দেবদ্যুতি হালদার, চন্দননগর:হৈমন্তীকার আরাধনায় মেতে উঠেছেন চন্দননগর বাসী। পঞ্চমীর দিন থেকেই আলোয় ভাসছে শহরের অলিগলি। ষষ্ঠীর সন্ধ্যায় মণ্ডপে মণ্ডপে দর্শনার্থীদের ভিড় বাড়তে শুরু করে। অনেক জায়গায় থিমের রমরমা তা সত্ত্বেও সাবেকিনা ধরে রেখেছে প্রতিমায়। গত দু’বছর করোনার ফলে জগদ্ধাত্রী পুজোয় নানা বিধি নিষেধ ছিল। ফলে পুজোয় সেভাবে মেতে উঠতে পারেননি কেউই। আর এবার করোনা থেকে অনেকটাই স্বস্তি মিলেছে। তাই এবার বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসে মেতেছেন চন্দননগর বাসী।
জগদ্ধাত্রী বা জগদ্ধাত্রী দুর্গা হচ্ছেন দেবী দুর্গারই রূপভেদ। এক জন দুর্গা,আর অন্য জন হলেন জগদ্ধাত্রী ৷ উপনিষদে এঁর নাম উমা হৈমবতী। বাংলার হুগলি জেলার চন্দননগর, গুপ্তিপাড়া ও নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী পুজো খুবই জনপ্রিয়। কার্তিক মাসের শুক্লা নবমী তিথিতে দেবী জগদ্ধাত্রীর পুজো অনুষ্ঠিত হয়। তিনি সিংহবাহিনী, তবে দুর্গার মতো জগদ্ধাত্রী দশভূজা নন চতুর্ভুজা। তাঁর বাম দিকের দুহাতে থাকে শঙ্খ ও ধনু এবং ডান দিকের দুহাতে থাকে চক্র ও পঞ্চবাণ। দুর্গার সঙ্গে তাঁর সংযোগ স্থাপন করে বর্তমানে তাঁর মূর্তিটি নির্মাণ করা হয় তা হল কাঁচা সোনার রঙে। কমলা রঙের জগদ্ধাত্রী প্রতিমা বর্তমানে রাজ্যে খুব একটা দেখতে পাওয়া যায় না। বাহন সিংহ করীন্দ্রাসুর অর্থাৎ হস্তীরূপী অসুরের পৃষ্ঠে দণ্ডায়মান। এক ঝলকে দেখে নেওয়া যাক চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজো ৷
জগদ্ধাত্রী পুজোর নিয়মটি একটু আলাদা। দেবী জগদ্ধাত্রীর পুজো অনুষ্ঠিত হয় দুর্গাপুজোর ঠিক একমাস পর কার্তিক মাসের শুক্লা নবমী তিথিতে। কাত্যায়নীতন্ত্রে কার্তিকী শুক্লা নবমীতে দেবী জগদ্ধাত্রীর আবির্ভূত হওয়ার কথা আছে। জগদ্ধাত্রী পুজো দুটি প্রথায় হয়ে থাকে।
সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী এই তিন দিন জগদ্ধাত্রীর পুজো হয়। কোথাও কোথাও প্রথম বা দ্বিতীয় পুজোর পর কুমারী পুজোরও আয়োজন করা হয়। দুর্গাপুজোর ন্যায় জগদ্ধাত্রী পুজোতেও বিসর্জনকৃত্য বিজয়াকৃত্য নামে পরিচিত। এমনকী, পুষ্পাঞ্জলি ও প্রণাম মন্ত্রসহ পুজোর অনেক মন্ত্রও দুর্গাপুজোর মতোই হয়ে থাকে।
আর এই চন্দননগরে এই পুজোর জনপ্রিয়তা একেবারে তুঙ্গে। ইতিমধ্যেই সেখানে পুজো শুরু হয়ে গিয়েছে। উৎসবের মেজাজ সেখানে। এমনকী, দুর্গাপুজোর মতো জগদ্ধাত্রী পুজোতেও চন্দননগরে থিমের চমক দেখতে পাওয়া যায়। চোখ ধাঁধানো প্যান্ডেল ও আলোর কাজ দেখতে চন্দননগরে ভিড় একেবারে চোখে পড়ার মতো।
চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রবর্তন করেছিলেন ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী। রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের ঘনিষ্ঠ ইন্দ্রনারায়ণ ছিলেন চন্দননগরের ফরাসি সরকারের দেওয়ান। প্রায় আড়াইশো বছর আগে, কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির পুজো দেখে মুগ্ধ হয়ে ইন্দ্রনারায়ণ চন্দননগরের লক্ষ্মীগঞ্জ চাউলপট্টির নিচুপাটিতে জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রচলন করেছিলেন।
লক্ষ্মীগঞ্জ প্রতিষ্ঠার কিছুকাল পরেই জগদ্ধাত্রী পুজোর সূচনা হয়েছিল। এই পুজো চন্দননগরে আদি পুজো নামেই পরিচিত। এখনও পর্যন্ত চৌধুরী বাড়িতে এই পুজো হয়ে থাকে। আর সেখানে প্রতিমার বৈশিষ্ট্য হল সনাতনরীতির প্রতিমায় সাদা সিংহ এবং বিপরীতমুখী অবস্থানে হাতি।
স্থানীয়দের কাছ থেকেই জানা গিয়েছে, বিসর্জনের সময় আদি প্রতিমা জলে পড়লেই সেখানে সাপের দেখা পাওয়া যায়। আর সেই কারণেই স্থানীয়দের মতে এখানে দেবী অত্যন্ত জাগ্রত। লক্ষ্মীগঞ্জ কাপড়পট্টির জগদ্ধাত্রী পুজো চন্দননগরে দ্বিতীয় প্রাচীনতম পুজো। ১৭৬৮ সালে চাউলপট্টির চাল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মতের মিল না হওয়ায় কাপড় ব্যবসায়ী শ্রীধর বন্দ্যোপাধ্যায় চাঁদা তুলে এই পুজো শুরু করেছিলেন।
উত্তর চন্দননগরের লক্ষ্মীগঞ্জ চাউলপট্টি, কাপড়পট্টি, চৌমাথা ও বাজার এই চার পুজোতেই সিংহের রং সাদা। উত্তর চন্দননগরের অন্যান্য বড় জগদ্ধাত্রী পুজোগুলি হল চন্দননগর বাগবাজার, খলিসানী কলপুকুরধার, বউবাজার শীতলাতলা, খলিসানী বউবাজার, বাগবাজার চৌমাথা, বিদ্যালঙ্কার, পালপাড়া, বিবিরহাট উত্তরাঞ্চল, বিবিরহাট চড়কতলা তেমাথা, হরিদ্রাডাঙা, হেলাপুকুরধার, নাড়ুয়া, কাঁটাপুকুর, কাঁটাপুকুর চৌমাথা, বোড়ো কালীতলা, বোড়ো পঞ্চাননতলা, বোড়ো চাঁপাতলা, বোড়ো দিঘির ধার, বোড়ো তালডাঙা ইত্যাদি।
এক কথায় বলতে গেলে জগদ্ধাত্রী উৎসব শুরু চন্দননগরে। বাঙালির শ্রেষ্ঠত্বের দুর্গোৎসব হলেও চন্দননগর বাসীর কাছে শ্রেষ্ঠ উৎসব জগদ্ধাত্রী পুজো। সারা বছর এই দিনটির অপেক্ষায় থাকেন তারা। চতুর্থ সন্ধ্যা থেকেই মণ্ডপে মণ্ডপে প্রতিমা দর্শন করতে বেরিয়ে পড়েন অনেকেই। আজ নবমী ৷ জনস্রোতের অপেক্ষায় গোটা চন্দননগর ৷
দক্ষিণ চন্দননগরের বিখ্যাত জগদ্ধাত্রী পুজোগুলি হল মানকুণ্ডু সর্বজনীন, মানকুণ্ডু নতুনপাড়া, নিয়োগী বাগান, সার্কাস মাঠ, তেমাথা, অম্বিকা অ্যাথলেটিক ক্লাব, মরান রোড, গোন্দলপাড়া মনসাতলা, সাতঘাটা, গোন্দলপাড়া চারমন্দিরতলা, বেশোহাটা, লিচুতলা হাজিনগর, হাটখোলা দৈবকপাড়া, মনসাতলা, ভুবনেশ্বরীতলা, নোনাটোলা, বড়বাজার, পাদ্রিপাড়া, লালবাগান, ড্যুপ্লেক্সপট্টি, শ্রমিকপল্লি, সুভাষ জাগরণ সংঘ তেমাথা, অরবিন্দ সংঘ, বারাসত দক্ষিণ, বারাসত গেট।
চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজো মানেই হল আলোর খেলা। সেখানে আলো দেখতে যান অনেকেই। বিভিন্ন প্রান্তেই চন্দননগরের আলো ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
এ বছরে সব থেকে বেশি নজর কেড়েছে যে পুজো মণ্ডপগুলি তার মধ্যে অন্যতম হল দৈবক পাড়া সর্বজনীন জগদ্ধাত্রী পুজো। এবছরে তারা সুবর্ণ জয়ন্তী বর্ষ পালন করছে থিমের মধ্যে দিয়ে। চন্দননগরের যে সকল জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রতিমা করা হয় সবগুলি ঐতিহ্যবাহী পুজো। তবে দৈবক পাড়ার প্রতিমা একটু আলাদা। থিমের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই প্রতিমা নির্মাণ করা হয়। এখানে মা জগদ্ধাত্রীকে রাজ বেশ পড়িয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।