দেশের সময় ওয়েবডেস্কঃ যারা দুর্নীতি করে চাকরিতে ঢুকেছে তাদের প্রত্যেকের চাকরি যাবে। এক সংবাদমাধ্যমকে সাক্ষাৎকার দিতে এসে এমনই হুঁশিয়ারি দিলেন কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। রীতিমতো সুর চড়িয়ে তিনি বলেন, “যারা দুর্নীতি করে চাকরিতে ঢুকেছে তারা যেন নিশ্চিন্তে না থাকে। দুর্নীতি করে যারা ঢুকেছে, যারা অসৎ উপায়ে চাকরি পেয়েছে, তাদের ধরতে পারলেই প্রত্যেকের চাকরি যাবে।” একইসঙ্গে আক্ষেপের সুরে তিনি বলেন, “যারা দুর্নীতি করে ঢুকেছে তারা বাচ্চাদের কী মূল্যবোধ শেখাবে! টুকতে শেখাবে!”
বর্তমানে দুর্নীতির গেরোয় চাকরি না পাওয়ায় বেকার যুবক-যুবতীদের কাছে ‘মসিহা’ হয়ে উঠেছেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁর নির্দেশেই পুজোর মুখে কয়েক দফায় বহু চাকরিপ্রার্থী চাকরি পেয়েছেন। এপ্রসঙ্গে তিনি বলেন, “বেকারদের চোখের জল আমি দেখতে পাই। আমিও বেকার ছিলাম। তাই বেকার যুবক-যুবতিদের চোখের জল, রাতের পর রাত বেকার যুবক-যুবতিদের চোখের জলে বালিশ ভিজে যাওয়া আমি দেখতে পাই।” এপ্রসঙ্গেই বিচারপতি বলেন, “অন্তত এক-দুটো রায় এমন দিয়ে যেতে চাই, যাতে যখন আমি থাকব না তখন বিচারকদের আলোচনায় সেগুলি উঠে আসবে।”
দুর্নীতি রুখতে বিচারব্যবস্থার কড়া হওয়া জরুরি বলে মনে করেন কলকাতা হাইকোর্টের (Kolkata High Court) বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, “ভয় মাঝেমধ্যে ভালো ফল দেয়। শিক্ষা দফতরের আধিকারিক, শিক্ষকদের উপর ভয় সৃষ্টি করেছি। তবে এতে কাজ হয়েছে।” নাগরিকদের উপর বিচারব্যবস্থার সঠিক প্রয়োগ হয়নি বলেই দেশবাসী এত বিশৃঙ্খল বলেও মনে করেন তিনি।
শুধু দুর্নীতিগ্রস্ত নয়, বিচার ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যাঁরা আঙুল তোলেন, প্রয়োজনে তাঁদের বিরুদ্ধেও তিনি কঠোরতম হবেন বলে এদিন কড়া বার্তা দেন বিচারপতি অশোক গঙ্গোপাধ্যায়। এপ্রসঙ্গে সরাসরি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কেও একহাত নেন তিনি। সরাসরি নাম করে বিচারপতি বলেন, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় যখন প্রথম ‘সমালোচনা করেছিলাম, তখন আমি লাদাখে ছিলাম। ভেবেছিলাম একটা রুল ইস্যু করে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে ডাকব।” বিচারব্যবস্থার উপর কেউ অঙ্গুলী হেলন করলে, তাঁর বিরুদ্ধে সমালোচনা করলে ‘কঠোরতম’ হবেন বলেও এদিন হঁশিয়ারি দেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়।
এদিন সরকারি অফিস থেকে যে কোনও ঊর্ধ্বতন আধিকারিকদেরও সংযত আচরণ করার বার্তা দেন হাইকোর্টের বিচারপতি। অধস্তন কর্মীদের সঙ্গে অভদ্র ব্যবহার করলে তার পরিণতি মারাত্মক হতে পারে বলে সাবধান করেন বিচারপতি। ঊর্ধ্বতন আধিকারিকদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, “কর্মীদের সঙ্গে অভদ্র ব্যবহার করলে চাকরিও চলে যেতে পারে। খুব সাবধান। রেগে গিয়ে কখনও কিছু বলে ফেললেও পরে ক্ষমা চেয়ে নেবেন।”
উল্লেখ্য,সোমবার একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন, আগেও উনি একবার বিচারব্যবস্থা নিয়ে মন্তব্য করেছিলেন। তখন আমি কলকাতায় ছিলাম না। তখন ছিলাম লাদাখে। ওখানে বসেই ভেবেছিলাম ওঁর বিরুদ্ধে রুল ইস্যু করব। ওঁকে ডেকে পাঠাব। তার পর যা ব্যবস্থা নেওয়ার নেব। কিন্তু কলকাতায় ফিরে দেখি ডিভিশন বেঞ্চে এ ব্যাপারে একটা মামলা হয়েছে।
ডিভিশন বেঞ্চ বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়নি। কারণ, তাঁরা মনে করেছেন এতে তাঁকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়ে যাবে। কিন্তু আমার মত ভিন্ন।
এখানেই থামেননি বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি বলেন, উনি (পড়ুন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়) ক’দিন আগে বিচারব্যবস্থা নিয়ে কিছু বলেছেন। সেই ক্লিপিংস আমি পেয়েছি। উনি আর একবার এ ধরনের কথা বলে দেখুন। উনি জানেন না যে আদালত কী করতে পারে! এই যে অভিযোগ আনছেন উনি, তা কি প্রমাণ করতে পারবেন?
সাক্ষাৎকারে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় এও বলেন, তিনি এ সব ব্যাপারে ভয় পান না। তাঁর কথায়, আমি সঠিক কথা বলতে ভয় পাই না। পরে কী হবে জানি না। আমাকে মেরেও দিতে পারে। কিন্তু আমি যেটা সঠিক সেটা বলে যাব।
বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় আরও বলেন, এরা কল্পনাই করতে পারে না ব্যবস্থা কতটা কঠোর হতে পারে। সেইসঙ্গে তিনি এও বলেন, বিচার ব্যবস্থার দিকে যে আঙুল তুলবে তার বিরুদ্ধে কঠোরতম পদক্ষেপের পক্ষে তিনি। তাঁর মতে, নইলে মানুষের মনে বিচার ব্যবস্থার প্রতি আস্থাটাই চলে যাবে। বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের কথায়, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন একদল জজের মাথায় বিজেপির হাত আছে। আমি যদি ডেকে বলি, প্রমাণ করুন। পারবেন? নইলে মিথ্যে বলার জন্য যান তিন মাস জেলে থাকুন। পরে হয়তো আমায় মেরে দেবেন। কিন্তু তাতে আমার কিছু যায় আসে না।
প্রসঙ্গত, বিজেপির নবান্ন অভিযানের পর দিন এসএসকেএমের উঠোনে দাঁড়িয়ে সরসারি বিচারব্যবস্থার একাংশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। বিচারব্যবস্থায় এখনও অনেক লোক আছেন যাঁদের মেরুদণ্ড সোজা। কিন্তু একাংশের প্রত্যক্ষ মদতে বিজেপির গুণ্ডারা শেল্টার পাচ্ছে। এই ঘটনা ভারতে নজিরবিহীন। অতীতে কখনও হয়নি।
মঙ্গলবার আন্দোলনকারীদের একাংশের মারে জখম হয়েছিলেন কলকাতা পুলিশের এসিপি দেবজিৎ চট্টোপাধ্যায়। তাঁর ডান হাত ফ্র্যাকচার হয়েছিল। হাসপাতালে তাঁকে দেখতে গিয়েছিলেন অভিষেক। তিনি এও বলেছিলেন, আমি কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। হাইকোর্ট থাকতে, বিচারপতি থাকতে, বিচার ব্যবস্থা থাকতে এই ঘটনা ঘটে কী করে?
বিচার ব্যবস্থার একাংশের ভূমিকা নিয়ে এর আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও সরব হয়েছেন। সম্প্রতি নব মহাকরণের দুটি ব্লক হাইকোর্টকে হস্তান্তর করেছে নবান্ন। সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী এবং হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি প্রকাশ শ্রীবাস্তব। ওই মঞ্চে দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রী যেমন মিডিয়া ট্রায়াল নিয়ে সরব হয়েছিলেন তেমনই বিচারব্যবস্থার একাংশের ভূমিকা নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন। ঘটনা হল, ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ও।