলবদলুদের ভিড়ে পূর্ব মেদিনীপুরের বিজেপি কর্মীদের দমবন্ধ অবস্থা। এই অবস্থায় দলের বিরুদ্ধে একরাশ অভিমান নিয়ে ভিনরাজ্যে চলে গিয়েছেন বিজেপির কাঁথি সাংগঠনিক জেলা কমিটির প্রাক্তন সভাপতি অনুপ চক্রবর্তী। লোকসভার প্রচারপর্বে থাকতে চান না তিনি।
বিজেপিতে এই ভাঙনের মাঝেই চমক দিতে চলেছে তৃণমূল। অবসরের পাঁচ বছর আগেই রাজ্য সরকারের কাছে স্বেচ্ছাবসর চেয়েছেন পুলিশকর্তা প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়। বর্তমানে তিনি আইজি রায়গঞ্জ। সূত্রের দাবি, বালুরঘাট কেন্দ্রে বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের বিরুদ্ধে তাঁকে প্রার্থী করতে পারে তৃণমূল। এদিকে, বসিরহাটে ক্রিকেটার মহম্মদ সামিকে প্রার্থী করার জন্য জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বিজেপি।
প্রার্থী হিসেবে নাম ঘোষণার আগেই নন্দীগ্রামে প্রাক্তন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের নামে দেওয়াল লিখন শুরু হয়ে গিয়েছে। তাহলে কি জল্পনা সত্যি করে তিনি তমলুক আসনেই বিজেপির প্রার্থী হচ্ছেন?
অন্যদিকে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আগেই বলে দিয়েছেন, অভিজিৎ গাঙ্গুলী যেখানেই বিজেপির প্রার্থী হবেন, তাঁর বিরুদ্ধে তৃণমূলের বিরুদ্ধে প্রার্থী হিসেবে লড়বেন ছাত্র প্রতিনিধি। যে ছাত্রদের চাকরি কেড়ে নিয়েছেন প্রাক্তন বিচারপতি, তাঁরাই হারাবেন তাঁকে। তাহলে অভিজিৎ গাঙ্গুলীর বিরুদ্ধে তৃণমূল কাকে প্রার্থী করছে, তা নিয়েও চর্চা তুঙ্গে।