জামিন পেতেই হাবড়ার উন্নয়ন নিয়ে খোঁজখবর নেওয়া শুরু করেছেন বিধায়ক জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। তাঁর ঘনিষ্ঠ মহল সূত্রে খবর, বর্তমানে হাবড়ায় কী কী উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চলছে, কোন কাজের অগ্রগতি কতটা তা নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে খোঁজখবর নিয়েছেন তিনি। দলনেত্রীর নির্দেশ পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়বেন ময়দানে। তার আগে সেরে রাখতে চাইছেন হোমওয়ার্ক।
তবে দীর্ঘদিন জেলে থাকায় শারীরিক ও মানসিকভাবে তিনি যথেষ্টই অসুস্থ। জামিন পেলেও এখনও সেই ধকল কাটিয়ে উঠতে পারেননি। কলকাতার বাইরে তাঁকে না যাওয়ার শর্ত বেঁধে দিয়েছে আদালত। কিন্তু চিকিৎসার কারণে হায়দরাবাদে যাওয়ার জন্য আদালতের কাছে আবেদন জানাতে পারেন জ্যোতিপ্রিয়র আইনজীবী। আপাতত লক্ষ্য দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠা। তারপর আইনি দিক খতিয়ে দেখেই তিনি ঝাঁপাতে চাইছেন রাজনীতির ময়দানে।
তাঁর সঙ্গে হাবড়ার যেসব তৃণমূল নেতা দেখা করতে গিয়েছিলেন বাড়িতে, তাঁদের মানুষের পাশে থাকার বার্তা দিয়েছেন জ্যোতিপ্রিয়। আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে বিধানসভার বাজেট অধিবেশন রয়েছে। সেসময় তাঁকে বিধানসভায় দেখা যেতে পারে বলে মনে করছে তৃণমূলের একাংশ। তবে সবটাই নির্ভর করছে তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সিদ্ধান্তের উপর।
এদিকে, জ্যোতিপ্রিয় জেলের বাইরে বেরতেই উজ্জীবিত তাঁর অনুগামীরা। বালুদা’র জামিনে উত্তর ২৪ পরগনায় রাজ্যের শাসকদলের রাজনীতিতে কী প্রভাব পড়তে পারে, তা নিয়ে চর্চা তুঙ্গে। সোশ্যাল মিডিয়াতেও অনেকে জ্যোতিপ্রিয়র ‘কাছের মানুষ’ প্রমাণ করতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন।
কেউ লিখছেন, ‘বস ইজ ব্যাক’। কেউ আবার সামাজিক মাধ্যমে লিখছেন, ‘দাদা আছেন। দাদাই থাকবেন।’ জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক জামিন পেতেই তাঁর সল্টলেকের বাড়িতে গিয়ে দেখা করে এসেছেন তৃণমূলের উত্তর ২৪ পরগনার অনেক নেতা-নেত্রী। রেশন ডিলার সংগঠনের কয়েকজন নেতাও দেখা করে এসেছেন। যদিও এখনও রাজ্যের প্রাক্তন খাদ্যমন্ত্রীর সঙ্গে খানিকটা দূরত্ব বজায় রেখে চলতে চাইছেন জেলার তৃণমূল নেতাদের একাংশ।
একসময় উত্তর ২৪ পরগনায় তৃণমূলের মুখ্য সংগঠক ছিলেন জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। গোটা জেলা ছিল তাঁর হাতের তালুর মতো চেনা। সিপিএমকে জেলায় ধরাশায়ী করে দেওয়ার পিছনেও তাঁর অবদান অনেকটাই। এহেন জ্যোতিপ্রিয়র চালে আবার কবে মাত হবে রাজনীতির ময়দান, তা নিয়েই জল্পনা তুঙ্গে। একটাই অপেক্ষা, ঠিক কবে থেকে জেলায় রাজনীতির চেনা মাটিতে পা রাখবেন বালুদা।
রাজনৈতিক মহলের মতে, রেশন দুর্নীতি মামলায় জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক গ্রেফতার হওয়ার পর তৃণমূলের যেসব নেতা ‘অতিসক্রিয়’ হয়েছিলেন, তাঁরা অবশ্য এখন মেপে পা ফেলতে চাইছেন। দলের অন্দরে কিংবা বাইরে জ্যোতিপ্রিয়র জামিন পাওয়া নিয়ে প্রতিক্রিয়া দিতে গিয়েও অত্যন্ত সংযত মনোভাব দেখাচ্ছেন তৃণমূলের ওই অংশ।
জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক গ্রেফতার হওয়ার পরও তৃণমূল পরিচালিত হাবড়া পুরসভার তরফে তাঁর জন্মদিন পালন করা হয়েছিল। এমনকী জগদ্ধাত্রী পুজোয় যে পুর ক্রীড়া প্রতিযোগিতা হয়, সেখানেও ‘উপদেষ্টা’ করা হয় তাঁকে। মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের শুভেচ্ছা ব্যানারে নাম ছিল জ্যোতিপ্রিয়র। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে বনমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দিতেই ধীরে ধীরে জ্যোতিপ্রিয়র হয়ে প্রচার বন্ধ হয়ে যায় হাবড়ায়।
লোকসভা ভোটেও দলের প্রচারে অতি সন্তর্পণে তাঁর নাম তোলা হয়নি। এই পরিস্থিতিতে হাবড়া, অশোকনগর, বনগাঁ, বাগদা, গাইঘাটা, স্বরূপনগর ও টাকিতে কার্যত কোণঠাসা হয়ে পড়েন বালুর অনুগামীরা। অনেকে দলে থাকলেও গুরুত্ব হারান। কেউ কেউ আবার দলের পিছনের সারিতে চলে যান।
একসময় যাঁরা জ্যোতিপ্রিয়কে ঘিরে থাকতেন, তাঁদের কেউ কেউ বারাসতের তৃণমূল সাংসদ কাকলি ঘোষদস্তিদারের ‘ঘনিষ্ঠ’ বৃত্তে ঢুকে পড়ার চেষ্টা করেন বলে তৃণমূল সূত্রে খবর। এরইমধ্যে জেলা পরিষদের সভাধিপতি তথা অশোকনগরের বিধায়ক নারায়ণ গোস্বামীর ‘লবি’তে নাম লেখানোর চেষ্টা শুরু করে দেন। দেখা যায়, জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের জেল-যাত্রার পর কাকলি, নারায়ণদের পাশাপাশি উত্তর ২৪ পরগনায় তৃণমূলের আরও কিছু নেতার ‘উত্থান’ হয়েছে দলে। দলে তাঁরা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘লোক’ বলে প্রচারও করেন নিজেদের।
কিন্তু জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের জামিনে ছবিটা বদলে গিয়েছে। তৃণমূলের জেলার যাঁরা অন্য শিবিরে ভিড়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, তাঁরা অনেকে রাতারাতি জ্যোতিপ্রিয়র ‘কাছের লোক’ প্রমাণে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। অনেকে আবার বলছেন, বালুদা জামিন পেয়েছেন ঠিকই, কিন্তু তাঁর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কী হবে, তা ঠিক করবেন দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই। তিনি যতক্ষণ না কিছু নির্দেশ দিচ্ছেন, ততক্ষণ বালুদাকে ঘিরে বাড়তি উচ্ছ্বাস দেখিয়ে কোনও লাভ নেই।
তবে জ্যোতিপ্রিয়র অনুগামীদের দাবি, দাদা না থাকায় যে ভোটের ফলে কিছুটা হলেও প্রভাব পড়েছে, তা অস্বীকার করা যাবে না। বারাসতে দলের প্রার্থী কাকলি ঘোষদস্তিদার জিতলেও হাবড়ায় পিছিয়ে পড়েন তিনি। আর এখনও হাবড়ার বিধায়ক জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। বালুদা’র অনুগামীদের বক্তব্য, জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক ময়দানে না থাকায় লোকসভায় হাবড়ায় বাড়তি সুবিধা পেয়ে যায় বিজেপি। কিন্তু আর সেই সুযোগ পাবে না তারা। জ্যোতিপ্রিয়র অনুগামীদের আশা, দলনেত্রীর নির্দেশে শীঘ্রই হাবড়ার উন্নয়নের ব্যাটন নিজের হাতে তুলে নেবেন বালুদা। জেলায় দলেরও রাশ ধরবেন তিনি। আর তিনি নামামাত্রই তাঁর অনুগামীরাও ঝাঁপিয়ে পড়বেন দলের হয়ে। জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের জামিনের পরই হাবড়ার পুরপ্রধান নারায়ণ সাহা জানিয়ে দিয়েছেন, বালুদা’র হাত ধরেই আবার হাবড়ার উন্নয়ন হবে বলে মনে করেন তিনি।
বারাকপুরের সাংসদ পার্থ ভৌমিকও বলেছেন, কেন্দ্রীয় সরকার ইডি-সিবিআইকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করছে। জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক জামিন পাওয়ায় তা আরও একবার প্রমাণ হল। ১৪ মাসেও ইডি তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের পক্ষে কোনও তথ্য-প্রমাণ দিতে পারেনি। তথ্য-প্রমাণ না থাকলে কোথা থেকে দেবে।