
কুমোরটুলি ঘাট থেকে ট্রলি ভর্তি কাটা দেহ উদ্ধারের ঘটনায় অন্যতম অভিযুক্ত ফাল্গুনী ঘোষকে সঙ্গে নিয়ে ঘটনার পুনর্নির্মাণ করেছে পুলিশ। মঙ্গলবার সকালেই কুমারটুলির ঘাট থেকে উদ্ধার হয় সুস্মিতা ঘোষের দেহ। এই খুনের ঘটনায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে আরতি ঘোষ এবং ফাল্গুনী ঘোষকে। তাঁরা সম্পর্কে মা এবং মেয়ে। সুস্মিতা ঘোষ (৫৫) ফাল্গুনীর পিসি শাশুড়ি। উত্তর ২৪ পরগনা জেলার মধ্যমগ্রাম বীরেশপল্লী বাড়িতেই সুস্মিতা ঘোষকে খুন করা হয়েছিল বলেই জানতে পেরেছে পুলিশ। মঙ্গলবার রাতে সেই বাড়িতেই ফাল্গুনীকে নিয়ে আসে কলকাতা পুলিশ এবং ফরেন্সিক টিম।
পারিবারিক বিবাদের জেরেই ওই মহিলাকে খুন করা হয়েছিল। তার পরেই তাঁর দেহ পাচার করার ছক করা হয়েছিল। পুরো ঘটনার তদন্ত শুরু হয়েছে বলে সাংবাদিক সম্মেলনে জানিয়েছেন কলকাতার পুলিশ কমিশনার মনোজ ভার্মা। পুরো ঘটনার পুনর্নির্মাণ করা হবে বলেও জানিয়েছিলেন তিনি । তার পরে মঙ্গলবার রাতেই ফাল্গুনীকে নিয়ে আসায় হয় বীরেশপল্লী বাড়িতে। সেখানে রাত সাড়ে ৮টা থেকে রাত সাড়ে ১২টা পর্যন্ত, চার ঘন্টা ধরে তদন্ত চালানোর পাশাপাশি ঘটনার পুনর্নির্মাণ করা হয় বলে পুলিশ সূত্রে খবর।
কী ভাবে এই খুন করা হয় এবং দেহ গায়েবের পরিকল্পনা করেছিলেন মা এবং মেয়ে তার গোড়ায় পৌঁছানোর চেষ্টা চালাচ্ছে কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দারা। মঙ্গলবার বিকাল থেকেই ওই এলাকা ঘিরে রাখে বিশাল পুলিশ বাহিনী। রাতেই কলকাতা পুলিশের গাড়িতে ফাল্গুনী ঘোষকে ঘটনাস্থলে নিয়ে আসা হয়। তাঁর মা আরতি ঘোষকে কলকাতা নর্থ পোল থানায় রাখা হয়েছে।

জানা গিয়েছে, তদন্তকারীরা ফাল্গুনীকে সঙ্গে নিয়ে খুনের পরিকল্পনা, ব্যবহৃত ধারালো অস্ত্র কোথায় ফেলা হয়েছে, মৃতদেহ কীভাবে সরানো হয়েছিল, কোন রাস্তা দিয়ে টলি করে দেহ নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, সবকিছু খতিয়ে দেখছেন। সেখানে পেঁপে গাছের গোড়া থেকে খুনে ব্যবহৃত কিছু জিনিস উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানা গিয়েছে। যে ঘরে খুন করা হয়েছিল সেখান থেকেও বেশ কিছু জিনিস সংগ্রহ করেছেন ফরেন্সিক টিমের সদস্যরা।
যখন ফাল্গুনীকে নিয়ে আসা হয় তখন সেখানে ভিড় জমান এলাকার লোকজন। বাইরে মোতায়েন করা হয়েছিল মধ্যমগ্রাম থানার পুলিশ এবং র্যাফ। সেখানে সাক্ষী হিসেবে ঢাকা হয় প্রতিবেশী ঋতুপর্ণা ঘোষকে । তিনি জানিয়েছেন, ঘরের ভিতর থেকে তুলো নিয়ে কিছু নমুনা সংগ্রহ করেছেন তদন্তকারীরা। তবে ঘরের ভিতর থেকে কোনও অস্ত্র উদ্ধার করতে তিনি দেখেননি। ফাল্গুনীকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় বলে জানা গিয়েছে। যদিও তদন্তকারী আধিকারিকরা এবং ফাল্গুনী সংবাদমাধ্যমকে কিছু বলতে চাননি।

এই সঙ্গে যে ভ্যানে ট্রলিতে ভ্রে মৃতদেহ নিয়ে যাওয়া হয় তার চালককে আটক করেছে মধ্যমগ্রাম থানার পুলিশ। যে গাড়ি করে দেহ নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো সেই গাড়িচালককেও আটক করেছে পুলিশ। জানা গিয়েছে, গাড়িচালক মধ্যমগ্রামের বাসিন্দা হলেও গাড়িটি বাইরের।

কুমোরটুলিতে ট্রলি ব্যাগে রক্তাক্ত দেহ উদ্ধারের ঘটনায় গ্রেফতার করা হয়েছে দু’জনকে। আরতি ঘোষ ও ফাল্গুনী ঘোষ মধ্যমগ্রামের বীরেশপল্লি এলাকার বাসিন্দা। মঙ্গলবার সাতসকালে একাধিক সংবাদমাধ্যমে কুমোরটুলির ঘটনার কথা জানাজানি হতেই মুখ খোলেন প্রতিবেশিরা। অভিযোগ, মা ও মেয়ের উশৃঙ্খল জীবনে রীতিমতো অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন তাঁরা।

নিহত মহিলা ফাল্গুনীর পিসিশাশুড়ি। কলকাতা পুলিশের হোমিসাইড শাখার প্রাথমিক তদন্ত বলছে, মধ্যমগ্রামের বাড়িতেই তাঁকে খুন করেন ফাল্গুনী। সঙ্গ দেন তাঁর মা। তবে জানা গেছে, খুনের আগে তিনজনের মধ্যে বচসা হয়েছিল। রাগের জেরে পিসিশাশুড়ির মাথায় ইট মেরে ফাল্গুনী খুন করেন তাঁকে। কিন্তু কেন এমন পরিকল্পনা ফাল্গুনী ঘোষ এবং তাঁর মা আরতি ঘোষের? সম্পত্তির জন্যই কি খুন? যা নিয়ে ধন্দে পুলিশ। সময় যত গড়াচ্ছে পরিস্থিতি আরও জটিল হচ্ছে বলে খবর।
পুলিশ জানতে পেরেছে, অসমের যোরহাট এবং কলকাতায় কিছু সম্পত্তি রয়েছে নিঃসন্তান সুমিতার। সে কারনেই তাঁকে খুন করা হয়েছে কি না, ধৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ করে সে কথা জানার চেষ্টা করছে পুলিশ। বুধবার ঘটনার তদন্তে নতুন কোনও তথ্য উঠে আসে কি না, সেদিকে নজর থাকবে।
মঙ্গলবার সকালে কলকাতার কুমোরটুলি এলাকায় ট্রলি ব্যাগে করে দেহ ফেলতে গিয়ে পুলিশের জালে পাকড়াও মা আরতি ঘোষ ও মেয়ে ফাল্গুনী ঘোষ। তাঁরা দু’জনে গত আড়াই বছর ধরে মধ্যমগ্রামের বীরেশপল্লি এলাকায় একটি বাড়িভাড়া করে থাকতেন বলে খবর। তবে মঙ্গলবারের ঘটনার পর বীরেশপল্লির বাসিন্দারা মুখ খোলেন। তাঁরা জানান, মা ও মেয়ে বেলাগাম জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত ছিলেন। প্রায়ই রাতের দিকে অপরিচিত যুবকরা ওই বাড়িতে যাতায়াত করত বলে অভিযোগ।
প্রতিবেশীদের আরও অভিযোগ, গভীর রাত পর্যন্ত ওই বাড়িতে মধুচক্র চলত। তাঁরা পুরো বিষয়টি পুরসভাকে জানালেও লাভের লাভ কিছুই হয়নি। বাসিন্দাদের আরও অভিযোগ, মধ্যমগ্রাম পুরসভার উপপ্রধান প্রকাশ রাহা বিষয়টি জানতে পারলে পদক্ষেপ নিতে উদ্যোগী হন। তখন ফাল্গুনী ও আরতি প্রকাশ্যে প্রকাশকে গালিগালাজ করেন বলে খবর। ওই ভাড়াবাড়ির মালিক কলকাতায় বাস করেন। উপপুরপ্রধান বাড়ির মালিককেও বিষয়টি জানিয়েছিলেন।

প্রাথমিক তদন্তে পুলিশের অনুমান, কুমোরটুলিতে ট্রলি ব্যাগে উদ্ধার হওয়া দেহটি সুমিতার। মা-মেয়ে দু’জন মিলে তাঁকে খুন করেছেন। পুলিশ সূত্রে খবর, মঙ্গলবার সকালে ভারতী ও ফাল্গুনী একটি ট্রলি ব্যাগে সুমিতার দেহ প্লাস্টিকে মুড়ে বীরেশপল্লি থেকে একটি ভ্যানে চেপে তারা প্রথমে মধ্যমগ্রাম দোলতলায় যান। সেখান থেকে একটি গাড়ি করে কাজিপাড়া রেলস্টেশনে যান। কাজিপাড়া থেকে পার্ক সার্কাস পর্যন্ত ট্রেনের টিকিট কেটেছিলেন। প্রথমে প্রিন্সেপঘাটে তাঁরা দেহভর্তি ট্রলি গঙ্গায় ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু অনুকূল পরিবেশ না পাওয়ায় মা ও মেয়ে কুমোরটুলিতে চলে যান। সেখানেই গঙ্গার ঘাটে ট্রলি ব্যাগটি ফেলার সময় দু’জন স্থানীয় বাসিন্দাদের হাতে ধরা পড়ে যান।

স্থানীয়রা আরও দাবি করেছেন, পাড়া-পড়শিদের সঙ্গেও তাঁদের অনেকবার ঝামেলা হয়েছে। তাই বিগত কয়েক মাস ধরে ফাল্গুনীরা কার্যত একঘরে হয়েই থাকতেন।