কিশোর বিপ্লবী ক্ষিতিপ্রসন্ন সেনগুপ্তের কথা জানেন ক জনই বা মানুষ?
অবশ্যই সংখ্যাটা খুব বেশি হবে না। রাইটার্স বিল্ডিং – এ অলিন্দ যুদ্ধের নায়ক দীনেশ গুপ্তের সাহচর্যে এসে নয় কি দশ বছর বয়সেই বালক ক্ষিতি বিপ্লবের অগ্নি মন্ত্রে দীক্ষিত হয়েছিলেন। দীনেশ ছিলেন সম্পর্কে ক্ষিতির আত্মীয়। দেশের স্বাধীনতার লক্ষ্যে বিপ্লবের অগ্নি শিখার স্পর্শ যে পেয়েছে জীবন মৃত্যু তার যে পায়ের ভৃত্য ! তাই বিস্ময়ের আর কি থাকে যখন ‘বেন্টু ‘- কে ( বিপ্লবী সংগঠন বেঙ্গল ভলান্টিয়ারসের গোপনীয়তার শর্ত অনুযায়ী এটাই দীনেশ ক্ষিতির ছদ্মনাম দিয়েছিলেন) মেদিনীপুরের দুই জেলা শাসক পেডি ও ডগলাসকে হত্যার সন্দেহে ইংরেজের পুলিশ ষোলো বছর বয়স থেকে টানা চোদ্দ বছর দফায় দফায় কারা রুদ্ধ ও অন্তরীন করে রেখেছিল। পুলিশ হেফাজতে ষোলো বছরের এই কিশোরের উপর চলেছিল চরম নির্যাতন। বিপ্লবীদের হাল হকিকত জানতে জেরা করার সময় পুলিস তার উপর নির্বিচারে প্রয়োগ করেছিল ‘থার্ড ডিগ্রী ‘। ইতিহাসের পরিহাস যে সেই কিশোর বীরকে স্বাধীন ভারত মনে রাখে নি। এটাই চরম বিস্ময়কর। আসলে বিপ্লবের ঋণ শোধ করার দায় ক জনেরই বা আছে।
হালে অবশ্য ক্ষিতি দুহিতা মধুমন্তি সেনগুপ্ত স্বাধীনতা যুদ্ধের এই অকথিত নায়কের আখ্যান গ্রন্থিত করেছেন ” বেঙ্গল ভলান্টিয়ারস – অগ্নি যুগের সশস্ত্র বিপ্লবীদল” বইতে। তার কথায়, ” আমার কলম ধরার উদ্দেশ্য শুধু আমার প্রয়াত বাবা নন। কারণ, আমার বাবা নিজের মুখে কখনো নিজের জীবনের বিপ্লবী অধ্যায়ের কথা কাউকে বলতেন না। আমার মাকেও না। তাকে খুব ছোট থেকে দেখেছি অধ্যাপনা, নিজের পড়াশোনা নিয়ে থাকতে। চলতি রাজনীতির সঙ্গে তার কোনো সংশ্রব ছিল না। বাবার বিপ্লবী গাথার কথা আমি জেনেছিলাম সে সময়কার তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও বন্ধুদের কাছে থেকে।” তার সংযোজন, ,,” মা অবশ্য তার জীবনের অন্তিম অধ্যায়ে খুবই আক্ষেপ করতেন, শুধু তোর তো বাবা নন, বেঙ্গল ভলান্টিয়ারসে তার সাথীরা, তারাও কত দেশের জন্যে কষ্ট করেছিলেন। কেউ তাদের কথা তেমন জানেও না, বলেও না। আমি আমার মতো করে স্বেচ্ছায় অন্তরালে চলে যাওয়া সেই মানুষগুলোকে ইতিহাসের আলোয় সামনে আনার চেষ্টা করেছি।”
সেই চর্চাতেই কত অজানা তথ্য সামনে এসেছে। যেমন, অপ্রাপ্ত বয়স্ক হলেও কিশোর বীর দের ইংরাজের পুলিশ কোনো রেয়াত করে নি, স্বীকারোক্তি আদায় করতে থার্ড ডিগ্রির প্রয়োগে তিল মাত্র খামতি থাকত না। যেমন, ১৯৩২ সালে মেদিনীপুরে দুই বিপ্লবী প্রভাংশু ও প্রদ্যুতের পুলিসের নাকের ডগায় ডগলাসের হত্যার পর ভূপেন দারোগার মাথার চুল ছেড়ার জোগাড়! কারণ, এতো পুলিশি প্রহরা ও সতর্কতা সত্বেও দুই কিশোর অবলীলায় রিভলভার থেকে গুলি চালিয়ে শ্বেতাঙ্গ জেলা শাসকের ভব লীলা সাঙ্গ করলো। এর আগের বছরই পেডি হত্যার সময়ই মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুলের মেধাবী ছাত্র ক্ষিতির নাম ছিল সন্দেহভাজনদের শীর্ষে। সেই সূত্র ধরেই ভূপেন দারোগা তাকে শুধোল , “বল, প্রদ্যুতকে সাইকেলে নিয়ে কোথায় গিয়েছিলি।” এটাই ঘটনা যে প্রদুত্যকে সাইকেল চড়িয়ে ক্ষীতিই তাকে জেলা বোর্ডের অফিসে পৌঁছে দিয়েছিল। সেখানেই ডগলাসকে সাবাড় করে বিপ্লবীরা।
ক্ষিতি কিছু না বলায় শুরু হল সীমাহীন অত্যাচার প্রতি আঙ্গুলের নখের মধ্যে বড় বড় ছুচ ঢুকিয়ে দিল পুলিশ। মাথায় আগুন চড়ে গিয়েছে ভূপেন দারোগার। তার থার্ড ডিগ্রির চাপে কত বাঘা লোক মুখ খুলেছে, এ তো দুধের শিশু। এর পর দারোগার নির্দেশে শুরু হল বাঁশ ডলা। কিশোর বিপ্লবী কে উলঙ্গ করে উল্টো করে শুইয়ে দুটি বাঁশ দিয়ে দু ধার থেকে সর্ব শক্তি দিয়ে চার জন প্রাণ পনে ঠেলতে লাগলো। তার নাক মুখ দিয়ে বেরোতে থাকল অনর্গল রক্ত। খাবার জল চাইতে খেতে দেওয়া হল প্রস্রাব। তৃষ্ণায় কাতর কিশোর মাথা থেকে ঝরে পড়া রক্ত জিভ দিয়ে চাটতে লাগল। পরের দিন থেকে নয়া অত্যাচার। কোতোয়ালির মধ্যেই একটি অন্ধকার ঘরে একটি চেয়ারে বসিয়ে আপাদ মস্তক দড়ি দিয়ে বেঁধে শুরু হল মাথার তালুর ঊপর ত্রিশ সেকেন্ড অন্তর অন্তর ফোঁটা ফোঁটা বরফ জল ফেলা শুরু হল। কিন্তু ভবি ভোলবার নয়। বিপ্লবী মুখ খোলে না। বিপ্লবের মন্ত্রগুপ্তির শপথ যে বজ্র কঠিন।
‘ দ্য বেঙ্গল ক্রিমিনাল ল অ্যামেন্ডমেন্ড অ্যাক্ট, ১৯৩০” এর প্রয়োগে কোনো প্রমাণ না থাকা সত্ত্বেও ছাড়া পেল না এই কিশোর। লৌহ কপাটের অন্তরাল থেকেই ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে অঙ্কে লেটার নিয়ে পাস করলো সে। এরপর দীর্ঘ ডেটিনিউ জীবন। সেই পরিবেশেই আই ভালো ভাবে পাস করে স্নাতক ও স্নাতোকত্তর। শুধু একটি বিষয়ে এম নয়, অর্থ নীতি ও ইংরেজিতে ডাবল এম এ। ১৯৪৭ এ স্বাধীনতার নতুন সূর্যের আলোয় অন্তরাল থেকে মুক্ত হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফেরা। মধুমন্তির কথায়, “, বাবা সেন্ট জেভিয়ার্স সহ দুটি কলেজে পড়িয়ে সংসার নির্বাহ করতেন। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের জন্য ধার্য পেনশন কখনো নেন নি। কেউ কিছু বললে গোনা গুনতি কটি শব্দে উত্তর দিতেন, ” আমি কিছু পাওয়ার কথা ভেবে তো কিছু করি নি।”
তার সাফ কথা, ” আমার উনিশ বছর বয়েসে বাবা মারা যান। সত্যি বলতে কি আমি তো পেশায় ইতিহাসবিদ নই। দেশ বিদেশে সারা জীবন কর্পোরেট সেক্টরে বিভিন্ন সংস্থায় কাজ করেছি। কিন্তু আমার বাবার মত যে মানুষগুলি কিছু না পাওয়ার আশা করেই দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়ে ছিলেন, তাদের হারিয়ে যাওয়া অগ্নি জীবনের সামান্য কিছু স্মৃতি এই চরম ভোগ বাদের যুগে সামনে আনতে পারাটাই আমার প্রাপ্তি।”