Kolkata Book Fair 2024: ভিন্ন যৌনতা: মানবী-মধুজাদের লড়াইয়ে সমাজের ট্যাবু ভাঙার চেষ্টায় বইমেলায় বই

0
239
সৃজিতা শীল কলকাতা

মানবী বন্দ্যোপাধ্যায় পারলেও পারেননি মধুজা নন্দী!। শিক্ষিত হয়ে চাকরিবাকরি করার পরও আধুনিক সমাজ তাঁকে ‘হিজড়ে’ বানিয়ে দিয়েছে। এনিয়ে একরাশ ক্ষোভ রয়েছে মধুজার। বললেন, ‘হিজড়ে একটা পেশা। সব ট্রান্সজেন্ডার কিন্তু হিজড়ে নন। অথচ হিজড়ে না হওয়া সত্ত্বেও সব ট্রান্সজেন্ডারকেই হিজড়ের অপবাদ ও বিদ্রুপ মাথায় নিয়ে জীবনের পথ চলতে হয়।’

মধুজার জন্ম উত্তর ২৪ পরগনার বারাসতে এক অভিজাত, উচ্চ শিক্ষিত পরিবারে। বাবা চাকরি করতেন রাইটার্সে। মা স্কুল শিক্ষিকা। দুই দিদির পর বাবা-মায়ের পুত্রসন্তান ছিলেন তিনি। আকাঙ্খিত। পরপর তিনটি মেয়ে সন্তানের জন্ম দিলে মায়ের কপালে সুখ থাকত কি না কে জানে! এখানেই মধুজার সঙ্গে বড় মিল মানবীর।

আত্মজীবনীতে মানবী বলেছেন, ‘দুই দিদির বহু ব্যবধানে, বহু প্রতীক্ষায়, শান্তি-স্বস্ত্যয়নে, সাধনে, গাছে ঢিল বেঁধে, মানতে, দণ্ডি খেটে, ঈশ্বরকে উপঢৌকন দিয়ে, পুং লিঙ্গ নিয়ে শিব ঠাকুরের আশীর্বাদে আমার জন্ম। তারকেশ্বরে অন্নপ্রাশন। মস্তক মুণ্ডন।’ মানবীর প্রশ্ন, পুং লিঙ্গ নিয়ে না জন্মালে বাবার কি আরও একবার বিয়ে হতো? মা কি নির্বাসিত হতেন বাপেরবাড়িতে? দুই পায়ের ফাঁকে আমি পুং লিঙ্গ নিয়ে জন্মানোয় বাবার মুখে হাসি ফুটল। মায়ের চিন্তা দূর হল। মেল বেবির জন্ম দেওয়ায় মায়ের মাথায় উঠল সার্থক জননীর ক্রাউন। চারদিকে জ্বলে উঠল অনেকগুলো আলো। আমি জন্মানোর পর বড়দি আর আমার মাঝে যেন ছিটমহল হয়ে গেল দু’নম্বর দিদি।

মধুজার দিদিরাও তাঁর থেকে বয়সে অনেকটাই বড়। সকলের আদরে বড় হচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু ধীরে ধীরে বুঝতে পারছিলেন, সবাই তাঁকে যা ভাবছে তিনি কিন্তু আসলে তা নন। একটু আলাদা। তাঁর বয়সি ছেলেরা যখন বিকেল হলেই মাঠে ফুটবল বা ক্রিকেটে মত্ত হয়ে উঠত, তখন তাঁর ভালো লাগত রান্নাঘরে মায়ের পাশে বসে রান্নাবাটি খেলতে। কিন্তু আপন মনে পুতুল সাজাতে। স্কুল থেকে চিঠি এল, এ ছেলে কেমন যেন! চিন্তা বাড়ল বাবার। মা ভাবলেন, হয়তো দিদিদের দেখে এসব শিখেছে। বড় হলে ঠিক হয়ে যাবে।

কিন্তু দিনে দিনে পছন্দগুলো কেমন যেন প্রকট হতে লাগল। সেলুনে গিয়ে চুল কাটাতে একদম ভালো লাগত না। ‘মেয়ে’রা আবার চুল কাটে নাকি! যখন আরও একটু বড় হলেন মধুজা, তখন তাঁর সামনে নতুন সমস্যা। ধীরে ধীরে দেখা দিল বায়োলজিক্যাল সমস্যা। এই সমস্যা দেখা দিয়েছিল মানবীর জীবনেও। স্পষ্ট বুঝতে পারছিলেন, ‘সোমনাথ’ নামে একটি পুরুষের খোলসের ভিতর বাস করছে এক নারী।

মা ছিল মানবীর কাছে আশ্রয়স্থল। মধুজারও তাই মনে হতো। মায়ের বরাবর পছন্দের ছিল লালপেড়ে শাড়ি। তাঁর মা মারা গিয়েছেন ২০২০ সালে। মধুজা আজও মায়ের লালপেড়ে শাড়ি যত্ন করে রেখে দিয়েছেন আলমারিতে। মন খারাপ করলেই সেই শাড়ি বের করে গন্ধ শোঁকেন। বললেন, ‘ওই শাড়িতে মায়ের গায়ের গন্ধ লেগে আছে। আমি সব ধরনের পোশাক পরি। শাড়ি পরি, ঘাঘরা পরি, আবার জিন্সও পরি। কিন্তু পুজোয় সব কেনাকাটার শেষে একটা জিনিস কিনবই। সেটা হল একটা লালপেড়ে শাড়ি। মায়ের মতো। আমি যে তাঁরই মতো হতে চেয়েছিলাম!

যদিও জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আমার মেয়ে হয়ে যাওয়াটা মেনে নিতে পারেনি মা। নিজের ছেলে হিসেবেই দেখেছে আমাকে। ‘আার ছেলে’ বলেই পরিচয় দিয়েছে সবার কাছে। তবুও আমি মাকে ছাড়তে পারিনি। মায়ের গায়ের গন্ধ ভুলতে পারিনি।


কোনও মায়ের গায়ের গন্ধই বোধ হয় ভোলা যায় না। তাই হয়তো আত্মজীবনীতে মানবী লেখেন, ‘মায়ের কথা বলতে শুরু করলে কলম থামতে চায় না। মা খুব বুঝেছিলেন, তাঁর সন্তানদের লেখাপড়া শেখাতেই হবে। নিজে খুব বেশিদূর পড়তে পারেননি। তা নিয়ে আক্ষেপ ছিল। মাঝেমধ্যে হা-হুতাশ করতেন। বলতেন, আসছে জন্মে যেন লেখাপড়া শিখে উপার্জন করতে পারেন। বিবাহিত জীবন মেয়েদের চরম অভিশাপ, এমন খেদও ছিল মায়ের।’

কুড়িতে পা দেওয়ার পর মধুজার শরীরের আনচান আরও বেড়ে গেল। মা মানবেন না। বাবাকে তো বলার প্রশ্নই নেই। যা রাশভারী মানুষ। ফলে ভরসা করে বললেন ছোড়দিকে। ভেবেছিলেন, ও নিশ্চয়ই পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করবে। কিন্তু ফল হল উল্টো। ছোড়দি গোটা বাড়ি রাষ্ট্র করে দিল কথাটা। নেমে এল ফতোয়া। মানসিক নির্যাতন। ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন বাবা। শুরু হল থেরাপি। ইলেকট্রিক শক। বাড়ির সবাই বোঝালেন, এটা একটা রোগ। চিকিৎসার নামে চলল চড় থাপ্পড়।

নানারকম বুঝিয়ে চিকিৎসক বারবার মধুজাকে একটা জায়গায় এনে দাঁড় করানোর চেষ্টা করলেন। বোঝালেন, তুমি একটা ছেলে! কিন্তু হল না। ব্যর্থ হল ডাক্তারের সবরকম চেষ্টা। এবার বদলে গেল বাড়ির পরিবেশ। পারিবারিক অ্যালবাম থেকে সরে গেল মধুজার ছবি। ছুটির দিনে বাড়ির সবাই হই হই করে বেড়াতে গেল। শুধু ঘরে দরজা দিয়ে আটকে রেখে দেওয়া হল মধুজাকে। দুর্গাপুজোর দিনগুলোতেও….।

শুধু মানবী বা মধুজা নন, করণ জোহর থেকে স্বপ্নীল শিন্ডে। ঋতুপর্ণ ঘোষ থেকে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কন্যা সুচেতনা, দেশ-বিদেশের হাজারো সেলিব্রিটিদের সেক্স ওরিয়েন্টেশন নিয়ে সমাজের ট্যাবু ভেঙে এবারের বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে সাংবাদিক ব্রতীন দাসের লেখা গবেষণামূলক গ্রন্থ ‘অন্তরে বাইরে’। সমকাম, উভকাম ও রূপান্তরকামের নানা দিক নিয়ে বহু অজানা তথ্যের সন্ধান রয়েছে বইটিতে। প্রকাশক সেন ব্রাদার্স। পাওয়া যাচ্ছে কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলায় ১১০ নম্বর স্টলে। দাম ২৫০ টাকা। বইটির অসাধারণ প্রচ্ছদ করেছেন সাংবাদিক মৃণালকান্তি দাস।

Previous articleSchool: বনগাঁর ছয়ঘরিয়া রাখালদাস উচ্চবিদ্যালয়ের ৭৫ বছরের প্ল্যাটিনাম জয়ন্তী উৎসবের তিন দিন ব্যাপী সমাপনী অনুষ্ঠান – দেখুন ভিডিও
Next articleBank job: চাকরি প্রার্থীদের জন্য বড় সুখবর! জেলায় জেলায় বন্ধন ব্যাংকের নিয়োগ চলছে ,উচ্চ মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হলেই আবেদন করুন এখনই

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here