
দেশের সময়: আলোর উৎসব ঘিরে সেজে উঠেছে তিলোত্তমা কলকাতা। বাহারি আলোয় উদ্ভাসিত মহানগরের রাজপথ। দুর্গাপুজোর মতো কালীপুজোতেও একে অপরকে টেক্কা দিতে ব্যস্ত উদ্যোক্তারা। উত্তরবঙ্গ সফর সেরে বৃহস্পতিবার কলকাতায় পা রেখেই কালীপুজোর উদ্বোধন শুরু করে দেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ওইদিন বেশ কয়েকটি পুজোর উদ্বোধন করেন তিনি। এবার দুর্গাপুজোয় জেলায় জেলায় ভার্চুয়ালি দুর্গাপুজোর উদ্বোধন করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। তিন দফায় এক হাজারেরও বেশি দুর্গাপুজোর উদ্বোধন করেন তিনি। বৃহস্পতিবার মুখ্যমন্ত্রী কালীপুজোর উদ্বোধন করতেই কলকাতায় শুরু হয়ে যায় আলোর উৎসব।

ওইদিন প্রথমেই তিনি যান জানবাজার সম্মিলনীর মণ্ডপে। এরপর যান শেক্সপিয়র সরণীর ইয়ুথ ফ্রেন্ডস, দেবেন্দ্র ঘোষ রোডের ইন্ডিয়া ক্লাব ও হরিশ মুখার্জি রোডের ভেনাস ক্লাবে। এই চারটি ক্লাবের পুজো মণ্ডপের উদ্বোধন করেন তিনি। বার্তা দেন, কালীপুজোয় যেন কেউ সম্প্রীতির বার্তা নষ্ট না করেন। তাহলে তাকে রেয়াত করা হবে না। আগেই সৌরভ গাঙ্গুলীর হয়ে ব্যাট ধরেছেন বাংলার মুখ্যমমন্ত্রী।

বৃহস্পতিবার মা কালীর কাছে প্রার্থনা করেন তিনি। বলেন, মাগো শক্তি দাও। সৌরভের দীর্ঘজীবন কামনা করি। ওঁর পরিবারের সুন্দর জীবন কামনা করি। আমরা লজ্জিত। নাম না করে বিজেপিকে নিশানা করে মমতা বলেন, আজ তোমাদের হাতে ক্ষমতা। তাই সৌরভকে হতে দিলে না। কে বলতে পারে, ভবিষ্যতে সৌরভই যাবে। সেদিন তোমাদের হাতে আর ক্ষমতা থাকবে না। মায়ের কাছে এই প্রার্থনা করি।

এদিকে, কালীপুজো যাতে নির্বিঘ্নে পার করা যায়, সেজন্য প্রতিটি থানাকে নিয়ে বৈঠক সেরেছেন পুলিশ কর্তারা। কলকাতার নিরাপত্তায় বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে। বাংলার দুর্গাপুজো যেমন এবার ইউনেস্কোর হেরিটেজ স্বীকৃতি পেয়েছে, কলকাতার কালীপুজো ঘিরেও কিন্তু উৎসাহ কম নেই। কালী কলকাত্তাওয়ালির খ্যাতি দেশজুড়ে।

আর জনপ্রিয়তার নিরিখে দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণী শীর্ষে, একথা নতুন করে বলার কিছু নেই। মন্দির কমিটি সূত্রে খবর, দক্ষিণেশ্বরের মাকে বেনারসি শাড়ি উপহার পাঠান দেশ-বিদেশ থেকে হাজার হাজার ভক্ত। কবে তাঁর পাঠানো বেনারসি মাকে পরানো হচ্ছে, তা জানার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকেন ভক্তরা। এখন অবস্থা এমন হয়েছে যে, বেনারসির পাহাড় জমেছে। ফলে এই মুহূর্তে যদি কোনও ভক্ত মাকে বেনারসি উপহার পাঠান, তাঁর পাঠানো শাড়ি মাকে পরাতে সময় লেগে যাবে ১২ বছর। কার্তিক মাসের অমাবস্যা তিথিতে দীপান্বিতা কালীপুজোর দিন দক্ষিণেশ্বরে ভবতারিণীর পুজোয় ভিড় দেখার মতো।

হিন্দু শাস্ত্র মতে, দেবদেবীদের মধ্যে কালী মা সবথেকে বেশি জাগ্রত। ফলে ভক্তদের নিষ্ঠার কোনও অভাব নেই এই পুজো ঘিরে। একান্নপীঠের এক পীঠ দেবতীর্থ কালীঘাটের কালী খুবই জনপ্রিয়। মন্দির সংলগ্ন একটি কুণ্ডে সতীর ডান পায়ের বুড়ো আঙুল পাওয়া গিয়েছিল। লোকচক্ষুর আড়ালে যা এখনও মন্দিরের সিন্দুকে রক্ষিত আছে বলা হয়। কালীপুজোয় কালীঘাটে ভিড় সামাল দেওয়া যায় না। টালিগঞ্জ করুণাময়ী কালী মন্দিরের ইতিহাস বলছে, বড়িশার নন্দদুলাল রায়চৌধুরীর কন্যা করুণাময়ীর মৃত্যুর পর বাবাকে স্বপ্নাদেশ দেন তিনি।

একটি কষ্টিপাথর দেখিয়ে বলেন, এই রূপে থেকে যাবেন তিনি। এর পর তাঁর বাবা কষ্টিপাথর থেকে কালীমূর্তি গড়ে মা করুণাময়ী নামে পুজো শুরু করেন। কলকাতার এই কালীপুজো দেখতে দূরদূরান্ত থেকে ভক্তরা আসেন। উত্তর কলকাতায় ঠনঠনিয়া কালীবাড়ির পুজো অত্যন্ত জনপ্রিয়। ডাকাতদের আক্রমণ থেকে সতর্ক করার জন্য এই মন্দিরের ঘণ্টা বাজানো হত বলে জনশ্রুতি। প্রতি বছর এখানকার কালী মূর্তিকে নতুন করে সাজানো হয়। যা দেখতে ভিড় জমান ভক্তরা।

ফিরিঙ্গি কালীবাড়ির পুজোকে বাদ দিয়ে কলকাতার কালীপুজো নিয়ে আলোচনা করা যায় না। সময়টা উনিশ শতক। পর্তুগিজ বংশোদ্ভূত অ্যান্টনি হেন্সম্যান নামে এক কবিয়াল এই দেবস্থানে এসে উপলব্ধি করেছিলেন, খ্রিষ্ট আর কৃষ্ণ একই। তাঁর অনুপ্রেরণায় এই মন্দিরে পুজিত হন সিদ্ধেশ্বরী কালী মা। যাঁকে ভক্তরা ফিরিঙ্গি কালী পুজো বলে থাকেন। এতো গেল, ইতিহাসের সঙ্গে মিশে থাকা কালীপুজোর কথা। পিছিয়ে নেই বারোয়ারি পুজো কমিটিগুলিও। প্রতি বছরই বাড়ছে থিমের জৌলুস। বৈভব।

এদিকে, শহরবাসীর জন্য সুখবর দিয়ে কলকাতা মেট্রো রেল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, দীপাবলি উপলক্ষে ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো রুটে আরও বেশি সংখ্যক ট্রেন চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা। কালীপুজোর দিন অর্থাৎ ২৪ অক্টোবর ইস্ট-ওয়েস্ট রুটে মোট ৭২টি মেট্রো চালানো হবে।

দীপাবলির দিন অর্থাৎ ২৫ অক্টোবর ওই রুটে আপ ও ডাউন মিলিয়ে চলবে মোট ৯০টি মেট্রো। অর্থাৎ শিয়ালদহ থেকে যাঁরা সল্টলেক সেক্টর ফাইভে যেতে চান, তাঁদের সমস্যায় পড়তে হবে না। কালীপুজো ও দীপাবলি এই দুই দিন ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো রুটে ২০ মিনিট অন্তর ট্রেন পাওয়া যাবে। কালীপুজোর দিন শিয়ালদহ থেকে দিনের প্রথম মেট্রো ছাড়বে সকাল ৭টা ৫৫মিনিটে।

এবার সেক্টর ফাইভ থেকে দিনের শেষ মেট্রো ছাড়বে সন্ধ্যা ৭টা ৪০ মিনিটে। দীপাবলির দিন শিয়ালদহ স্টেশন থেকে সকাল ৬টা ৫৫মিনিটে প্রথম মেট্রো ছাড়বে। সেক্টর ফাইভ থেকে প্রথম মেট্রো ছাড়বে সকাল সাতটায়। শিয়ালদহ থেকে শেষ মেট্রো ছাড়বে রাত ন’টায়। সেক্টর ফাইভ থেকে শেষ মেট্রো ছাড়বে রাত ৯টা ৪০ মিনিটে।

দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে থেকেই কলকাতায় শুরু শ্যামামায়ের আরাধনা। বিশেষ করে কালীপুজো যেন অত্যাচারি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে মনে শক্তি জুগিয়েছে বিপ্লবীদের। পরে রাজনৈতিক নেতারাও জড়িয়ে পড়েছেন কালীপুজোর সঙ্গে। কলকাতার কালীপুজো নিয়ে কথা বলতে গেলে প্রথমেই আসে ফাটাকেষ্টর পুজোর কথা। এখন ফাটাকেষ্টর জমানা নেই ঠিকই, কিন্তু পুজোয় ছন্দপতন হয়নি। রীতি মেনে প্রতি বছর স্বমহিমায় হয়ে চলেছে এই পুজো।

এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। কৃষ্ণা দ্বিতীয়া তিথির সন্ধ্যায় এই পুজোর মাতৃমূর্তির চক্ষুদান করেছেন কুমোরটুলির প্রখ্যাত শিল্পী মাধব পাল। কলকাতার সীতারাম ঘোষ স্ট্রিটের নব যুবক সংঘ আয়োজিত ফাটাকেষ্টর পুজো এবার ৬০ বছরে পা দিল। মহালয়ার দিন খুঁটিপুজো হয়েছিল। শিল্পী মাধব পালের বাবা কালীপদ পাল ফাটাকেষ্টর পুজোর প্রতিমা তৈরি করতেন। রথের দিন থেকে শুরু হয়েছে প্রতিমা তৈরির কাজ। রীতি মেনে ঠনঠনিয়া কালীবাড়িতে পুজো দিয়ে তবেই হয়েছে মায়ের চক্ষুদান। ১৪ ফুট লম্বা, এক টন ওজনের শ্যামবর্ণা দক্ষিণাকালী মূর্তি মণ্ডপে নিয়ে যাওয়ার পর অঙ্গরাগ হবে।